ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুদক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আলোচনা

বড় দুর্নীতিবাজদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২২ নভেম্বর ২০১৬

বড় দুর্নীতিবাজদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতির সবচেয়ে বড় হতাশা আর দুঃখের নাম হচ্ছে দুর্নীতি। এটি বর্তমানে সামাজিকীকরণ হয়েছে। ধনী গরিবকে আর গরিব ধনীকে শোষণ করতে শুরু করেছে। দুর্নীতিতে একে অপরকে সহায়তা করছে। যারা দুর্নীতি করেন তারা সমাজের ডাকাত। তারা বেহায়া, বেপরোয়া, নির্লজ্জ ও সাহসী। দুর্নীতি আসলে ডাকাত। যা ছোট-বড়দের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে দেয়। দুর্নীতিবাজদের মোকাবেলা ও প্রতিরোধ করতে হলে অবশ্যই দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ডাকাতদের মতোই আচরণ করতে হবে। তবেই সমাজ থেকে দুর্নীতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে। দুর্নীতি রুখতে না পারলে দেশের স্বাধীনতার সত্যিকারের স্থায়িত্ব রাখা সম্ভব হবে না। সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ১২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক আবু সায়ীদ এসব কথা বলেন। অধ্যাপক সায়ীদ বলেন, একসময় যারা দুর্নীতি করতেন তারা সমাজে চোরের মতো মাথা নিচু করে বেঁচে থাকতেন। তারা ছিলেন সমাজের ঘৃণার বস্তু। বর্তমান দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি করতে গিয়ে কাউকেই বা কোন আইনকেই তারা মানে না। দুর্নীতি করার আগেই তারা বাঁচতে প্রয়োজনীয় সকল পথই তারা তৈরি করে রাখেন। দুর্নীতিবাজরা তাদের স্বার্থে ডাকাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাজধানীর যানজট ও চারদিকের নদীর পানি যেমন এই শহরকে দুঃসহ করে তুলছে, তেমনি দুর্নীতি সারা জাতির দুঃখ। এটা এতটাই বেড়েছে যে বাংলাদেশ বার বার পৃথিবীর দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন সেই অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হয়েছে বলব না। তবে উত্তরণের চেষ্টা চলছে। যা বর্তমান কমিশন করছে। দুর্নীতি আমাদের শিরদাড়াকে ভেঙ্গে দিয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক সায়ীদ বলেন, প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এক সময় শক্তিমানরা যেমন দুর্বলকে শোষণ করত এখন দুর্বলরাও শক্তিমানদের শোষণ করে। এর ফলে দুর্নীতি আমাদের শিরদাড়াকে ভেঙ্গে দিয়েছে। দুর্নীতি এমনভাবে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে গেছে তা থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। এটা যুদ্ধের বিষয়। সেই যুদ্ধে সকলের অংশগ্রহণ করতে হবে। এটা যদি সত্যি সত্যি শুরু করা যায় তাহলে দুর্নীতি পিছু হটতে শুরু করবে। বড় দুর্নীতিবাজদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অপরাধ মূলত করে ক্ষমতাবান মানুষ। এ বিষয়টি সবাইকে দেখিয়ে দিতে হবে যে আইনের সামনে কোন অপরাধী শাস্তি ছাড়া পার পাবে না। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এ প্রতিষ্ঠাতা বলেন, মূলত স্বাধীনতার পর থেকেই মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। স্বাধীনতার পর অভাবের কারণে মানুষের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হতে দেখা যায়। তখনকার সময় দাতাদের দেয়া সাহায্যও লুটপাট হতো। বঙ্গবন্ধু এ কারণে বলেছিলেন চাটার দল সব চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। এর পরবর্তী সময় রাজনীতি দুর্নীতিপরায়ন হয়। ১৯৯১ সাল থেকে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র শাসন চলছে। তিনি বলেন, এখন রাজনীতিবিদরা মনে করে সরকার গঠন করতে পারলে সর্বক্ষমতার অধিকারী হওয়া যাবে আর বিরোধী দলে গেলে নিশ্চিহ্ন হতে হবে। বর্তমানে সংসদের ৬৯ শতাংশ সাংসদ ব্যবসায়ী। তারা রাষ্ট্রকে নিয়ে ব্যবসা করছে। আর দেশের মানুষকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। দেশ বরণ্য এই শিক্ষাবিদ বলেন, এখন দুর্নীতি করা গৌরব ও অহংকারের বিষয়। আজ অপরাধীরা দেশের মালিক, সম্পদের মালিক ও ক্ষমতার মালিক। আর ন্যায়বানরা চোরের মতো কোন রকম সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। তারা সমাজে সম্মান পাচ্ছেন না। অনুষ্ঠানে কমিশনার (তদন্ত) এ এফ এম আমিনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া অর্থ ফেরত দিলে অর্থ আত্মসাতকারীর প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নমনীয় থাকবে। মূলত