ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মানবতা ও সম্প্রীতির সম্মেলন বকুলতলায়

বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি,/বারে বারে হেলিস নে ভাই...

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২০ নভেম্বর ২০১৬

বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি,/বারে বারে হেলিস নে ভাই...

মোরসালিন মিজান ॥ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পাওয়া বাংলাদেশ। বহু বীর যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছেন। হায়! আজ কী ফল হলো? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রীতিমতো হুমকির মুখে। সকল ধর্ম-বর্ণ, মত-পথের মানুষ মিলে মিশে কাটানোর স্বপ্ন যেন পরাস্ত হতে চলেছে। অনেকেই হতাশ। বেদনায় নীল। এ অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর সচেতন আহ্বান নিয়ে সামনে আসল জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ। শনিবার পরিষদের উদ্যোগে চারুকলার বকুলতলায় আয়োজন করা হয় মানবতা ও সম্প্রীতির সম্মেলন। চমৎকার পরিশিলীত আয়োজন। সান্ধ্য আয়োজন থেকে গান, কথা ও কবিতায় মানুষের জয়গান করা হয়। সকল সংকীর্ণতা ভুলে অসাম্প্রদায়িক বাঙালী হওয়ার আহ্বান জানান শিল্পীরা। সম্মিলন পরিষদ বহুদিনের পুরনো প্ল্যাটফর্ম। সাড়ে তিন দশক ধরে আপন সংস্কৃতির চর্চা করে আসছে। বাঙালী মানস গঠন ও জাগরণে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এখনও অব্যাহত। সেই ধারাবাহিকতায় খোলা মঞ্চে এসে গান শুনানো। কথা কবিতা। শুরুটা হয় সম্মেলক গানে। প্রায় ৩০ জন শিল্পী আগেই বসেছিলেন হাঁটু ভাজ করে। যন্ত্রী মিলিয়ে ৩৬ জনের মতো। বর্তমান বাস্তবতায় করণীয় কী? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতেই যেন শিল্পীরা গেয়ে যান- বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই...। কবিগুরুর অমর বাণী আরও সত্য আরও সমকালীন শোনায় শিল্পীদের কণ্ঠে। অপশক্তির বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তারা। পরের গানে আরও জোরালো হয় বক্তব্য। শিল্পীরা দৃঢ় কণ্ঠেই উচ্চারণ করেন- আমি ভয় করব না ভয় করব না।/ দু’ বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না...। খুব নীরবে বসে গান শুনতে থাকা শ্রোতার রক্তে গানটি কেমন যেন দোলা দিয়ে যায়। যারা শুনছিলেন তাদের চোখের ভাষা সে কথা বলছিল। মঞ্চের সামনে থেকে, পাশে থেকে শোনা যাচ্ছিল আরও কণ্ঠ। এভাবে প্রতিবাদী চেতনা জাগিয়ে দেয়ার প্রয়াস নেন শিল্পীরা। আর তারপর মঞ্চে উঠে আসেন সন্জিদা খাতুন। বাঙালী সংস্কৃতির পক্ষে সারা জীবন লড়ে যাওয়া অহর্নিশ সংগ্রামী তিনি। এখন নিজেই প্রতিষ্ঠান। সম্মিলন পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। অলঙ্কার হিসেবে নয়। এখনও সব নিজে দেখেন। দেখার চেষ্টা করেন। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় তাঁকে এদিন ব্যথিত মনে হলো। তবে সাহস ধরে রেখেছেন সব সময়ের মতোই। অনেকদিন পর ভক্তদের সামনে এসে তিনি বললেন, সাহিত্য সঙ্গীত নৃত্যকলা চিত্রকলা ভাস্কর্য সবই আমাদের কাছে প্রিয়। কারণ এইসব জিনিস অন্তরে প্রীতি সঞ্চার করে। এই প্রীতি আমাদের বড্ড দরকার। পাশের মানুষটিকে ভালবাসাবার জন্য দরকার। মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেবার জন্য প্রীতি প্রয়োজনীয়। