ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হজে গিয়ে এক ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা

পাথর মেশানো ভাত, বেশি ঝালের তরকারি, সস্তা হোটেল

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২২ নভেম্বর ২০১৬

পাথর মেশানো ভাত, বেশি ঝালের তরকারি, সস্তা হোটেল

আজাদ সুলায়মান ॥ ভাত যাতে বেশি না খেতে পারে, সেজন্য মেশানো হয় পাথর। তরকারি যাতে কম লাগে, সেজন্য দেয়া হতো বেশি ঝাল। হোটেলের খরচ যাতে কম লাগে, সেজন্য রাখা হয় হেরেম শরীফ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত সস্তা হোটেলে। আরাফাত থেকে বাসে নেয়ার শর্ত থাকলেও হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছে বৃদ্ধ নারী-পুরুষকেও। মাহরাম ছাড়া হজে গেলে পদে পদে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় নারীদের। ঘটেছে কোরবানির টাকা আত্মসাতের মতো ঘটনাও। এ ধরনের দুই শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনে। এগুলোরই এখন শুনানি ও তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এসব অভিযোগ যারা করেছেন তাদের কজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় অবিশ্বাস্য সব কাহিনী। সদ্য সমাপ্ত হজে গিয়ে এমনই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা খাদিজা বেগম জেসমিন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, এতদিন শুধু শুনতাম হজ প্রতারণার কথা, কখনও বিশ্বাস করতাম না। এবার যখন নিজেই হজে গিয়ে এমন নাজেহাল হয়েছি, তখন ভাবতে অবাক লাগে হজের নামে এজেন্সিগুলো কতটা জঘন্য ও নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে। ধর্মের প্রতি এসব এজেন্সির বিন্দুুমাত্র শ্রদ্ধাভক্তি বা ভয়ভীতি নেই। কোন মুসলমান অপর একজন মুসলিমকে আরাফাতের ময়দানে এতটা নাজেহাল করতে পারে সেটা বর্ণনা করতেও ঘৃণা লাগে। তিনি জানালেন মাহরাম ছাড়া হজে গেলে নারীদের কী ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। শুধু খাদিজা বেগম নন, তার মতো এমন শত শত ভুক্তভোগীর অভিযোগ জমা পড়েছে মক্কা হজ মিশন, আশকোনা হজ অফিস ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ে। শুধু মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনেই দুই শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের গণশুনানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল জলিল ম-ল জানিয়েছেন, প্রতিবারের মতো এবারও অভিযোগ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। বেশকিছু অভিযোগ ইতোমধ্যে জমা পড়েছে। সেগুলোর তদন্ত করা হবে। দু’পক্ষের শুনানির পর দায়ী এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে খেঁাঁজ নিয়ে জানা যায়, আগামী সপ্তাহেই শুরু হবে এসব অভিযোগ নিষ্পত্তির শুনানি। ভুক্তভোগীদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রসাশনিক কর্মকর্তা খাদিজা বেগম জানান, আরাফাতের ময়দান থেকে মুজদালিফা যাওয়ার পথে তার সঙ্গে চরম অমানবিক আচরণ করেছেন হজ এজেন্সির লোকজন। তাকে চার কিলোমিটার রাস্তা হাঁটতে বাধ্য করা হয়। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পরও তাকে টানাহেঁচড়া করেছেন এজেন্সির নিযুক্ত প্রতিনিধি। তার কাছ থেকে হজের প্যাকেজ বাবদ সব টাকা নেয়া হয়েছে। প্যাকেজ মতে তাকে রাখার কথা ছিল হেরেম শরীফের নিকটবর্তী কোন হোটেলে। সেখানে গিয়ে এসব শর্তের সঙ্গে কোন মিল পাননি। অনেক দূরের হোটেলে রাখা হয়েছে তাকে। তার এজেন্সি শুধু তার একার সঙ্গেই এমন আচরণ করেনি, সবার সঙ্গেই এমন অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করেছে। খাদিজা তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন- তাই আর কোন নারী যাতে মাহরাম ছাড়া হজে গিয়ে তার মতো দুর্দশার শিকার না হন, সেদিকে সতর্ক থাকার উপদেশ দিয়েছেন। আরাফার ময়দান থেকে মুজদালিফায় যাওয়ার পথে যে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন সেটার বর্ণনা করতে গিয়ে বার বার কেঁদেছেন। চোখ মুছতে মুছতে বলেছেন, জীবনে কখনও ভাবিনি হজে গিয়ে এমন অমানুষিক দুর্দশার শিকার হতে হবে। আমি একজন বয়স্ক নারী। মাহরাম ছাড়াই একটি বেসরকারী এজেন্সির মাধ্যমে তিন লক্ষাধিক টাকা দিয়ে হজে যাই। কথা ছিল মক্কার খুব কাছাকাছি হোটেলে রাখা হবে। সে কথা এজেন্সি রাখেনি। মক্কা থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কাকিয়া নামক স্থানে একটি হোটেলে আমাকেসহ অন্যদের রাখা হয়। সেখানেই এক ব্যক্তি আমাদের মহিলাদের দেখাশোনা করত। লোকটি যখন-তখন খালি গায়ে আমাদের সামনে আসত। খাদিজা বলেন, আরাফার ময়দান থেকে মুজদালিফা যাওয়ার পথে আমাদের হাঁটতে বাধ্য করা হয়। