ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইসি পুনর্গঠন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত;###;‘জামায়াতসহ পরাজিত শক্তির পুনরুজ্জীবনের কৌশলী ষড়যন্ত্র’

খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টির অপকৌশল

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২০ নভেম্বর ২০১৬

খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টির অপকৌশল

উত্তম চক্রবর্তী ॥ কৌশলে জামায়াতসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে রেখে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া উত্থাপিত ১৩ দফা প্রস্তাবে সুনির্দিষ্ট গঠনমূলক নতুন কিছুই নেই, বরং বিএনপি যে তাদের অতীত রাজনীতি থেকে একচুলও সরে আসেনি, তা আবারও জাতির সামনে স্পষ্ট হয়েছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, গুণগতভাবে একটি উপযুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবই খালেদা জিয়া দেননি। প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নির্বাচন কমিশন নিয়ে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবগুলোর বেশিরভাগই সম্পূর্ণ অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং নির্বাচনী আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। সমঝোতা বা ঐকমত্যে নয়, নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের টার্গেট থেকেই অনেক বিভ্রান্তমূলক এবং ইতোপূর্বে নিষ্পত্তিকৃত ইস্যুগুলো নতুন করে সামনে আনা হয়েছে বলেও তাঁরা মনে করছেন। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে সুকৌশলে জামায়াত-ফ্রিডম পার্টিসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে পুনরুত্থানের চেষ্টা এবং সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনৈতিক ঘোরপ্যাচে ফেলে বিতর্কিত করার অপচেষ্টার বিষয়ে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব মানুষ। তাঁদের মতে, খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে কিছু ভাল দিক থাকলেও বেশিরভাগই দূরভিসন্ধিমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অবাস্তবতাপূর্ণ এবং নির্বাচনী আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে নানা মহলেই এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে ঐকমত্যের নামে নির্বাচনকালীন সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি, রাজনীতির ঘোরপ্যাচে ফেলে সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করা এবং একাত্তরের পরাজিত যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী, বঙ্গবন্ধুর খুনীর দল ফ্রিডম পার্টিসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোকে হালাল করার ষড়যন্ত্রের ছাপও স্পষ্ট। যা সৃজনশীল, উন্নয়নমুখী ও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য। আলোচনা ও প্রতিক্রিয়ায় আরও উঠে এসেছে, সবার জন্য গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের পরিবর্তে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল এবং রাজনৈতিকভাবে পরিত্যক্ত ও অগ্রহণযোগ্য একটি গোষ্ঠীকে পুনরুত্থানের একটি কৌশলী প্রস্তাব বিএনপির পক্ষ থেকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। যা সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা বিনির্মাণের ক্ষেত্রে মোটেও সুখদায়ক নয়। অতীতের নির্বাচন বর্জন ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো ধ্বংসাত্মক ভুল রাজনীতি থেকে বিএনপি যে এখনও শিক্ষা নেয়নি, এটা নতুন করে জাতির সামনে উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, গুণগতভাবে একটি উপযুক্ত নির্বাচন কমিশন সৃষ্টির জন্য কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া করেননি। গতানুগতিক প্রস্তাবের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে পরিত্যক্ত ও অগ্রহণযোগ্য বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন। যা সৃজনশীল উন্নয়নমুখী আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, অবাস্তবতাপূর্ণ প্রস্তাব। যার অনেকগুলোই সংবিধান ও প্রচলিত আইনেরও পরিপন্থী। যেসব বিষয় আইন ও সংবিধানে ইতোমধ্যে নিষ্পত্তিকৃত, সেগুলোও খালেদা জিয়া পুনঃউচ্চারণ করেছেন, নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির এক অপচেষ্টা বলেও প্রতিভাত হয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে পরিত্যক্ত, অগ্রহণযোগ্য সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে নতুন করে পুনরুত্থানের একটি কৌশলগত প্রস্তাবও খালেদা জিয়া সামনে এনেছেন, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকও খালেদা জিয়ার উত্থাপিত ১৩ দফা প্রস্তাবের অনেক অংশের সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, প্রস্তাবে অনেকগুলো ভাল বিষয় আছে, আবার এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো অবাস্তব ও ভিত্তিহীন। প্রস্তাবে জামায়াত ও সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গগুলো আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। জামায়াতকে কোনভাবে আনা যাবে না। আর সেনাবাহিনী তার নিজের কাজ করবে। তাদের রাজনীতির মধ্যে আনতে হবে কেন? আমরা আলোচনা ও সমঝোতার কথা বলব। কিন্তু যে জামায়াতকে নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক, তাদের রাখতে হবে কেন? শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তাঁর এ প্রস্তাবে