ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : পল ক্রুগম্যান;###;অনুবাদ : এনামুল হক

আতঙ্কিতের ভাবনা

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

আতঙ্কিতের ভাবনা

[ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় আমেরিকাবাসীর পরিণতি কি দাঁড়াবে? তারা কি সর্বনাশের পথে ধাবিত হবে? নোবেলজয়ী বিশিষ্ট মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান এ ব্যাপারে এক তমসাচ্ছন্ন ভবিষ্যত তুলে ধরেছেন নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত তাঁর এই নিবন্ধে।] অতএব এখন আমরা কি করব? ‘আমরা’ বলতে আমি বামপন্থী, মধ্যপন্থী এমনকি দক্ষিণপন্থীদের সেই সব ব্যক্তিকে বোঝাতে চাই যাদের দৃষ্টিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এ যাবতকালের নিকৃষ্টতম ব্যক্তি এবং যারা ধরে নিয়েছিলেন যে আমাদের নাগরিকদের প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন। আমি রাজনৈতিক কৌশল নতুন করে ভাববার কথা বলছি না। তার জন্য সময় পাওয়া যাবে। ঈশ্বর জানেন যে ভোটারদের রাজি করাতে কোন্ জিনিসটা প্রকৃতপক্ষে কাজ করে সে ব্যাপারে আমিসহ প্রায় প্রত্যেকের কাছে রহস্যের কোন সমাধান যে জানা ছিল না তা একেবারে পরিষ্কার। আপাতত অবশ্য আমি এই ভয়াবহ অভিঘাতের মুখে ব্যক্তিগত মনোভঙ্গি ও আচরণ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সর্বপ্রথম এ কথা মনে রাখুন যে কে সত্যকে তুলে ধরছে সেটা নয় বরং কে ক্ষমতায় যাচ্ছে সেটাই নির্বাচনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। অসাধুতার দিক দিয়ে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার ছিল নজিরবিহীন। মিথ্যাচারের জন্য কোন রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয়নি। সেই মিথ্যাচারগুলো ভোটারদের বিশাল গোষ্ঠীর কাছে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু তার পরও সেগুলো এতটুকু মিথ্যা হয়ে যায়নি। না, আমাদের দেশের অভ্যন্তর ভাগের শহর-নগরগুলো যুদ্ধাঞ্চল নয় সেখানে রেকর্ডসংখ্যক অপরাধ ঘটে। না, আমাদের দেশটা বিশ্বের সেই দেশ নয় সেখানে করের পরিমাণ সর্বোচ্চ। না, চীনাজ জলবায়ু পরিবর্তনকে ভুয়া বলে যা বলে আসছে সেটাও ঠিক নয়। কাজেই আপনারা যদি এ কথা মেনে নিতে প্রলুব্ধ হন যে বিশ্ব সম্পর্কে দক্ষিণপন্থী শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কিছু সত্যতা থাকতে পারে, তাহলে বলব প্রলুব্ধ হবেন না। মিথ্যা মিথ্যাই। সেগুলোর সমর্থনে যত শক্তিই থাক না কেন কিছু আসে যায় না। আর বুদ্ধিবৃত্তিক সততা নিয়ে যখন কথা বলতে যাই তখন প্রত্যেককেই এই অপ্রীতিকর বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন যে ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকা ও বিশ্বের অপরিসীম ক্ষতিসাধন করবে। অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পদে অধিষ্ঠিত ও মানুষটি আমাদের এতদিনের দেখা মানুষটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদাও হতে পারে। তবে তেমনটি না হওয়ারই সম্ভাবনা। দুর্ভাগ্যবশত আমরা শুধু চারটি মন্দ বছর নিয়ে কথা বলছি না। ৮ নবেম্বরের বিপর্যয়ের পরিণতি কয়েক দশক ধরে, হয়তবা কয়েক প্রজন্ম ধরে স্থায়ী হতে পারে। আমি বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ছিলাম। কার্বন নির্গমন প্রশ্নে সবে এক বৈশ্বিক ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাম এবং আমেরিকাকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল করে তোলার দিকে নিয়ে যেতে একটা সুস্পষ্ট নীতিনির্ধারণী পথ গড়ে তুলেছিলাম। এখন এ সবকিছুই সম্ভবত ভেস্তে যাবে এবং এতে যে ক্ষতি হবে তা হয়ত আর পূরণ হবে না। আর রাজনৈতিক ক্ষতিটা সুদূর, ভবিষ্যত পর্যন্তও ব্যস্ত হতে পারে। আশঙ্কার ব্যাপারটা এই যে কিছু ভয়ঙ্কর ধরনের লোক সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতির আসন গ্রহণ করবে। অঙ্গরাজ্যগুলো মনে করবে এ বছর তারা যতটা করেছিল তার চেয়ে ঢের বেশি মাত্রায় ভোটার দমনের কাজে নিয়োজিত হওয়ার মতো ক্ষমতায়ন তাদের ঘটেছে। মন্দের মন্দ হলো আমরা হয়ত দেখতে পাব যে, জিম ক্রো আইনের (বর্ণগত পৃথকীকরণ-অনু :) ঈষৎ গোপন রূপটি গোটা আমেরিকাতে প্রচলিত ধারায় পরিণত হয়েছে। এবং আপনাদের নাগরিক