ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অবাধে বিক্রি হচ্ছে

৫৬ শতাংশ কাজ করছে না ॥ এ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২০ নভেম্বর ২০১৬

৫৬ শতাংশ কাজ করছে না ॥ এ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ যথেচ্ছ ব্যবহারে কার্যকারিতা হারাচ্ছে এ্যান্টিবায়োটিক। প্রায় ৫৬ শতাংশ এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কাজ করছে না। রোগীদের দেহে এ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা বেড়েছে। জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রথাগত এ্যান্টিবায়োটিক কাজে আসছে না। ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার রোধে কার্যকর সরকারী উদ্যোগ নেই। ওষুধের এমন প্রতিরোধী প্রবণতা বৃদ্ধিতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এটি মানুষ ও পশুস্বাস্থ্য এবং কৃষি সেক্টরের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশুখাদ্যের জন্য ব্যবহৃত প্রায় ৫০ প্রকারের এ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। প্রতিরোধী জীবাণু পরবর্তীতে পশু থেকে মানুষে স্থানান্তরিত হতে পারে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, চিকিৎসকদের পক্ষেও ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠার বিষয়টি নিয়মিত তদারকি করা সম্ভব হয় না। চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অবাদে ওষুধ বিক্রি করে থাকে ফার্মেসির লোকজন। অনেক সময় রোগী ও তাদের লোকজনও চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ ও সে অনুযায়ী ওষুধ কেনার প্রয়োজন অনুভব করেন না। ওষুধ প্রতিরোধী বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। অনেক চিকিৎসক ব্যবসায়িক স্বার্থে রোগীদের জন্য অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর রোগীরাও আস্থার সঙ্গে ব্যবহার করে যাচ্ছেন চিকিৎসকদের তালিকাভুক্ত ওষুধ। এতে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অনেক রোগী। ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞ চিকিৎসকরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জানান, এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত সমাদৃত এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে যার অবদান অবিস্মরণীয়। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, অপব্যবহারের কারণে এই এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ক্ষমতা কোন কোন জীবাণু ধ্বংসের ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশেও এ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কম নয়। মানুষ কোন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেই প্রাথমিকভাবে তার নিকটবর্তী দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেতে পারে। ওষুধ কিনতে কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবং ডাক্তারের কোন প্রেসক্রিপশন না লাগায় মানুষ সহজেই এ কাজটি করছে। এটি হচ্ছে জনসচেতনতার অভাবে। ফলে অপরিমিত ও মাত্রাহীন ওষুধ খাওয়ার ফলে এর জীবাণুনাশক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা রোধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে জানান অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক ডাঃ মাহমুদুর রহমান বলেন, এ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে চিকিৎসক ও রোগী উভয়কেই বিবেকবান হতে হবে। ফার্মেসিগুলো নিয়ন্ত্রণে না আসলে এবং জেনারেল প্র্যাক্টিশনার্স চিকিৎসকরা যতক্ষণ বিবেকবান না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। মেডিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত না হয়ে অপ্রয়োজনে এ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া ঠিক নয়। এ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ও ভুল ব্যবহারে প্রতিরোধী জীবাণুর উদ্ভব ঘটছে। এভাবে এ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারায়। প্রতিরোধী জীবাণুর কারণে কিছু এ্যান্টিবায়োটিক এখন অনেক ব্যাক্টিরিয়া প্রতিরোধে কাজে আসে না। সেজন্য একটি নবজাতক শিশুকেও অনেক সময় কয়েক প্রকারের এ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয় বলে জানান ডাঃ মাহমুদুর রহমান। প্রায় ৫৬ শতাংশ এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কাজ করছে না : গবেষণা প্রতিবেদন ॥ প্রায় ৫৬ শতাংশ এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কাজ করছে না। রোগীদের দেহে এ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা বেড়েছে। জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রথাগত এ্যান্টিবায়োটিক কাজে আসছে না। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের রোগীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। গত ২০১৫ সালের ১৪ নবেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত এ গবেষণার কাজ করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। দেশের সরকার স্বীকৃত গবেষণাগারে এসব পরীক্ষা করা হয় বলে জানায় পবা। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন হাসপাতালের ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে যে পরিমাণ এ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে তার অর্ধেকই ব্যবহৃত হয় গবাদিপশু উৎপাদনে, যা মানুষের জন্য ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বয়ে আনছে। আ ব ম ফারুক বলেন, অনেক কোম্পানি আছে যারা ফিস ফিড, ক্যাটেল ফিড, পোল্ট্রি ফিড তৈরি করার সময় এ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দিচ্ছে। সেখানে মানুষের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত এ্যান্টিবায়োটিক এবং পশুর চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট এ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দিচ্ছে। ফলে জীবাণুর শরীরে এ্যান্টিবায়োটিক রেজিটেন্স তৈরি হচ্ছে। খাবারের সঙ্গে এ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেয়া পশু মোটাতাজাকরণের সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে- এর উত্তরে আ ব ম ফারুক বলেন, কোম্পানিগুলো বলছে সামান্য পরিমাণ এ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেয়ার ফলে গরু, মুরগি, মাছ রোগমুক্ত থাকবে, তাদের সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে। এ বিষয়ের বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই। কিন্তু ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করে এ কাজটা করছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, সারাবিশ্বের খামারিরা সরল বিশ্বাসে এগুলো কিনে নিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ্যান্টিবায়োটিকের কোন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। যদি রোগ প্রতিরোধ করতে হয় তাহলে টিকা দিতে হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে নিচ্ছে। যার ফলে আমাদের শরীরে এ্যান্টিবায়োটিক রেজিটেন্স তৈরি হচ্ছে। এটা সারা পৃথিবীর সমস্যা কিন্তু বাংলাদেশে এর প্রভাব বেশি- সেটাই সমস্যা। আ ব ম ফারুক বলেন, যেসব পশুকে এ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে এবং সেই পশুর রক্তের সংস্পর্শে, পশুর সংস্পর্শে আমরা সংক্রমিত হতে পারি। আরেকটা বিষয় হলো যেসব পশুর শরীরে এ্যান্টিবায়োটিক রেজিটেন্স জীবাণু তৈরি হয়ে গেছে, তারা যে মল ত্যাগ করছে সেগুলো পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে অন্যান্য জীবাণুগুলো তাদের জিন ট্রান্সফারমেশন ঘটছে। এভাবে একটা মহামারি ব্যাপার নীরবে ঘটে যাচ্ছে কিন্তু আমরা টের পাচ্ছি না। আমরা সে কারণে বলছি- আমরা দুধ, মাছ, মাংস যাই খাই না কেন এগুলোর মধ্যে সামান্য পরিমাণে এ্যান্টিবায়োটিক চলে আসছে। এর ফলে প্রধান ঝুঁকিটা হলো আমরা ওই এ্যান্টিবায়োটিক রেজিটেন্স হয়ে যাই। এর ফলে সমস্যা হবে সাধারণ সমস্যাগুলো এ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে আর চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না। আমরা আশঙ্কা করছি একটা সময় আসবে আমরা যদি এ সমস্যাগুলো বন্ধ না করি তাহলে অতি সাধারণ সংক্রমণে মানুষ মারা যাবে।
×