ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মালেক

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা এবং একজন ক্রেজি এ্যান্ড্রু

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২২ নভেম্বর ২০১৬

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা এবং একজন ক্রেজি এ্যান্ড্রু

নিউইয়র্ক ম্যানহাটানের ট্রাম্প টাওয়ারে স্বর্ণ ও মার্বেল পাথরে নির্মিত প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পেন্ট হাউস এখন পৃথিবীর নেতা-নেত্রী ও ক্ষমতামুখী রাজনীতিবিদদের তীর্থ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে পা রেখেছেন ব্রেক্সিট নেতা নিগেল ফারাজ, জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আর দীর্ঘদিন অবসরে থাকা এক সময়ের স্বনামখ্যাত ও বিতর্কিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ট্রাম্প মন্ত্রিসভায় কাদের নেয়া হবে তা নিয়ে শলাপরামর্শ চলছে। নাম ঘোষণাতে দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে ট্রানজিশন সূত্র বলছে রিপাবলিকানরা তথা ট্রাম্প যে বিজয়ী হবেন সেটি কেউ ভাবেননি তাই এ ব্যাপারে কোন পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় ধীর গতিতে কাজ চলছে। কিন্তু কে কি হবেন বা কে কোন পদ বা পদবি পাবেন সে বিষয়ে জানেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট। যেটা তিনি টুইট করে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। পদ প্রত্যাশীদের দৌড়ে অগ্রণীদের মধ্যে রয়েছেন নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি, প্রাক্তন স্পিকার নিউইট গিংরিচ, সাউথ ক্যারোলিনার গবর্নর নিকি হেইলি। গত শনিবার সকালে জানা গেল এ্যাটর্নি জেনারেল হতে যাচ্ছেন প্রবীণ সিনেটর জেফ সেশন্স, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এ্যাডভাইজার লেফট জে. (অব.) মাইকেল ফ্লিন ও নতুন সিআই এ প্রধান হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে মাইক পম্পেরও। কেউ কেউ প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তুলনা করেছিলেন ১৮২৮ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনে সপ্তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এ্যান্ড্রু জ্যাকসনের সঙ্গে যাকে সবাই বলত ‘ক্রেজি ম্যান’। কারও কারও ভাবনা ছিল আসলেই কি হোয়াইট হাউসের সর্বোচ্চ পদে বসে ডোনাল্ডের মাথায় ভর করবেন পাগলা এ্যান্ড্রু? কিন্তু মর্নিং শোজ দ্য ডে, ২০১৬ সালের ইলেক্ট প্রেসিডেন্ট পাগলা নন একেবারেই। বাল্যকালে এ্যান্ড্রুর মতো অনাথ ও দরিদ্র ছিলেন না ট্রাম্প। অর্থবান পরিবারের সন্তান, যুদ্ধে যাননি কখনও, প্রশাসনে ছিলেন না এবং বিলিয়নিয়ার হয়েও জীবনে মদ্যপান করেননি। এক সাক্ষাতকারে এই তথ্য জানিয়ে কারণ হিসেবে বলেছেন- মাদকাসক্তি থেকে তাঁর প্রিয় ভাই ও বাবার বন্ধুজীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া। এ্যান্ড্রু জ্যাকসনের ছিল দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন তবে ধনকুবের ভাণ্ডারে সে অভিজ্ঞতা না থাকলেও অভিজ্ঞ ঝানু রাজনীতিকদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরালেন তিনি। এবিসি সূত্রে শুক্রবারে প্রকাশ ক্ষমতায় বসার আগেই তিনি ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের করা মামলার নিষ্পত্তি করে ফেললেন ২৫ মিলিয়ন ডলারে। এ সময়টায় ‘হি প্লেজ হিজ ওন রুল’ আর ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প যা বলেন, তা করেন না’ কথা দুটো সর্বৈব সত্যি। শুরু হলেই কেবল বলা যায় তিনি কি করছেন, তিনি কি করবেন। দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে কাজ শুরু করলেন এবং