ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

সবার মধ্যেই কি এক টুকরো ট্রাম্প জায়গা করে নিয়েছেন?

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২২ নভেম্বর ২০১৬

সবার মধ্যেই কি এক টুকরো ট্রাম্প জায়গা করে নিয়েছেন?

(গতকালের পর) ॥ সাত ॥ শামসুর রাহমানের নাম আমরা এখন তার জন্ম ও মৃত্যু দিবসেই মনে করি। তাতে অবশ্য শামসুর রাহমানের কিছু আসে যায় না। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত মাইলফলক ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিটি উপলক্ষে শামসুর রাহমানের কবিতা আছে। বাংলা ভাষায় আর কোন কবি এত কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। তিনি যদি স্পেনিশ ভাষায় লিখতেন তাহলে পাবলো নেরুদার মতো পূজিত হতেন। এখনও ক্ষুব্ধ হলে সান্ত¡না পেতে, ভাল লাগলে, ক্রোধ প্রকাশ করতে হলে তারই আশ্রয় নিই। রাজাকারদের তা-বে যখন অস্থির বাংলাদেশ তখন তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন- ‘অভিশাপ দিচ্ছি এতটুকু আশ্রয়ের জন্যে, বিশ্রামের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা প্রেতায়িত সেই সব মুখের ওপর দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট।’ আজ জামায়াত ও মানবতাবিরোধীদের ক্ষেত্রে সে অভিশাপ অনেকটা ফলেছে। কিন্তু এখনও রয়ে গেছে তারা শিকড়ে-বাকড়ে জড়িয়ে। রাজনীতি, আমলাতন্ত্র কোথায় তারা নেই। চারদিকে এখন তোয়াজের সমুদ্র আর বিনিময় বা লেনদেন। সব আমলেই এসব দেখেছি। একজন কেন্দ্রে বাকি সব শামসুর রাহমানের ভাষায়- এই সব পুতুল পরিবৃত খেলোয়াড় যে আসনে সমাসীন, তাতে কোনো মুৎসুদ্দি ভাঁড়, নেকড়ে ভালুক, উল্লুক, বেবুন, ঘোড়া অথবা খচ্চর উড়ে এসে জুড়ে বসলেও আমরা টুঁ শব্দটি করবো না। তার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়ো আর বেগুনের মতো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীগণ বাকারদা নতুন করে শপথবাক্য উচ্চরণ করবেন... ‘আমরা কিছু বুঝবো না, কিছু বলবো না, শুধু বোঝা হয়ে থাকবো।’ এখন আমরা কিছু বলি না, করি না শেখ হাসিনার কারণে। তাকে আমরা যেমন শ্রদ্ধা করি, ভালও বাসি। তার আমলে এসব ঘটুক তা আমরা চাই না। যদি এসব ঘটনা ঘটত এরশাদ বা খালেদার আমলে তাহলে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো মিডিয়াতে, শিক্ষা, সংস্কৃতি অঙ্গনে? আমরা কিছু বুঝি, একেবারে বেকুব তা তো নই। খালেদা-নিজামীর শাসনে আমরা ফিরতে চাই না। কিন্তু, এ আমলের বিভিন্ন ঘটনায় একজন ট্রাম্পের উত্থান হোক সেটিও তো আমরা চাই না। দল, সরকার সবখানে আমরা কালো ছায়া দেখতে পাচ্ছি। আমরা তা দেখতে পেলে প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চয়ই পান। তাহলে এসব ছায়াকে প্রসারিত হওয়ার সুযোগ কেন করে দেয়া, এটিই প্রশ্ন। শিক্ষা সেক্টরে বিশেষ করে মাদ্রাসা সেক্টরে কী করে জঙ্গি উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত? কী করে সেখানে এখনও বঙ্গবন্ধু আদর্শবিরোধী শিক্ষা দেয়া হয়? কিভাবে বলা হয় সেখানে পাঠ্যে সব ‘হিন্দু নাম’ [সেটি কী? মুসলমান নামও বা কী?] বাদ, হিন্দু কবিদের কবিতা বাদ। আওয়ামী লীগ কী জামায়াতী আদর্শ বাস্তবায়নে এসেছে? আওয়ামী লীগ যদি নিজের ম্যান্ডেটে আসে তাহলে অন্যদের ম্যান্ডেট কার্যকর কেন করবে? কেন আওয়ামী লীগের এমপিরা কুকাজে লিপ্ত হবে এবং কেন তার জন্য তাৎক্ষণিক শাস্তি হবে না? ওবায়দুল কাদেরের এ্যাকশন কাদের বিরুদ্ধে? কেন দলীয় নেতারা এসব সঙ্কটে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে না? কেন তাদের আগে প্রতিটি এ ধরনের ইস্যুতে আমাদের দাঁড়াতে হয়? সবশেষে বলব, একটি বিষয়ের সমীকরণ আমি কিছুতেই মেলাতে পারি না। সেটি হলো, বঙ্গবন্ধু ৩০ বছর সংগ্রাম করে যে আদর্শ স্থাপিত করলেন, তাঁর মৃত্যুর পরই তা অন্তর্হিত হলো কেন? শেখ হাসিনা আজ এক যুগের কাছাকাছি ক্ষমতায়, তারপরও কেন আমাদের সবার মধ্যে এক টুকরো হেজাবি থেকে গেল? সমসাময়িক হিসাব ধরলে বলতে হয়, কেন এক টুকরো ট্রাম্প আমাদের মধ্যে বসবাস করে? দেখতে ভদ্রজন, আদর্শবাদী কিন্তু কোন না কোন ঘটনায় ট্রাম্পীয় ভাবটা বেরিয়ে আসে। নাসিরনগর আর গোবিন্দগঞ্জের ঘটনায় যেমন বেরিয়ে এলো এমপি, মন্ত্রী, স্থানীয় নেতা, প্রশাসনের ট্রাম্পীয় মনোভাব। ভয় এটাতেই আর সে কারণেই লেখা। কারও সমালোচনাও নয়, বিরোধিতাও নয়। এই বয়সে বুঝেছি, বাংলাদেশে আর যাই হোক জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা চলবে না। শামসুর রাহমানের ভাষায়- ‘বোবা হয়ে থাকা সবচেয়ে ভালো।’ সবকিছু তখন আমার করায়ত্তে। এটি পলায়নী ভাবনা হতে পারে। কিন্তু, এ দেশ তো পলায়নী ভাবনায় এগোয়নি। প্রতিবাদেই এগিয়েছে। ট্রাম্পীয় ভাবনা যেন আমাদের মানসজগতে ঠাঁই না পায় সেক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব আমাদের কামনা। খালেদা-নিজামীর আমলে এসব ঘটতে পারে, তাদের দলীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া এমন হতে পারে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাদের হতে পারে না। এবং এ ধরনের ভাবনা যাতে প্রসারিত না হয় তার জন্য সামগ্রিক কর্মসূীচ নেয়া বাঞ্ছনীয়। সে কর্মসূচী নিলে, তার ডাকে সাড়া দিতে মানুষের অভাব হবে না। সত্যিই শুভবুদ্ধির মানুষ, শেখ হাসিনার সমর্থক মানুষজন এ ধরনের কর্মকা-ের পুনরাবৃত্তি চায় না। (সমাপ্ত)
×