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় পড়ে গেছি বহুবার। পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে। একপর্যায়ে পড়ে যান রাস্তায়। তখন তার সঙ্গে অপর এক নারীকে একটু ধরার কথা বললে হজ গাইড আলাউদ্দিন তাকে গালমন্দ করেন। পাল্টা কৈফিয়ত চানÑ মাহরাম ছাড়া কেন হজ করতে এসেছেন। আপনাকে কেউ সহযোগিতা করতে পারবে না। আপনি মরে গেলেও কারও ধরা ঠিক হবে না, যান বিরক্ত করবেন না। মুজদালিফা থেকে মিনার মাঠে পাথর মারতে যাওয়ার সময়েও খাদিজার সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হয়েছে তা অবিশ্বাস্য। তাকে ধাক্কা দিয়ে মিনার মাঠে ফেলা দেয়া হলেও তিনি তার প্রতিবাদ করতে পারেননি। শুধু গাইডের নির্দয় আচরণে তার হজ করাটা কঠিন হয়ে উঠলেও তিনি তা নীরবে সয়ে গেছেন। একটু প্রতিবাদও করেননি। দুনিয়া ও আখেরাতের আশায় তিনি কঠোর মনেবলে সবই মেনে নিয়েছেন। বলেছেন, এভাবে অন্তত আর যেন কোন নারী মাহরাম ছাড়া হজে না যান। মাহরাম ছাড়া গেলে কী ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হয় তা হাড়ে হাড়ে তিনি টের পেয়েছেন। এতদিন যা শুনেছেন তা এবার অভিজ্ঞতা হিসেবে শিক্ষা নিয়েছেন । হজ নিয়ে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে ঢাকার সচিবালয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে বাদী-বিবাদীর শুনানি শেষে তথ্যপ্রমাণাদি সহকারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা যায়, এসব অভিযোগের বেশিরভাগই হজ এজেন্সিগুলোর প্যাকেজের শর্ত লঙ্ঘন করে হাজীদের সঙ্গে প্রতারণার। প্রথম দুদিন হেরেম শরীফের কাছাকাছি বাড়িতে রেখে পরে অনেক দূরের বাড়িতে রেখে (ফিতরা পদ্ধতি) কষ্ট দেয়া, নিম্নমানের খাবার সরবরাহ, দূরের পথ হাঁটতে বাধ্য করা, অসুখ-বিসুখে পাশে না থাকা ও প্রয়োজনীয় সময়ে কোন গাইডের সহযোগিতা না পাওয়া। হজ প্যাকেজে ঘোষিত সুবিধাদি বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়ার পর অনেককে লাঞ্ছিত করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। হজ চলার সময় মক্কা হজ মিশনে প্রতিদিনই এ ধরনের অভিযোগ আসত। সেগুলো হজের পর দেখা হবে বলে হাজীদের আশ্বস্ত করা হতো। এদিকে আশকোনা হজ অফিসে গিয়েও দেখা যায়, বেশকিছু অভিযোগ এখানেও জমা পড়েছে। সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। এখানেই অভিযোগ করেন বিক্রমপুরের বাসিন্দা নজরুল খান নামের একজন প্রতারিত হজযাত্রী। পেশায় ব্যবসায়ী নজরুলের অভিযোগ, মুবাল্লিগ ও কেবলান নামের দুটি হজ এজেন্সি তিনিসহ আরও বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে প্যাকেজের পুরো টাকা বুঝে নেয়। তারপরও তারা ৪-৫ জন হজে যেতে পারেননি। হজের শেষ ফ্লাইটের আগের দিনও তিনি আশকোনা হজ অফিসে গিয়ে ধর্ণা দিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন কেন প্রি-রেজিস্ট্রেশনের সিরিয়ালে থাকার পরও ভিসা মেলেনি। কেউ তাকে কিছু জানাতে না পারলেও এ প্রতিবেদক অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হনÑ মুবাল্লিগের ইজ্জত আলী ও কেবলানের রফিক তাদের কয়েকজনের সিরিয়াল অন্যদের কাছে বেশি মুনাফায় বিক্রি করে দিয়ে হজে পাঠিয়েছেন, যাকে বলে রিপ্লেসমেন্ট বাণিজ্য। নজরুল খানের মতো এমন অনেক লোক রিপ্লেসমেন্ট বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন। অথচ তিনি নিজেও একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও অন্যের কাছে তার সিরিয়াল বিক্রি করা হয়েছে চড়া দামে। এটা কিছুতেই তিনি সহ্য করতে না পেরে এবার সিদ্বান্ত নিয়েছেন নিজেই হজ লাইসেন্স করে হজে যাবেন। এ সম্পর্কে ধর্ম সচিব আব্দুল জলিল তালুকদার বলেছেন, অভিযোগগুলো খুবই গুরুত্ব দিয়ে নিষ্পত্তি করা হয়। অভিযোগ প্রমাণ হলে হজ লাইসেন্স বাতিল, স্থগিত ও আর্থিক জরিমানা করা হয়। এবারও তাই করা হবে। ধমের্র নামে এমন ব্যবসা করে কেউ যেন পার পায় না সেজন্যই এখন চলছে বিভিন্ন অভিযোগের শুনানি। ইতোমধ্যে মক্কা হজ মিশনে জমা হওয়া দুই শতাধিক অভিযোগ যাচাই-বাছাই করার কাজ চলছে। এগুলো পরে ঢাকায় ধর্ম মন্ত্রণালয় অফিসে পাঠানোর পর দু’পক্ষের শুনানি হবে। এ বিষয়ে হজ এজেন্সিগুলোর সংগঠন হাব সভাপতি ইব্রাহিম বাহার জনকণ্ঠকে বলেছেন, প্রতি বছরই এ ধরনের কিছু অভিযোগ আমাদের অফিসেও আসত। আমরা সেগুলো সালিশ-দরবারের মাধ্যমে যতটা সম্ভব ফয়সালা করতাম। কিন্তু এবার এখনও আমরা বড় ধরনের কোন অভিযোগ পাইনি। হয়ত এবার হয়রানি-অনিয়ম কম হয়েছে।
×