ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবার জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত কর্মশালা উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী

’৩০-এর আগেই প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২১ নভেম্বর ২০১৬

’৩০-এর আগেই প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের নেয়া বৈশ্বিক লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের অনেক আগেই বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিরাপদ ও সহজলভ্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে জানিয়ে বলেছেন, সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিতকরণসহ এসডিজি-৬ অর্জনে বাংলাদেশ যাতে বিশ্বব্যাপী অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বা রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে সে জন্য তার কৌশলপত্র প্রণয়ন করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, এমডিজির মতো এসডিজির ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য অর্জিত হবে। সরকার জনগণের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যেই যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে। আমরা শতভাগ মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে চাই। রবিবার প্রধানমন্ত্রীর তেজগাঁওস্থ কার্যালয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-৬) বাস্তবায়নে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)’র উদ্যোগে আয়োজিত ‘সবার জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা (এসডিজি-৬) : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক জাতীয় কর্মশালার উদ্বোধনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। জাতিসংঘের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পানি বিষয়ক প্যানেলের বিশেষ উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘের নেয়া বৈশ্বিক লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে। ২০৩০ সালের অনেক আগেই বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিরাপদ ও সহজলভ্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, তাঁর সরকার ইতোমধ্যেই ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানি, ওয়াটার সাপ্লাই এ্যান্ড সুয়ারেজ এ্যাক্ট-১৯৯৬, জাতীয় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন নীতিমালা (১৯৯৮) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (১৯৯৭) প্রণয়ন করেছে। সেই সঙ্গে পানি আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ‘ন্যাশনাল ওয়াটার সাপ্লাই এ্যান্ড স্যানিটেশন এ্যাক্ট-২০১৪’ প্রণয়ন করেছি। শতবর্ষের পরিবর্তনের গতি মাথায় রেখে পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ হচ্ছে- বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২০১০। তিনি বলেন, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে পানির গুরুত্ব বুঝতে পেরে জাতির পিতা ১৯৭২ সালে আন্তঃদেশীয় সীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যৌথ নদী কমিশন গঠন করেন। স্বাধীনতার পরই তিনি উপলব্ধি করেন, বাংলাদেশের সব ধরনের উন্নয়নের সঙ্গে নদ-নদী ও পানি সম্পদ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের সরকার ১৯৯৬ সালে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির মাধ্যমে ৩০ বছরের জন্য গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় এসেছে। উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগের পরিমাণ বর্তমানে ১ শতাংশের নিচে (দশমিক ৮৮) নেমে এসেছে। যা ২০০৩ সালেও ৪২ শতাংশ ছিল। এ বিষয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সময় ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যেই দুটি ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য আসবে। তিনি বলেন, কৃষিতে সেচ কিংবা শিল্পায়নসহ শহর উন্নয়নের কারণে পানির চাহিদা বেড়েই চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাবসহ বাংলাদেশে খরায় পানির সঙ্কট এবং বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা দুর্যোগে অঢেল পানির অপচয়ও হচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে শুকনো মৌসুমে এখনই পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, জাতির পিতার উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল- ‘উন্নয়ন হবে দেশীয় পদ্ধতিতে কিন্তু মান হবে আন্তর্জাতিক’। তাঁর দেখানো পথেই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আমরা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েছি। এক্ষেত্রে আমরা ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত পানির সংরক্ষণ ও ব্যবহার উপযোগী করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আইন ও বিধিবিধানের পরিবর্তন এবং সময় উপযোগী অসংখ্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড ভিত্তিক তৃণমূলের প্রান্তিক মানুষের কাছে এসব সুবিধা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বিশেষ শ্রেণীর জনগোষ্ঠী (শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে) কিংবা বিশেষ এলাকাভিত্তিক (লবণাক্ততা কিংবা আর্সেনিক যুক্ত এলাকা) বহুমুখী পরিকল্পনা নিয়ে নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশন সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দক্ষতা এবং দ্রুততার সঙ্গে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসডিজি-৬ বাস্তবায়নে ২০১৯ সালের মধ্যে ১১০টি উপজেলার ১ হাজার ২১৪টি ইউনিয়নকে আর্সেনিকমুক্ত ঘোষণার কার্যক্রম চলছে। লবণাক্ত পানিপ্রধান এলাকায় সাত হাজার পুকুরের পানি পরিশোধন করে লবণাক্তমুক্ত করা হয়েছে, ৩২ হাজার ৬০০ গভীর নলকূপ খনন করা হয়েছে ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ৪ হাজার ৭০০ জলাধার তৈরি করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনাসহ সব বিভাগীয় শহরের নিরাপদ পানি ভূ-উপরিস্থ পানি থেকে নিশ্চিত করার কার্যক্রম চলছে। শেখ হাসিনা বলেন, এমডিজিতে ৮৪ শতাংশ মানুষের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহের কথা থাকলেও আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৮৭ শতাংশ মানুষের মধ্যে তা সরবরাহ করেছি। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে ২৪০ কোটি লোক স্যানিটেশন সুবিধাবঞ্চিত। ৬৬ কোটি ৩০ লাখ লোক নিরাপদ পানি বঞ্চিত। নিরাপদ পানির অভাবে বিশ্বে বছরে ১০ লাখ মানুষ মারা যায়। যার অধিকাংশই শিশু। প্রতিদিন গড়ে বিশ্বে এক হাজার শিশু বিশুদ্ধ পানির অভাবে প্রাণ হারায়। তাই বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রধানমন্ত্রী তাঁর অবস্থান তুলে ধরেছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘গত ১৫ নবেম্বর মরক্কোর মারাকেশ শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের বক্তব্যে আমি জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে পানি ব্যবস্থাপনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন বিষয়ে পৃথক তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছি। জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বীর প্রতীক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। শুরুতে স্বাগত বক্তৃতায় ড. জাফর আহমেদ খান প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত আরোগ্য কামনা করে বলেন, ‘ব্যক্তিগত কারণে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হতে পারেননি।’ পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সামান্য ঠা-াজনিত অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি।’ ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ এবং আমার পক্ষ থেকে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। আমরা শোকাহত পরিবারগুলোর জন্য প্রার্থনা করছি।’ প্রধানমন্ত্রী নিহতদের বিদেহী আত্মার মুক্তি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। প্রসঙ্গত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর পাটনা ও ইনদোরের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনটি রবিবার ভোরে উত্তর প্রদেশে লাইনচ্যুত হলে ৯১ জন নিহত ও অনেকে আহত হয়েছেন। রেল কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে ভারতের সংবাদ মাধ্যম এ কথা জানায়। কানপুর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে পুখরাইয়ায় রেলের ১৪টি বগি লাইন থেকে ছিটকে গেছে বলে জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
×