ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চবির সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের সমাপ্তি

বাঁধভাঙ্গা আনন্দে উচ্ছ্বসিত সবাই, থাকল শুধু স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২১ নভেম্বর ২০১৬

বাঁধভাঙ্গা আনন্দে উচ্ছ্বসিত সবাই, থাকল শুধু স্মৃতি

রহমান শোয়েব, চবি ॥ এইতো, দু’দিন আগেও তোমাদের পদভারে মুখরিত হলো ক্যাম্পাস। তোমরা আসবে বলে কতই না আয়োজন। অনুজদের রাত জেগে আল্পনা আঁকা। তোমাদের কাছে পাওয়ার আকুতি। বিশ্ববিদ্যালয়ও সেজেছিল নিজের মতন করে। নিজেকে আলোকিত করেছিল রং-বেরঙের আলোয়। ব্যানারে ফেস্টুনে নিজেকে করেছিল আরেকটু আকর্ষণীয়। শুধু তোমরা আসবে বলে। তোমরা এলে। নিজেদের সবটুকু দিয়ে ভরিয়ে দিলে এই ক্যাম্পাসের হৃদয়। শনিবার সারাদিন তোমাদের বাঁধভাঙ্গা আনন্দ। এদিক সেদিক ছুটে বেড়ানো। নবীনদের মনে আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে গেল। তোমাদের পেয়ে উচ্ছ্বসিত তারা। দিনশেষে তোমরা চলে গেলে। পড়ে রইল তোমাদের স্মৃতি। বিভাগের সেই আলপনা, সেই বিভাগ, সেই হল, সেই কক্ষ। সব পড়ে রইল হুবহু। শুধু নেই তোমরা। বাস্তবতার কাছে হার মানল ভালবাসার বাঁধন। হুম, শনিবার ছিল চবির সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের শেষ দিনের উৎসব। শুক্রবার নগরীর অনুষ্ঠান শেষে এদিন সাবেকরা ছুটে এসেছিলেন শেকড়ের টানে। প্রাণের ক্যাম্পাসে আনন্দ উল্লাস করেছেন দিনব্যাপী। আর তাদের বরণে প্রতিটি বিভাগ নিয়েছিল নানা প্রস্তুতি। যেমন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। চবির জন্মদিন বলে কথা। তাই বিভাগটি চবির অর্ধশত জন্মদিন পালন করল কেক কেটে। আয়োজন করেছিল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার। যেখানে নবীন-প্রবীণরা মিলেমিশে হয়েছেন একাকার। এমনই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি বিভাগই নানাভাবে উদযাপন করে চবির জন্মদিন। নানা আয়োজনে বরণ করে নেয় বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীদের। শনিবার দিনব্যাপী চবি ক্যাম্পাস ছিল এক উৎসবের নগরী। এদিক সেদিক সাবেকরা ছুটে বেড়িয়ে গেছেন। হাতড়ে বেড়িয়েছেন পুরনো স্মৃতি। কেউ বা গেছেন হলের সেই কক্ষটিতে। যেখানে কাটিয়েছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কথা বলেছেন সেখানে অবস্থানরত বর্তমানদের সঙ্গে। কেউ বা পুরনো স্মৃতি মনে করে তলিয়ে গেছেন অতীতে, কেউ বা আবেগ সংবরণ করতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠেছেন। কতশত পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যে দেখা হলো। প্রাণের বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে কেউ খুশিতে আত্মহারা, কেউ বা কেঁদেই অস্থির। অনেকে এসেছিলেন বিদেশ থেকে। শুধু প্রাণের ক্যাম্পাসের জন্মদিন, সেই প্রিয় বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হবে বলে ছুটে এসেছেন। এমন সুযোগ তো আর খুব সহজে পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় সহপাঠীদের সঙ্গে যেমন বন্ধুত্ব হয়, তেমনি অনেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গেও হয়ে ওঠে আত্মার সম্পর্ক। অনেকেই ২০-৩০ বছর পরও ভুলতে পারেন না এসব প্রিয় মানুষদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের কর্মচারী মোঃ ইমাম হানিফের সঙ্গে দেখা করে গেছেন তেমনই একজন। নাম তার মোঃ ইদ্রিস। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেছেন আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে। মোঃ ইমাম হানিফ বলেন, ‘ইদ্রিস ভাই যখন এখানে পড়তেন তখন আমার সঙ্গে তার খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। খুব ভাল মানুষ ছিলেন তিনি। আমার বাসায়ও এসেছেন কয়েকবার। এত বছর পর এসেও তিনি আমাকে ভুলেননি। খুব ভাল লাগছে। প্রিয় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখেছেন। আমার সঙ্গেও দেখা করে গেছেন।’ এমনই ছোট ছোট হাজার হাজার গল্প তৈরি হয়েছে শনিবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার সকাল থেকেই দু’জোড়া শাটল ট্রেন পালাক্রমে রাত পৌনে বারোটা পর্যন্ত আসা যাওয়া করে। প্রিয় শাটলে গলা ছেড়ে গান গেয়ে প্রিয় ক্যাম্পাসে এসেছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসের ঝুপড়িগুলোতে আড্ডার ঝড় তুলেছিলেন তারা। খোঁজ নিয়েছেন একে অপরের। খুনসুটিতে মেতে উঠেছিলেন। প্রিয় ক্যাম্পাসে এসে আবার ফিরে গিয়েছেন সেই যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে। এখন হয়তো অনেকেরই চুলে পাক ধরেছে। শরীর দুর্বল হয়েছে। কিন্তু শনিবার সেসবের ধার ধারেননি কেউ। যৌবনের শক্তি এদিন ভর করে তাদের শরীরে। নবীনদেরও ছাড়িয়ে গেছেন কেউ কেউ। তেমনই একজন এ জেড এম সাহাবউদ্দিন। ছিলেন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী। সেটা ১৯৮১ সালের কথা। এখন চুলের অধিকাংশতেই পাক ধরেছে। কিন্তু তিনি দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। দেখা গেল নিজ বিভাগের সাবেক এবং বর্তমানদের মধ্যমণি তিনি। সেøাগান ধরেছেন ১৮ বছরের তরুণের মতো। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে বাকিরা। কিছুক্ষণ পরই তাকে খুঁজে পাওয়া গেল বাংলা বিভাগের বর্তমান কিছু শিক্ষার্থীদের মাঝে। তাকে ঘিরে রেখেছে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি সেøাগান ধরেছেন ‘কোন সে বিভাগ’ চারপাশে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীরা বাংলা বলে চিৎকার করে উঠছে। তিনি বলছেন ‘আরও জোরে’ শিক্ষার্থীরা তখন আরও জোরে চিৎকার করছে। কথা হল তার সঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘মানুষ মারা গেলে মৃত্যুর স্বাদ কেমন তা আর পড়ে বলবার বা বুঝবার সময় থাকে না। কিন্তু আমি আজ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে আমার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের স্বাদ ফিরে পেয়েছি। আমি আর জীবনে কিছুই চাই না।’ শনিবার দিনভর এমনই মিছিল, বাদ্য বাজনা, সেøাগানে সেøাগানে একেকটি বিভাগের শোভাযাত্র মিলিত হয়েছে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। নানা রঙের টি-শার্ট আর শাড়ি পরে ছেলেমেয়ের দল ঘুরে বেড়িয়েছে পুরো ক্যাম্পাস। সেলফি, আর ছবি তোলার মাঝে ছিল স্মৃতিকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। কেউ এসেছেন বন্ধুদের সঙ্গে কেউ বা এসেছেন পরিবার সমেত। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে চলে দিনভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উপভোগ করেন সাবেক বর্তমানসহ প্রায় অর্ধলক্ষ চবিয়ান। নেচে গেয়ে মাতিয়ে তোলেন পুরো চবি ক্যাম্পাস। দেশের খ্যাতিমান তিন ব্যান্ড আর্টসেল, লালন, ওয়ারফেজ মাতিয়ে রাখেন সবাইকে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের পরিবেশনাই মুগ্ধ করে সবাইকে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে প্রায় রাত ১০টা পর্যন্ত। ভাঙ্গে দু’দিনব্যাপী চবির সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ণাঢ্য আয়োজন। এবার যাবার পালা। কিন্তু তা কি এতটাই সহজ! বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেছিলেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ তাম্মিম মাহমুদ। সারাদিন কাটিয়েছেন পুরনো বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে। ছিলেন রাত পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে বসে উপভোগ করেছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যাওয়ার সময় বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম সেই সময়টা ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। বিশ্ববিদ্যালয়টা যে কতটা আপন তা এখন বুঝি। চলে যাচ্ছি, তাই বুকের বাঁ পাশটায় কেমন জানি ব্যথা করছে।’ বলেই হাঁটা শুরু করলেন। হয়তো চোখের অশ্রু আড়ালের চেষ্টা। শুধু তাম্মিমই নন। এভাবেই কষ্ট আড়াল করে ফিরে গেছেন হাজারো চবিয়ান। তোমরা গেলে চলে, রইল অনেক স্মৃতি।
×