সে কাজের ভেতর দিয়ে নিজস্ব রোল প্লে শুরু হয়ে গেছে। যারা তাকে দীর্ঘদিন ধরে দেখেছেন তাদের কাছে সুবিদিত একজন ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভেতর আছেন দু’জন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই দুই বিপরীতমুখী অস্তিত্ব নিয়েই রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারপার্সন প্রিভিস রেনোকে তিনি হোয়াইট হাউস চীফ অব স্টাফ হিসেবে মনোনীত করেছেন আবার একই সঙ্গে হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট স্টিভ ব্যাননকে চিফ অব স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে। যদিও গুরুত্বপূর্ণ এই পদে রেনের নিয়োগে টি পার্টি ও তৃণমূল রিপাবলিকানরা অখুশি। কারণ হিসেবে বলা যায় প্রচারণায় ভোটারদের ট্রাম্প বলেছেন ওয়াশিংটনের রাজনীতিকরা সাধারণ মানুষের কথা ভাবে না। সন্দেহ নেই এই এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী বক্তব্য দিয়েই তিনি মানুষের মন জয় করেছেন। কিন্তু বাস্তবে প্রেসিডেন্টের আসনে বসে ওয়াশিংটনের রাজনীতি তার এবারের কর্মক্ষেত্র যার অলিগলি তার অচেনা। হোয়াইট হাউসে বসে ক্যাপিটল হিলের রাজনীতি মোকাবেলা করতে হলে পাশে এমন একজনকে দরকার যিনি একাধারে তার বিশ্বস্ত অন্যদিকে যার সঙ্গে রয়েছে ক্যাপিটল হিলের সুসম্পর্ক। প্রিভিসকে এমন পদে বসানোর কারণ হলো ক্যাপিটাল ফোর্সের সঙ্গে চেয়ারপার্সন হিসেবে প্রিভিসের সম্পর্ক দীর্ঘ সময়ের। প্রিভিস রেনো ২০১১ সালে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর দক্ষ হাতে ঋণগ্রস্ত দলকে ঋণের বোঝা থেকে বাঁচিয়ে নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন জি ও পিকে। এছাড়া এবারের নির্বাচনে তিনি যেমন প্রয়োজনে ডোনাল্ডের বিরোধিতা করেছেন তেমনি সবসময় একটি পজেটিভ রিলেশনশিপ রাখতে চেয়েছেন ট্রাম্পের সঙ্গে। ট্রাম্পবিরোধী রিপাবলিকান ডেলিগেটগণ যখন তাকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিতে বাধার সৃষ্টি করেছিলেন তখন প্রিভিস এতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। আবার ইরাক যুদ্ধে নিহত ক্যাপ্টেন হুমায়ুন খানের গোল্ডস্টার পরিবার নিয়ে ট্রাম্পের কটূক্তির সময় তিনি বলেছিলেন ‘আমরা তাদের ভালবাসি। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যখন কোন পরিবারের ছেলে বা মেয়ে আর কোনদিন গৃহে ফিরে আসে না সে বিষয়টি একজন পিতা হয়ে আমি ভাবতে পারি না।’ কিন্তু তিনি রিয়েল স্টেট মুঘলকে অভিহিত করেছেন একজন রোল মডেল হিসেবে ‘ব্যবসায় সর্বস্ব হারিয়ে যে ব্যক্তি মার্কিন স্বপ্নের গোল সেট করে আবার ব্যবসায় ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে, তিনি তো স্বক্ষেত্রে একজন রোল মডেলই বটে।’ অন্যদিকে স্টিভ ব্যানন রিপাবলিকান পার্টির ওয়াশিংটনের এস্টাবলিশমেন্টের তীব্র বিরোধী হিসেবে পরিচিত। তিনি ব্রাইড পার্ট নিউজের সম্পাদক। হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট ব্যাননের নিয়োগের কড়া সমালোচনা করেছে ডেমোক্র্যাটরা। কিন্তু ব্যাননের বিষয়টি যতই বিতর্কের সৃষ্টি করুক তিনি এসেছেন রিপাবিকান তৃণমূল থেকে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে তিনি একদিকে যেমন হবেন সহযোগী অন্যদিকে দলে ট্রাম্পের বিরোধিতাকারীদের কথা যেমন কানে তুলবেন এবং প্রতি উত্তর দেবেন তাদের মুখের ওপর। স্পিকার রায়ান শুরু থেকে সুসম্পর্ক রাখেননি ট্রাম্পের সঙ্গে। মজার কথা হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ স্পিকার পল রায়ানের সঙ্গে রয়েছে প্রিভিসের সখ্যর সম্পর্ক আর তাকে তাড়ানোর ব্যাপারে ব্যানন দু’পায়ে খাড়া। কিন্তু অভিজ্ঞ লোকে বলছে যা খেলার সেটা খেলবেন ইলেক্ট