নির্বাচনকালে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা এবং সরাসরি নাম না বললেও পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জামায়াত, মুসলিম লীগ, ফ্রিডম পার্টির সম্পৃক্ততার কথা বোঝানো হয়েছে। নিবন্ধিত দল ছাড়াও প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হয়েছে। এমন প্রস্তাবকে ’৭৫ পরবর্র্তী অবৈধ সামরিক শাসনের সময়ে রাজনৈতিকভাবে পুনর্প্রতিষ্ঠা পাওয়া জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় রাখার খালেদা জিয়ার নতুন কৌশল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জোটবদ্ধ রাজনৈতিক মিত্ররা কোনভাবেই যে জামায়াতসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক ও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দলের সঙ্গে সংলাপ বা সমঝোতায় যাবে না, এটা নিশ্চিত জেনেই শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং সমঝোতার পরিবর্তে অতীতের মতো নির্বাচনকালীন সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট টার্গেট থেকেই হয়ত এ বিষয়গুলো নতুন করে সামনে আনা হয়েছে। জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রস্তাবে ঐকমত্যের কথা বলে নির্বাচনকালীন সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি, রাজনীতির ঘোরপ্যাচে ফেলে সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করা এবং একাত্তরের পরাজিত যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী, বঙ্গবন্ধুর খুনীর দল ফ্রিডম পার্টিসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোকে হালাল করার ষড়যন্ত্রের ছাপ স্পষ্ট। ’৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধ সামরিক শাসকরা যুদ্ধাপরাধী জামায়াত, মুসলিম লীগ, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দল ফ্রিডম পার্টিকে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে এনেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে পরিত্যক্ত এসব রাজনৈতিক দলকে পুনর্প্রতিষ্ঠা এবং লাইম লাইটে আনতেই খালেদা জিয়া এমন প্রস্তাব দিয়েছেন। যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। খালেদা জিয়ার দীর্ঘ প্রস্তাবের বেশিরভাগ অংশই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিভ্রান্তিকর। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার ১৩ দফা প্রস্তাবকে নাকচ করে বলেছে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে দেয়া প্রস্তাবের পুরোটাই চর্বিতচর্বণ ও আন্তঃসারশূন্য। দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ওইদিনই পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ৪৫ মিনিটের অন্তঃসারশূন্য বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে জনগণের ওপর তাঁর (খালেদা জিয়া) কোন আস্থা নেই। খালেদা জিয়ার ফর্মুলা অন্তঃসারশূন্য। তিনি জাতির সঙ্গে তামাশা করেছেন। তাঁর সংলাপের আহ্বানও হাস্যকর। উনি (খালেদা জিয়া) এমন কিছু প্রসঙ্গ এনেছেন, যা ইতোমধ্যেই আমাদের সংবিধান বা নির্বাচনী আইনে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন সম্পূর্ণ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। এক্ষেত্রে সংবিধান মেনেই সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিএনপি ও খালেদা জিয়া বিতর্ক সৃষ্টি করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা করছেন। এর পাল্টা জবাবে শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ তার প্রতিক্রিয়া আগেই তৈরি করে রেখেছিল। অর্থাৎ কোনরকম গণতান্ত্রিক পরিসর সৃষ্টি না করে, স্পেস না দিয়ে, জনগণের অধিকারগুলো কেড়ে নিয়ে আমাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। সেই কারণেই আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া আগেই তৈরি করে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। যদি আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে চায়- তবে এই প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্যে প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ মাহবুব-উল আলম হানিফ জনকণ্ঠকে বলেন, যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দলের সঙ্গে কেন আলোচনায় বসতে হবে? মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্যেই জাতির সামনে স্পষ্ট হয়েছে- এরা (বিএনপি) পাকিস্তানের পেতাত্মা, একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের দোসর। যারা এখনও এদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, একাত্তরের গণহত্যাকারী ও বঙ্গবন্ধুর খুনী- তাদের সঙ্গে সংলাপ তো দূরের কথা, এসব অপশক্তির কোন কথাই স্বাধীনতায় বিশ্বাসী জনগণ শুনতে চায় না। জনগণ থেকে প্রত্যাখ্যাত ও রাজনৈতিকভাবে পরিত্যক্ত জামায়াতসহ একাত্তরের পরাজিত অপশক্তির সঙ্গে কোন ধরনের সংলাপের প্রশ্নই উঠে না। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ নানা ইস্যুতে খালেদা জিয়ার উত্থাপিত প্রস্তাবকে আগামী নির্বাচনে নিজ দল তথা জোটের অংশ না নেয়ার কৌশলপত্র হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরীক ওয়ার্কার্স পার্টি। দলটির পলিট ব্যুরোর সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে খালেদা জিয়ার দল যে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- করেছে, তার পুনরাবৃত্তি করার সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত স্পষ্ট। কিন্তু দেশের জনগণ আর কোনদিনই তাদের সেই সুযোগ আর দেবে না।
×