অধিকার নিয়েও ভাবনায় পড়তে হবে। হোয়াইট হাউসে অচিরেই এমন একজন মানুষ এসে বসবেন যার স্বভাবগতভাবে স্বৈরাচারীপ্রবণতা রয়েছে। আর কংগ্রেসও রয়েছে এমন একটি দলের নিয়ন্ত্রণে যা কিনা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোন আগ্রহের পরিচয় দেয়নি। স্বল্পমেয়াদী বিচারে কি হবে? আমার ‘নিজের প্রথম সহজাত প্রকৃতি বলেছিল যে ট্রাম্প-অর্থনীতির বদৌলতে দ্রুত এক অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেবে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা গভীরভাবে ভেবে দেখার পর আমি উপসংহারে পৌঁছলাম যে আমি যা ভেবেছিলাম সেটা সম্ভবত ভুল। আগামীতে আমি এ বিষয়ে আরও লেখা লিখব। তবে আমার সর্বোত্তম অনুমানটা হচ্ছে আশু এমন কিছু ঘটবে না যাতে বলা যাবে, যে শাস্তিটা প্রাপ্য ছিল তাই জুটেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে যারা ভোট দিয়েছিল ট্রাম্পের নীতি তাদের কোন সাহায্যে আসবে না। বস্তুতপক্ষে তার সমর্থকদের পরিণতি হবে ঢের বেশি শোচনীয়। তবে সেই কাহিনী সম্ভবত ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে। নয়া সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের অবশ্যই এমন কোন ভরসায় থাকা উচিত না যে অদূর ভবিষ্যতে তাদের মাথায় খড়গ নেমে আসবে। কাজেই আমরা কোন্ অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াব? উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কগ্রস্ত নাগরিক হিসেবে আমাদের কী করা উচিত এর একটা স্বাভাবিক জবাব হচ্ছে চুপচাপ থাকা। রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। দুনিয়াটা ধ্বংস হতে চলেছে, নরকে পরিণত হতে যাচ্ছে এমন একটা উপসংহার টানা নিশ্চয়ই প্রলুব্ধকার। কিন্তু কথা হচ্ছে আপনার এক্ষেত্রে কিছুই করার নেই। কাজেই নিজের বাগান পরিচর্যায় মনোনিবেশ করাই শ্রেয়। আমি নিজে নির্বাচনের পরদিনের একটা বড় অংশ সংবাদ শোনা পরিহার করে ব্যক্তিগত কাজকর্মে ব্যস্ত থেকে কাটিয়ে দিয়েছি। মূলত নিজের মস্তিষ্ককে অবকাশ দিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে গণতান্ত্রিক সমাজে আমরা এখনও রয়েছি এবং তেমন সমাজে বাস করব বলে আশা রাখি সেই সমাজের নাগরিকদের জন্য এটা কোন পথ নয়। আমি বলছি না যে ব্যারিকেডের ওপর আমাদের সকলের স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করা উচিত। আমি মনে করি না পরিস্থিতি তেমনই রূপ নিতে চলেছে। আমি কামনা করি আমার এই ধরাণাই যেন নিশ্চিতভাবে ঠিক হয়। তবে আপনারা যদি সত্যের এবং আমেরিকার মৌলিক মূল্যবোধের মুখোমুখি দাঁড়াতে না চান তাহলে নিজেদের আত্মমর্যাদা কিভাবে ধরে রাখতে পারবেন আমি তার কোন পথ দেখছি না। সেই অবস্থান বা ভূমিকাটি কি শেষ পর্যন্ত সফল হবে? কোন নিশ্চয়তা নেই। নিজেরা যতই সেক্যুলার হোক না কেন আমেরিকানদের প্রবণতাই হলো নিজেদের এমন এক জাতির নাগরিক হিসেবে ভাবা যার ওপর দৈবের বিশেষ আশীর্বাদ আছে; এই জাতিটি যাত্রাপথে ভুল বাঁক নিতে পারে, তবে সর্বদাই তার সঠিক পথটি ফিরে পায় যে পথে শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার সব সময় জয়যুক্ত হয়। তারপরও এটা সত্য হতে হবে তা নয়। হয়তবা সংস্কারের ঐতিহাসিক চ্যানেলগুলো- যেমন বক্তৃতা ও লেখনী যা মনোজগতে পরিবর্তন ঘটায়, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ যা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার ধারক-বাহকের বদলে ফেলে সেগুলো আর কার্যকর নয়। হয়তবা আমেরিকা স্পেশাল কিছু নয়। এটা হলো স্রেফ আর একটি রিপাবলিক যার সুদিন ছিল কিন্তু এখন লৌহমানবদের দ্বারা শাসিত একটি দুর্নীতিগ্রস্ত জাতিতে অধঃপতিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তবে এটা যে অবশ্যম্ভাবী তা আমি মেনে নিতে প্রস্তুত নই। কারণ অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নেয়া হলেও তা সপরিপূরক ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে দাঁড়াবে। আমেরিকার যা হওয়া উচিত সেই পথটা আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় অধিকতর দীর্ঘ কঠিন হতে চলেছে। আর সেই পথ পাড়ি দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তথাপি আমাদের চেষ্টা করতে হবে। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×