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ এই শাশ্বত সত্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ চিরন্তন সত্যের উপরে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। আরও একটু ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ এ পৃথিবীকে হিংসায় উন্মত্ত দেখতে চাননি। মানুষকে নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত দেখতে চেয়েছেন। তার চারপাশের সকল মানুষ, শিল্পী সাহিত্যিককে মানবতার পুণ্যক্ষেত্রে মিলিত করতে চেয়েছেন। এ আহ্বান শুধু বাঙালীর জন্য নয়। পূর্ব আর পশ্চিমের বন্ধু সঙ্গমের ডাকও দিয়েছেন তিনি। পবিত্র বিশ্ব সমাজ গড়ার সে ডাক। উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেনÑ চল যাই কাজে, মানবসমাজে চলো বাহিরিয়া জগতের মাঝে। ওই আহ্বান কানে নিয়েই আমরা সম্মিলন পরিষদ প্রাঙ্গণে একত্র হয়েছি। জেনেছি, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি না থাকলে পৃথিবী বাসযোগ্য হতে পারে না। পরিষদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে তিনি বলেন, ক্ষমতার লড়াইতে আমাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। পরস্পরের অন্তরের সুপ্ত মনুষ্যত্বের বোধকে উদ্দীপ্ত করে শান্তির পরিবেশ গড়ে তুলতে চাই। আমরা জানি সকল ধর্মের মূল লক্ষ্যও তাই। অথচ ধর্মের নামে হিংসা করে হত্যা করে কোন্ মানবধর্ম পালন করছি আমরা? ধর্মগুরুরা তো এমন পথ দেখিয়ে যাননি পৃথিবীকে। আমাদের হজরত কি শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন, আর আমরা তার কতটুকু প্রতিপালন করেছি? কথার এ পর্যায়ে নজরুল থেকে গেয়ে শোনান শিল্পী বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী। তার কণ্ঠে সনজীদা খাতুনের কথার প্রতিধ্বনি। শিল্পী গেয়ে যান- তুমি বলেছিলে ধরণীতে সবে সমান পুত্র পুত্র-বৎ/প্রভু তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি ক’রে/ আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে/ ভিন্ ধর্মীর পূজা-মন্দির, ভাঙিতে আদেশ দাওনি, হে বীর,/প্রভু আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারিনে’ক পর-মত...। একক পরিবেশনা শেষ হলে আবারও কথায় ফেরেন সন্জীদা খাতুন। বলেন, জাতি বিরোধ নিয়েও নজরুল গান লিখেছিলেন, জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া। লালনও বলেছেন, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন কয় জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে..। তিনি বলেন, মানুষকে শান্তি আর সম্প্রীতির পথে মতি দেবার জন্য কবিতা গান নাটক নিয়ে জন সমাজের কাছে যেতে হবে। সংস্কৃতির জন্য সংস্কৃতি নয়, মনুষ্যত্বের উজ্জীবনের জন্য দায় নিতে হবে পরিষদকে। সনজীদা খাতুন মঞ্চ থেকে বিদায় নেয়ার পর কণ্ঠে গান তুলেন প্রবীণ শিল্পী ফাহমিদা খাতুন। তার কণ্ঠে ছিল ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে যখন আপনি’ গানটি। পরের পরিবেশনা নিয়ে আসেন বুলবুল ইসলাম। তার কণ্ঠে ছিল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে...। লাইসা আহমেদ লিসার কণ্ঠে ছিল ‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক।’ অনুষ্ঠানে কবিতায় প্রতিবাদ করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। শামসুর রাহমানের অমর কবিতা থেকে তিনি উচ্চারণ করেন- আমাদের বুকের ভেতরে যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছে সেঁটে/মগজের কোষে কোষে যারা পুঁতেছিলো আমাদের আপনজনের লাশ- দগ্ধ, রক্তাপ্লুত/যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে/আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়ে অধিক পশু সেই পশুদের...। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন পরিষদের সদস্য ডা. সারওয়ার আলী ও মফিদুল হক। সম্প্রীতির আহ্বান জানান তারাও। এভাবে গান কথা কবিতায় সুন্দর একটি আয়োজন। সাহস যোগানোর প্রয়াস। আহা, কী যে প্রয়োজন ছিল!
×