প্রেসিডেন্ট এবং সে খেলাটি আরও জটিল। গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিশন টিমে ট্রাম্প সন্তানরা আছেন ও প্রিয়তম কন্যা ইভ্যানকার স্বামী-জামাতা জ্যারেড কুশনার হোয়াইট হাউসে গুরুত্বপূর্ণ রোল পালন করার কথা। জেরিক কুশনারের বিষয়টি সমালোচনায় এসেছে। জবাবে বলা হয়েছে কুশনার আত্মীয় বিধায় সেই পদে কোন বেতন নেবেন না। ডোনাল্ডও প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেতন নেবেন না জানিয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে ট্রাম্পের সমগ্র নির্বাচনী কর্মকা-ে তার পরিবার ছাড়া পাশে আর তেমন কেউ ছিলেন না। সঙ্গত কারণে প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ট্রাম্প তাদের টিমে রেখেছেন। ট্রানজিশন টিম চেয়ারম্যান পদ থেকে নিউজার্সির গবর্নর ক্রিস ক্রিস্টিকে বাদ দিয়ে সেই পদে ইলেক্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে নিয়োগ দেয়ার পক্ষে বলা হচ্ছে। ক্রিস নাকি কুশনারের পিতাকে জেলে পুরেছিলেন কোন মামলায়। ইতিপূর্বে ট্রাম্পের রানিং মেট তথা ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্রিস্টির নাম থাকলেও সে কারণেই পরে বাদ যান। নির্বাচনের পর ক্রিস্টি একেবারে যাকে বলে ছিটকে পড়লেন। ক্রিস্টি ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে কংগ্রেসম্যান মাইক রজার্সও পদত্যাগ করলেন। নির্বাচনের দিন আমার লেখায় ছোট করে হলেও ছিল ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের মতো আমেরিকাতেও এক অঘটনের আশঙ্কা। কিন্তু সেই ঘটনা ঘটিয়েই ইতিহাস সৃষ্টি করলেন ট্রাম্প। কিন্তু ভোটের পরদিন থেকে ‘হে হে হো হো-ডোনাল্ড ট্রাম্প গো গো’ ও ‘ইউ অরে নট মাই প্রেসিডেন্ট’ বলে সেøাগানে ভেসেছিল সমগ্র আমেরিকা তা এখনও অব্যাহত। মুসলমান, কালো আমেরিকান ও লাতিনদের বিরুদ্ধে হেট ক্রাইম বাড়ার ফলে নিউইয়র্ক, টেক্সাস, ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় গত এক সপ্তাহে ৪৩৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে আমেরিকানদের প্রেসিডেন্ট হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য একটি সুকঠিন পরীক্ষা। তার সেøাগান অনুসারে আমেরিকাকে আবার গ্রেট করতে পারবেন কিনা তার উপরেই নির্ভর করছে রিয়ালিটি টিভি স্টারের ভবিষ্যত। অন্যদিকে, হিলারি কি অবসরে যাচ্ছেন- এমন ভাবনার মধ্যে দিয়েই নির্বাচনের পর প্রথম প্রকাশ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে শিশুদের এক অনুষ্ঠানে এলেন গত বুধবার। তার আগে ফোনে কথা বলেছেন ডোনার ও কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে। অতি বিষণ্ণ হিলারি তার অবসর নেয়ার কথা সেদিন মুখফুটে বলেননি। নির্বাচনে পপুলার ভোট বেশি পাওয়ার কারণে নিজ দলে তার প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু যে প্রেসিডেন্টকে একসময় ক্রেজি এ্যান্ড্রু বলা হয়েছে তার কথা তো বলার লোভ স্মরণ করতে পারছি না। ॥ দুই ॥ ১৮২৮ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনে সপ্তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমন একজন নির্বাচিত হয়েছিলেন তাকে আজও ইতিহাসে একদিকে যেমন অভিহিত করা হয় একজন গ্রেট প্রেসিডেন্ট হিসেবে তেমনি অভিহিত করা হয় ক্রেজি এ্যান্ড্রু বলে। প্রতিদ্বন্দ্বী জন কুইন্সি এ্যাডামস এবং চ্যালেঞ্জার এ্যান্ড্রু জ্যাকসন এসেছিলেন সমাজের দুই বিপরীত প্রান্ত থেকে। এ্যাডামস দেশের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্টের উচ্চশিক্ষিত পুত্র এবং ইতিপূর্বে একজন কূটনীতিক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এ্যাডামসের সাফল্য অবিসংবাদিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতিকে তিনি প্রথম একটি আকৃতি প্রদান করেন। তিনি ব্যাপকভাবে নানা দেশে কাজ করেছিলেন। অন্যদিকে জ্যাকসন একসময় ছিলেন একজন অনাথ বালক। কথিত আছে যে, বিপ্লবী যুদ্ধের সময় ১৪ বছর বয়সে একজন ব্রিটিশ সৈন্যের বুট পরিষ্কার করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে একটি তলোয়ার দিয়ে পেটানো হয় এবং তার মুখে দাগ করে দেয়া হয়। সে কারণেই পরবর্তীকালে তিনি যথার্থ অর্থে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি ব্যক্তিগত যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। ১৮১২ সালের এই যুদ্ধে তিনি মেজর জেনারেল হন। নিউ অর্লিন্স যুদ্ধে প্রভূত সাফল্যের পর শুধু একজন প্রখ্যাত বীর নয় এ্যান্ড্রু জ্যাকসন হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় নায়ক। পরবর্তী সময়ে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করে হয়েছিলেন টেনেসি থেকে প্রথম সিনেটর ও ফ্লোরিডার প্রথম গবর্নর, ন্যাশভিল থেকে এ্যাটর্নি জেনারেল, হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ সদস্য এবং সিনেটর। ১৮২৪ এবং ১৮২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এই দু’জন। ঐতিহাসিকগণ একমত যে, তিনি ছিলেন আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কূটনীতিক। জ্যাকসন যুদ্ধক্ষেত্রে তার বীরত্বব্যঞ্জক অসাধারণ ভূমিকার জন্য প্রভূত সুনাম অর্জন করেছিলেন। বিপরীত প্রান্তের উভয় প্রার্থীর মধ্যে যে একমাত্র মিলটি ছিল সেটি জনসেবায় তাদের দীর্ঘ ক্যারিয়ার। কূটনীতিক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এ্যাডামস অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রধান প্রধান মার্কিন চুক্তিসমূহে মধ্যস্ততায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। চরিত্রের অমিল সত্ত্বেও আরও বড় মিলটি দেখা গিয়েছিল উভয়প্রার্থী ও তাদের শিবির পরস্পরের ব্যক্তিগত কেচ্ছাকাহিনীর উত্তেজক গল্প দিয়ে লড়েছিলেন প্রচারণায়। বছরটির ইলেকশন ক্যাম্পেইন ছিল পারস্পরিক ব্যক্তিগত আক্রমণের এক ব্যাপক প্রতিযোগিতা। প্রার্থী দুজনের বিরুদ্ধে খুন, ব্যভিচার, যৌনাচার, নারী কেনাসহ নানা অশ্লীল ও উৎকট অভিযোগ আনা হচ্ছিল নির্বাচনী বক্তৃতায়। যেগুলো মুদ্রিত হতে লাগল দলীয় সংবাদপত্রগুলোর পৃষ্ঠাজুড়ে। প্রায় দু’শ’ বছর পর এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা গেল ২০১৬ সালের নির্বাচনে। ১৮২৪ সালের নির্বাচনে উভয়প্রার্থীর মধ্যে কেউই ইলেক্টোরাল ভোট মেজরিটি পাননি। ফলে ইতিহাসের সেই একমাত্র নির্বাচনকে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে ছুড়ে দেয়া হয় এবং বিজয়ী ঘোষণা করা হয় জন কুইন্সি এ্যাডামসকে। এই বিতর্কিত নির্বাচনে সবার বিশ্বাস ছিল ফলাফলে এ্যাডামস অনুসারী হাউস স্পীকার হেনরি ক্লের যথেষ্ট প্রভাব খাটানো। পরবর্তীকালে যা পরিচিত হয়ে উঠল দুর্নীতিবাজ কেনাবেচা-‘দ্য করাপ্ট বার্গেইন’ নামে। এ্যাডামসের ১৮২৫ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকেই অতি সত্বর অগ্নিশর্মা জ্যাকসনের প্রচারণা শুরু হয়ে যায়। তিনি তাকে সম্বোধন করতে লাগলেন ‘ওল্ড হিকরি’ বলে। শুধু কথায় প্রতিপক্ষকে গালাগালি করে নয় সঙ্গে লাইন আপ করতে লাগলেন দেশের প্রায় সব সমর্থকদের। জ্যাকসনের প্রকৃতি প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দক্ষিণ এবং গ্রামীণ ভোটারদের মধ্যে ছিল অভূতপূর্ব প্রভাব। নর্থের ওয়ার্কিং ক্লাস মানুষদের ভেতর তার আপীল ছিল ম্যাজিকের মতো। এরপর থেকেই আকার নিতে থাকা দলীয় দ্বন্দ্ব পরবর্তী নির্বাচনে পেল পূর্ণাঙ্গরূপে। কংগ্রেস বার্ষিক বার্তায় জ্যাকসন বার বার ইলেক্টোরাল কলেজের বিলুপ্তির জন্য