এর মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতকারীরা অর্থ ফেরত দিয়ে কিছুটা হলেও পার পাবেন। অনুষ্ঠানে কমিশনকে অটোমেশনের আওতায় আনা, দুর্নীতি দমনের চেয়ে প্রতিরোধে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া, নতুন জেলা ভবন তৈরি করা, অপরাধীদের অধিক পরিমাণে গ্রেফতার করা, ৫টি বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিবিরোধী টিম গঠন করা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি প্রতিরোধে ও উন্নয়নে সুপারিশ মালা প্রণয়ন করা, দুর্নীতিবাজদের ধরতে ইনকামটেক্স আইনের সংশোধনে চেষ্টা করা, জঙ্গী অর্থায়নে বাংলাদেশকে ঝুঁকিমুক্ত অর্থায়নের দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক সংগঠন এপিজির কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, মানি লন্ডারিং শাখার কার্যক্রমে অধিক গতির সঞ্চার করাসহ নানা কার্যক্রম তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) নাসিরউদ্দীন আহমেদ, সচিব আবু মোঃ মোস্তফা কামাল বক্তব্য প্রদান করেন। এছাড়া মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুনির চৌধুরী, মঈদুল ইসলাম, ফরিদ আহমেদ ভূঞা, নূর আহমদ, সামসুল আরেফীন তাদের বাৎসরিক কর্মকা- তুলে ধরেন ও এর ওপর আলোচনার পাশাপাশি দুদককে কার্যকর করতে বিভিন্ন সুপারিশ করেন। সভাপতির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমরা এক যুগ পার করেছি সত্য, কিন্তু গণমানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি বিবেচনা করলে হতাশ হতে হয়। কারণ প্রাপ্তির হারটা একেবারে নগণ্য। দেশের দুর্নীতির মহাযজ্ঞ রুখতে আমরা প্রতিরোধের ওপর বেশি জোর দিয়েছি। আজকের শপথ যেন কাগজে কলমে না হয়ে বাস্তবের শপথ হয়। এর আগে অনুষ্ঠানে কমিশনের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শপথবাক্য পাঠ করান দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, আমরা অকপটে ও দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করছি যে, দুদকে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা আছে, সিস্টেমে সমস্যা আছে, দুর্নীতিও আছে। আমরা চেষ্টা করছি এসব পরিবর্তন করতে। আমরা জনগণের আস্থা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। হতে পারে অনেক ক্ষেত্রে সকলের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। তবে ভবিষ্যতে আস্থা বাড়িয়ে সকলের প্রত্যাশা পূরণ করব। এর আগে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৯টায় কমিশনের প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। এরপর জাতীয় পতাকা ও কমিশনের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান দিবসটির শুভ সূচনা করেন। পাশাপাশি প্রধান কার্যালয়ের সামনে শান্তির প্রতীক কবুতরসহ বেলুন উড়ানো হয়। এ সময় তিনি বলেন, আমরা জনগণের আস্থা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। হতে পারে অনেক ক্ষেত্রে সকলের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। তবে ভবিষ্যতে আস্থা বাড়িয়ে সকলের প্রত্যাশা পূরণ করব। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ছোট, বড় দুর্নীতিবাজ বড় কথা নয়। কারণ ছোটরাই এক সময়ে বড় দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠে। তাই আমাদের কাজ হবে দুর্নীতিবাজ সকলকে আইনের আওতায় আনা। এজন্য তিনি প্রধানত গণমাধ্যমসহ সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ১২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি বিশেষ ক্রোড়পত্রে বাণী প্রদান করেছেন। এছাড়া কমিশনের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বিটিআরসির মাধ্যমে ‘দেশপ্রেমে শপথ নিন, দুর্নীতিকে বিদায় দিন’ শীর্ষক ক্ষুদে বার্তা মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কমিশনের চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় এবং ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে ১২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় পতাকা ও কমিশনের পতাকা উত্তোলন, আলোচনাসভা, শপথগ্রহণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এক যুগ পূর্তি হওয়া দুদক ২০০৪ সালের ২১ নবেম্বর তৎকালীন চার দলীয় ঐক্য জোট সরকারের সময় বাংলাদেশ ‘ব্যুরো অব এন্টিকরাপশন’ বিলুপ্ত করে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যাত্রা শুরু করে।
×