ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

সবার মধ্যেই কি এক টুকরো ট্রাম্প জায়গা করে নিয়েছেন?

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২১ নভেম্বর ২০১৬

সবার মধ্যেই কি এক টুকরো ট্রাম্প জায়গা করে নিয়েছেন?

(গতকালের পর) ওবায়দুল কাদের বা তার পূর্বসূরি সৈয়দ আশরাফ আমাদের পরিচিত। আশরাফ তো ইতিহাসেরই ছাত্র। ও.কে বা ওবায়দুল কাদের আমার সমসাময়িক। হ্যাঁ, বন্ধুও বলা যেতে পারে। অবশ্য ক্ষমতাবানদের বন্ধু না ভাবলেই মঙ্গল। আশরাফ বা ওবায়দুল কী করেছেন না করেছেন তার মধ্যে আমি যাব না। কিন্তু তারা দু’জনই আওয়ামী লীগের সম্পাদক হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি দুই নেতাও সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। তারা যখন মন্ত্রী বা সাধারণ সম্পাদক হন তখন বয়স চল্লিশও হয়নি। ও. কে রা ৫৫ থেকে ৬০-এর মধ্যে এসব হয়েছেন অর্থাৎ তারা অনেক ম্যাচিউরড যখন ক্ষমতা ভোগ করেছেন। ওবায়দুল কাদের আরও ক্ষমতাবান বা সাধারণ সম্পাদক হওয়াতে আমরা অখুশি হইনি। ভেবেছি, কোন তদবিরে ফোন করলে হয়ত ফোন ধরতেও পারেন। ফোনে না পেয়ে দেখা করতে গেলে, নিশ্চয় পিএ এসে বলবেন না স্যার মিটিংয়ে আছেন বা রেস্টে আছেন। আমাদের তদবিরে কাজ হয় না জানি। হয়ওনি, কারণ বিনিময়ের কিছু থাকে না। কিন্তু, ঐ যে, যদি তদবির করতে পারি। ছোট মানুষদের আশা আর হবে কতটুকু? বঙ্গবন্ধুর আত্মস্মৃতি দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেটি আরেকবার পড়ে দেখুন তো এই দুই সম্পাদক কখনও মানুষের এ রকম আর্তনাদে সাড়া দিয়েছেন? ওবায়দুল কাদের সম্পাদক হয়ে বললেন, সব আবর্জনা, হাইব্রিড ঝেঁটিয়ে দূর করা হবে। আমাদের হাততালিতে চরাচর মুখর হয়ে উঠল। তিনি এরপর নোয়াখালীতে সংবর্ধনা নিলেন, লালদীঘিতে সংবর্ধনা নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘অনুপ্রবেশকারীদের বের করে দেয়া হবে। এ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। বসন্তের কোকিল আর মৌসুমি পাখির কোন স্থান আওয়ামী লীগে হবে না।’ [ জনকণ্ঠ ১৩-১১-২০১৬] সর্বশেষ খবর তিনি সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে বসেছেন। এই যে চেয়ারে বসলেন সেটিও খবর। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর এই হচ্ছে ওবায়দুল কাদেরের কার্যক্রম। আর একইভাবে মন্ত্রী ও সম্পাদক হওয়া বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীনকে দেখুন। যখন ও.কে’র সিডিউল এরকম তখন আরও ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জ বড় ঘটনা, যার অভিঘাত অনেক গভীর। ক্ষমতাবানদের বোঝার কথা নয়। বিএনপি-জামায়াতও বোঝেনি। এটি দুঃখী মানুষকে না দেখার না বোঝার একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ও.কে কি সেখানে তদন্ত কমিটি পাঠাননি? পাঠিয়েছেন, তারাও নেতা, কিন্তু কেউ তাদের চেনে না, দলে গুরুত্ব থাকলেও বাইরে নেই, পরিচিতিও নেই, মানুষের আস্থাও নেই। ওবায়দুল কাদের ঢের বেশি পরিচিত, তার ওপর আস্থা বেশি। আমিই কি লিখিনি তিনি আমার বন্ধু, ক্ষমতাবান হয়েছেন দেখে আমি গর্বিত। একটা প্রশ্ন রাখি যদি ওবায়দুল কাদের এই প্রবন্ধ পড়েন। তিনি দু’একজন নেতা বা মন্ত্রীর মধ্যে একজন যাকে আমি নিয়মিত বইয়ের দোকানে পেয়েছি, গাদা গাদা বই কেনেন ও পড়েন। এবং আওয়ামী লীগের কয়েকজন যারা নিয়মিত লেখেন যেমন এ.