ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের সন্ধানে

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২১ নভেম্বর ২০১৬

শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের সন্ধানে

টানা দেড় বছর ধরে প্রার্থী মনোনয়ন ও প্রচার-প্রচারণা শেষে সদ্যসমাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এ নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত নির্বাচন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। এমনকি কারা নির্বাচন কমিশনার তাদের নামটি পর্যন্ত আলোচনায় আসেনি। সে দেশে নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও দৃশ্যমান ছিল না। চলতি বছরে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনের পাশাপাশি লোকসভার উপনির্বাচনও হয়েছে। সামনে আরও নির্বাচন হবে বিভিন্ন রাজ্যে। নির্বাচন কমিশনের রয়েছে শক্ত ভিত। সে দেশে কমিশন খুবই কম ছোটখাটো সমালোচনা বা অভিযোগের শিকার হয়েছে। ভারতের সংবিধানের ৩২৪ ধারার পূর্ণ ক্ষমতাবলেই নির্বাচনকালীন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার পুরো সময়টাতে কমিশন যে চালকের অবস্থানে থাকে, তা নীতিগতভাবে মেনে নিতে বাধ্য হয় রাজনৈতিক দল ও সরকার। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় কমিশনের কার্যকলাপ নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। চলতি বছরও নয়। নির্বাচন সময়কালে বদলি, পদোন্নতি, নিয়োগের বিষয়গুলোতে কমিশনের মতামত যেমন নিতে হয়, তেমনি কমিশন স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে যে কোন কর্মকর্তাকে বদলি করতে পারেন। তাই দেখা গেছে, গত লোকসভা নির্বাচনের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধানের নিয়োগের ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছিল কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী। নির্বাচন শেষে কমিশনের সম্মতির পর ওই নিয়োগ দেয়া হয়। আবার অনেক দেশে নির্বাচন পরিচালনায় কমিশনের তেমন ভূমিকারই দরকার হয় না। অনেক গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচনকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকে। যেটা ভারতে দেখা যায়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। বাংলাদেশেরও নিজস্ব পদ্ধতি তৈরি হয়েছে, যা আগে ছিল না। এ দেশের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচনকালীন কমিশনের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে ভারতের মতোই। তবে অনেক ক্ষেত্রে কমিশন দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পারে না। ভারতে নির্বাচন কমিশনের অন্য শরিক যারা তারা সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যেমন বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক দল। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের অবস্থান থাকলেও শরিক হিসেবে সহায়তা সব সময় মেলে না। ভারতে বিচার বিভাগ প্রধান সহযোগিতার ভূমিকা পালন করে থাকলেও এদেশে তেমন ভূমিকায় দেখা যায় না। ভারতে কমিশন লোকসভা ও বিধান সভার নির্বাচন পরিচালনা করলেও স্থানীয় পর্যায়ের পৌরসভা, গ্রামপঞ্চায়েত নির্বাচনে কেন্দ্রীয় কমিশনের কোন ভূমিকা নেই। রাজ্যের কমিশন এ দায়িত্ব পালন করে আসছে। তারপরও তাদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠে না। এরাও স্বাধীনভাবে সংবিধানের আওতায় গঠিত। পাকিস্তান নামক ‘ঘৃণিত’ রাষ্ট্রটির নির্বাচন কমিশন নিয়েও প্রশ্ন তেমন নেই। যে কারণে ১৯৭০ সালে সামরিক জান্তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কমিশন তার স্বচ্ছতা, পক্ষপাতহীনতা বজায় রাখতে পেরেছিল। যে নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে আপত্তি ছিল সামরিক জান্তা শাসক ইয়াহিয়া খানের। বিপরীতে গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি আরোপিত করা হয়েছিল বাংলার মানুষের ওপর। পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলেও দু’একটি আসনের নির্বাচন নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে। যার মধ্যে পরবর্তীকালে খুনীতে পরিণত খন্দকার মোশ্তাকের বিজয়ী হওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছিল। তবে নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত এগারোটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে ১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালের নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তা জিয়া, এরশাদ নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটোতে পরিণত করেছিল। কমিশনকে তারা নিজেদের বশংবদ বানিয়েছিল। যে কারণে ১৯৭৭ সালে জিয়া তার দখল করা ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য গণভোটের আয়োজন করেছিল। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নামমাত্র হলেও জিয়ার পক্ষে ৯৯ শতাংশ ভোট দেখানো হয়। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাঙালী কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেনÑ ‘যদি নির্বাচন হয়, তাহলে আমিও দাঁড়াব ইনশাআল্লাহ।’ সে নির্বাচনকে নির্বাচন বলা যায় কি-না সন্দেহ। ভোটে যে প্রার্থীই বিজয়ী হোক না কেন, জান্তা শাসক মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে বেতার টিভিতে ফল ঘোষণা করে একচেটিয়া নিজেদের বিজয় ঘোষণা করে। অন্যান্য দলকে নামমাত্র আসন বণ্টন করা হয়। ভাত্ততাবাজির সেই নির্বাচনের মাধ্যমে জান্তা শাসক জিয়া নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছিলেন। সেই পঙ্গু কমিশন আর সহজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। তাই ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এরশাদীয় নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাচন পদ্ধতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। আর ১৯৯১ সালে সামরিক ছাউনিতে জন্ম নেয়া বিএনপি নামক দলটি ক্ষমতায় এসে নির্বাচন কমিশনকে তাদের বশংবদ করে তুলেছিল। ভুয়া ভোটার তৈরি করে ভোট ব্যবস্থাকে প্রশ্নবোধক শুধু নয়, একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। তারা নিজেদের পছন্দমতো নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিল। আর কমিশন মাগুরা ও মিরপুরের উপনির্বাচনে যে ভূমিকা পালন করে, তাতে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে পড়ে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে জনমত যেমন গড়ে উঠেছিল, তেমনি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিটিও সামনে আসে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সাংবিধানিক উপায়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে। রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গে আলোচনা করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী কমিশন জাতিকে উপহার দেন। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির আদেশও একটা আইন। সাংবিধানিক পদধারী সার্চ কমিটির সদস্যরা কমিশনার মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। কমিটির প্রত্যেকেই ওই পদে বসার আগে সংবিধানের অধীনে শপথ নেন। মনোনীতদের থেকে রাষ্ট্রপতি বাছাই করে কমিশনারদের নিয়োগ দেন। সাংবিধানিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন গতবার। আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তার আগে তারা কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন এবং জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে যাচ্ছেন। নয়া নির্বাচন কমিশন কিভাবে গঠিত হবে সে নিয়ে আবার বিতর্ক তুলেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়া বিএনপি-জামায়াত জোট যে প্রস্তাব রেখেছে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। অথচ এই জোট তাদের শাসনামলে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিয়ে যেসব কা-কারখানা করেছিলেন, তা দেশের মানুষ আজও ভোলেনি। বিচারপতি রউফ, সচিব একেএম সাদেক কিংবা রঙ্গরসে ভরপুর বিচারপতি আবদুল আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে খালেদা-নিজামীরা নির্বাচন কমিশনকে বিধ্বস্তপ্রায় করে তুলেছিলেন। ভুয়া ভোটার বানিয়েছিল কোটিখানেকের বেশি। ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের অনির্বাচিত সরকার এসব ভুয়া ভোটার চিহ্নিত করে নতুন করে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন, যা নিয়ে খালেদা-নিজামীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। আন্দোলনের মুখে আজিজ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের অনেক ক্ষমতা, ভারতের মতোই। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ইউপি নির্বাচন পরিচালনায়। নির্বাচনী ব্যবস্থার সহায়ক শক্তিগুলো নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করেছে বলা যাবে না। নির্বাচনী ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদাররা সচল হলে এবং সহায়ক হিসেবে সহায়তা করলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে কোন অন্তরায়ই থাকে না। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্বাচন কমিশনে কমিশনার নিয়োগ দেয়ায় নির্দেশনা থাকার পরও বিএনপি-জামায়াত নেত্রী সংবিধানবিরোধী যে তেরো দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, তা স্ববিরোধী এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দেশকে আবার পশ্চাতে ফিরিয়ে নিতে শুধু নয়, যুদ্ধাপরাধী ও নিবন্ধনহীন দল জামায়াতকে সুবিধাদান এবং সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিকীকরণের লক্ষ্যে তার এ প্রস্তাব। খালেদা জিয়া স্বাধীনতা পরবর্তী সব দলকে নিয়ে আলোচনার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা দুরভিসন্ধিমূলক। পঁচাত্তর পরবর্তী জান্তা শাসক জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ, ইসলামী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ইত্যাদি দলকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত শুধু নয়, সংসদে আসনও দেন। আর বেগম জিয়া তো বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত শক্তি ফ্রিডম পার্টি, প্রগশ, ডেমোক্র্যাটিক লীগকে রাজনীতিতে আশ্রয়-প্রশ্রয় শুধু নয়, সংসদে আসনও দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী সংগঠন হিসেবে মত দিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও রয়েছে। এ অবস্থায় তাদেরসহ ফ্রিডম পার্টিকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে বৈধতা দান করতে চান। খালেদা প্রমাণ করলেন তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষে আছেন এবং এ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন আবারও। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে খালেদা নিজেই সম্ভাব্য আলোচনার পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছেন। পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নির্বাচনকালে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাবের মাধ্যমে দেশে সামরিকতন্ত্র চালু করতে চান। সব পরিস্থিতিতেই সেনাবাহিনী বা অন্য কোন বাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা সংবিধান সম্মত নয়। কোন গণতান্ত্রিক দেশে এ বিচারিক ক্ষমতা থাকতে পারে না। দেশকে আবার সামরিকতন্ত্রের অধীনে নেয়ার খালেদার প্রচেষ্টা পুরনো। জনগণ সামরিক শাসন চায় না। সংবিধানেও এর বিরুদ্ধে অবস্থান রয়েছে। নব্বইয়ের আন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক শাসন অবসানের পর প্রথম ক্ষমতায় আসা দল বিএনপি যে গণতন্ত্রবিরোধীÑ সেটা এই প্রস্তাবগুলোর মাধ্যমে প্রমাণ হয়। বিএনপির উচিত বাস্তবতা মেনে প্রস্তাব রাখা। আর দু’বছর পর সংসদ নির্বাচন। তার আগে বিএনপি-জামায়াতকে ছেড়ে গণতন্ত্রের পথ ধরবেÑ এমন আশা বাতুলতা হলেও দেশবাসী জামায়াত মুক্ত বিএনপি চায়।
×