আহ্বান জানাতে থাকেন। অবশ্য সেটি আজও অক্ষুণœ আছে। ১৮২৪ সালে নির্বাচনে শক্তপোক্তভাবে দলীয় এ্যাফিলিয়েশনের মধ্য দিয়ে পার্টি দু’টিকে চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু এ্যাডামস তার প্রশাসনের সময় স্থিতাবস্থা দিয়ে নিজের পার্টিকে ‘ন্যাশনাল রিপাবলিকান’ বলা শুরু করলেন এবং বিরোধী জ্যাকসন শিবির তখন তাদের দলের নামকরণ করল ‘ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিকান’। পরবর্তীকালে যেটি সংক্ষিপ্ত আকারে হয়ে গেল ‘ডেমোক্র্যাটস’। এরপর থেকে চালু হয়ে গেল দেশে দুই পার্টি সিস্টেম ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান। যুদ্ধের নায়ক হওয়ার কারণে এ্যান্ড্রু জ্যাকসন হয়েছিলেন একজন জাতীয় নায়ক। কিন্তু যুদ্ধকালে তিনি নাকি নিজ দলের কিছু সৈন্যকে হত্যা করেন বলে কফিন বিল নামে পোস্টের ছাপানো হলো। এই সময় প্রকাশিত একটি পুস্তিকা নিজ স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করার জন্য জ্যাকসনকে অভিযুক্ত করে। প্রকৃত ঘটনা হলো জ্যাকসন যখন স্ত্রী রেচেলকে বিবাহ করেন তখন তার নাবালিকা অবস্থায় ইতিপূর্বে একটি বিবাহ ছিল। সেই বিবাহ থেকে একটি বিবাহবিচ্ছেদ করার জন্য আবেদন করেছিলেন, তিনি এবং তার হবু স্ত্রী। কিন্তু বিবাহের দু’বছর পর সেই আবেদন মঞ্জুর করা হয়নি- এ বিষয়ে তারা অবগত ছিলেন না। পরবর্তী সময়ে ডিভোর্স মঞ্জুর হলে তারা আবার বিবাহ করেন। বছর দুয়েক অন্য পুরুষের স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহিত ছিলেন এই কথা বলে তার বিরুদ্ধে এডাল্টারির অভিযোগ আনল প্রতিপক্ষ দল। তার বিরুদ্ধে ‘কফিন হ্যান্ডবিলস এ্যান্ড এডাল্টারি রিউমার্স’ নামে পোস্টার ছাপানো হলো। এটা নিয়ে জল ঘোলা করতে লাগল বাই পার্টিজান নিউজ পেপারগুলো। যুদ্ধকালীন সময়ের কাহিনী ও চল্লিশ বছর পূর্বের বিবাহ নিয়ে চলতে লাগল অকথ্য ক্যাম্পেন আক্রমণ। এ্যান্ড্রু ছাড়ার পাত্র নন। ক্রোধান্বিত পাল্টা আক্রমণ করলেন এই বলে যে, এ্যাডামস রাশিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত থাকার সময় জারকে ভেট হিসেবে দিয়েছিলেন একজন মার্কিন নারী। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক সাফল্য অর্জনের জন্য বহুবারই তিনি নারীকে ব্যবহার করেছেন। শেষমেশ ১৮২৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন এ্যান্ড্রু জ্যাকসন। স্ত্রী রেচেল পূর্বে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যুবরণ করলে বিষয়টি তিনি ক্ষমা করতে পারেননি। জ্যাকসন তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ওয়াশিংটনে পৌঁছে বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে গতানুগতিক সৌজন্য সাক্ষাত দিতে অস্বীকার করেছিলেন। আর পাল্টা জন কুইন্সি এ্যাডামস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে অস্বীকার করেন। প্রকৃতপক্ষে, ১৮২৮ সালের নির্বাচন তিক্ততা বিরাজিত ছিল বহু বছর ধরে। স্ত্রী বিয়োগের পর প্রেসিডেন্ট হয়ে এই চন্দ্রাহত মানুষ নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন যেন জাহান্নামে। গুপ্তঘাতক জন সি ক্যালহানকে শিরñেদ করার হুমকি দিতে কসুর করেননি। এরপর এ্যান্ড্রুর আমলে প্রায় দুই পৃথক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট বাসস্থান হোয়াইট হাউস ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল প্রায়। এসব নানাবিধ কীর্তি কলাপের মাধ্যমে তিনি ইতিহাসে নাম কিনেছেন ক্রেজি এ্যান্ড্রু হিসেবে। আর নিজের সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘আমি জন্মেছি ঝঞ্ঝার ভেতর, একটি শান্ত স্যুট আমাকে মানায় না।’ লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×