এম.এ মুহিত, মহীউদ্দীন খান আলমগীর প্রমুখ তাদের মতো নিয়মিত তারও বই বের হয়। তাই তাকে অন্যদের থেকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিই। প্রশ্নটা খানিকটা তাত্ত্বিক। আমাদের প্রধান বিচারপতি সরল মানুষ বোধহয়। সোজাসাপটা, মনের কথা বলে ফেলেন। তিনি একবার এজলাসে বলেই ফেললেন, তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। কিছুদিন আগে বললেন, ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নিতে হবে। তারপর বললেন, বিচারের আর প্রয়োজন কী? [যথাযথ উদ্ধৃতি নয়; টেলিভিশনের সংবাদ]। কিন্তু, আমার প্রশ্ন যদি পাকিস্তানী ও গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন শান্তি কমিটি জিতে যেত তিনি কি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হতে পারতেন? রাষ্ট্রের তিন নম্বর হতেন একজন মণিপুরি হয়ে? কিন্তু ৩০ লাখ শহীদ হলেন, ৫ লাখ নারী নির্যাতিত হলেন, পাকিস্তানী বিএনপি-জামায়াতকে হটিয়ে বাঙালী শেখ হাসিনা এলেন, তিনি প্রধান বিচারপতি হলেন। তিনি কেন বাঙালীদের প্রতি সন্তুষ্ট না? কেন তিনি বিচার চান না? কেন তিনি বলেন জায়গার অভাব কিন্তু সড়ক ভবনে হেয়ার কাটিং সেলুন, জিম, ব্যাংকোয়েট হল সরিয়ে জায়গা করে নেন না? ১৯৭১ থেকে তাহলে হেয়ার কাটিং সেলুন ইজ ইম্পর্টেন্ট। ওবায়দুল কাদেরকে প্রায় প্রতিদিন দেখেছি, তার অধীনস্থ অফিসগুলোতে দৌড়াচ্ছেন, রাস্তায় বেআইনী যান ধরছেন, পদ্মা সেতুর জন্য জানপ্রাণ দিচ্ছেন। তার এসব কর্মকা- দেখে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল বিদ্রƒপও করেছিলেন। কিন্তু, আমরা সত্যিই খুশি হয়েছি, যস্মিন দেশে যদাচার। কিন্তু দুটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী দুটি ঘটনা অবিচার ও বেইনসাফের ঘটনা, ঘটনাস্থলে না গিয়ে তিনি লালদীঘি বা নোয়াখালী গেলেন। একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছে রাস্তা কি মোর গুরুত্বপূর্ণ দেন দাঙ্গা হাঙ্গামা বা সন্ত্রাস? পড়ুয়া ও বন্ধু ওবায়দুল কাদেরের কাছে তাই থিয়োরেটিক্যাল প্রশ্ন, আমাদের সবার মধ্যেই কি এক টুকরো হেজাবি আছে? বা আজকের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সবার মধ্যে খানিকটা ট্রাম্প আছে? চামচা পুঁজি কি আমাদের সবাইকে ট্রাম্প বানিয়ে দিচ্ছে? ট্রাম্প এখন পৃথিবীর সমস্ত অশুভ শক্তির প্রতীকÑ সাম্প্রদায়িকতা, নারীবাজি, লুণ্ঠন, দখল, বর্ণবাদী, সন্ত্রাসে বিশ্বাসী। উত্তর না পেলে ক্ষতি নেই। কিন্তু ভাই ওবায়দুল কাদের, অভুক্ত যখন খাদ্য প্রত্যাখ্যান করে তখন তা চপেটাঘাতের মতো। মহাশক্তিধরের বিরুদ্ধে দুর্বল লড়াই করতে না পারে। থুতু ফেলতে তো পারে। সেই থুতু চিরদিন গায়ে লেগে থাকে। সাঁওতালরা অভুক্ত থেকেও খাবার ফিরিয়ে দিতে পারে। কারণ, ‘হুলে’র রক্ত তাদের শরীরে প্রবাহিত। সাঁওতালদের এই চপেটাঘাত বিচার করতে হবে এভাবে যেÑ দিন দিন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রান্তিক মানুষদের প্রতি অবিচার বাড়ছে। তাদের দিকে নজর দেয়া উচিত। দরকার হলে একটি মন্ত্রণালয়ে অসুবিধে কী? একজন দলীয় সম্পাদক হলেও বা ক্ষতি কী? ॥ ছয় ॥ ওবায়দুল কাদের বহুদিনের পরিচিত দেখে এ কথাগুলো বললাম। দুঃখের সঙ্গেই বললাম। ওবায়দুল কাদের তো জীবনে কম মার খাননি। সাধারণ সম্পাদক ছাড়া, প্রেসিডিয়ামে সিনিয়র নেতারা ছিলেন। উত্তরবঙ্গের নেতারা আছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা আছেন। সমাজে অর্থবান হিন্দু আছেন। কেউ নাসিরনগর গেলেন না? গোবিন্দগঞ্জ যেতে পারলেন না? বঙ্গবন্ধু নেতা থাকতে অন্য নেতারা কিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করেছেন। তাহলে, নিজ সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করার মতো অবস্থা তাদের নেই? ধিক এই সব হুঙ্কার দেয়া রাজনীতিবিদদের। শেখ হাসিনা এখন প্রধানমন্ত্রী। হুট করে কোথাও যেতে পারেন না, আমরাও তার কাছে যেতে পারি না। কিন্তু, ২০০১-০৬ সালে যখন তিনি বিরোধী দলের নেতা, আমি দেখেছি হাতকাটা, পা কাটা সাধারণ মানুষের দল সুধা সদনে ভিড় করে আছে। তিনি সবার সঙ্গে কথা বলছেন, সান্ত¡না দিচ্ছেন, সাহায্য দিচ্ছেন। যতটা সম্ভব এসব অঞ্চলে গিয়ে মানুষজনের মধ্যে সাহস ও আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। গ্রেনেড হামলার পরও একই অবস্থা দেখেছি। একটি ঘটনার কথা বলি। কয়েকদিন আগে আরেক আওয়ামী এমপি এক মুক্তিযোদ্ধাকে পেটালেন। খবর কাগজ, টিভিতে খবর। শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে নানকের দেখা হলে নানককে বললেন, প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য পাওয়া যাবে কি-না আলাপ করতে। নানক নিশ্চয়ই আলাপ করেছিলেন। না হলে পরদিন প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে এক লাখ টাকা কিভাবে পাঠানো হয় এবং প্রধানমন্ত্রী তার চিকিৎসার ভার নেন। প্রধানমন্ত্রী মানবিকতার দিক থেকে তার পিতার গুণাবলী পেয়েছেনÑ এ কথা স্বীকার্য। চার জাতীয় নেতার পুত্র-কন্যাদেরও তিনি মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। কিন্তু, প্রশ্ন হলো একজন প্রধানমন্ত্রী সমস্ত দলীয় এবং সরকারের কাজ তদারক করতে পারেন কিনা? সুপারম্যানের পক্ষেও সম্ভব নয়। সে জন্যই মন্ত্রিসভা এবং দলের প্রেসিডিয়াম ও কর্মপরিষদ। মানুষের মনে দু’ধরনের ধারণার জন্ম নিয়েছে। এ রিপোর্ট গোয়েন্দা সংস্থা দেবে না। পাবলিক সোর্স থেকেই জানাচ্ছিÑ ১. প্রধানমন্ত্রী চান না দল ও সরকারের কোন সিদ্ধান্ত তা যত ক্ষুদ্রই হোক কেউ নেন। ফলে সবাই সতর্ক থাকেন। যে কারণে যে গতিতে সরকার ও দল চলতে পারত সে গতি পাচ্ছে না, মুখে যে যত কথাই বলুক। ২. দলীয় নেতা বা মন্ত্রীরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে চান না। যদি প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হন। তাহলে পদ-পদবি, অর্থবান হওয়ার সিঁড়ি সব যাবে। তিনি নির্দেশ দিলে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন বা কাজ করবেন। সফল হলে তার কৃতিত্ব। বিফল হলে প্রধানমন্ত্রীর দায়। বলার অপেক্ষা রাখে না দু’ধারণাই ভাল নয়। প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন এ বিষয়ে এটি তারই এখতিয়ার। আমাদের জানানোর কথা তাই জানালাম। চলবে...
×