ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিল্পাঞ্চল হবে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২০ নভেম্বর ২০১৬

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিল্পাঞ্চল হবে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ মূলত কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র এক অর্থনীতির দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে কম খরচের এক বিরাট শিল্পায়নের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি চলছে নগরায়নের ধারা। এর জনশক্তি বয়সে তরুণ। তাই এর সম্ভাবনা যেমন বিপুল, চ্যলেঞ্জও তেমনি তীব্র। বর্তমানে চীনে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। এখন প্রশ্ন ভবিষ্যতে কোন অঞ্চল হবে বিশ্বের শিল্পকেন্দ্র। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনা এ ক্ষেত্রে প্রশ্নাতীত। ২০৩০ সালে বিশ্বের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৪ ভাগের ১ ভাগ বাস করবে দক্ষিণ এশিয়ায়। এই অঞ্চলে মানুষের শিক্ষার হার বাড়ছে। প্রতি মাসে ১০ লাখ নতুন মুখ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এসব উপযোগী উপাদান থাকার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় শিল্প কারখানা গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে। এজন্য ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পাশাপাশি অবস্থানের সুযোগ নেয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির নতুন এ প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘সাউথ এশিয়াজ টার্ন : পলিসিজ টু বুস্ট কম্পিটিটিভনেস এ্যান্ড ক্রিয়েট দ্য নেক্সট এক্সপোর্ট পাওয়ারহাউস’। প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদন। চীনে উৎপাদন খরচ বাড়লে তার প্রভাব কী হবে, তা উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। চীনে পণ্য উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ বাড়লে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি প্রায় ৮ শতাংশ কমবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়বে, অর্থ মূল্যের দিক থেকে যার পরিমাণ প্রায় ৫২ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি বাড়বে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ বা প্রায় ৪২ কোটি ডলার। পাকিস্তানের বাড়বে ২৫ শতাংশ, যা প্রায় ৩৪ কোটি ডলারের সমান। তবে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার রফতানি আয় আরও বেশি হারে বাড়তে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুযায়ী বিগত বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়া পণ্য রফতানি আয়ে ভাল হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও বিশ্ববাজারের মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ দখলে আনতে পেরেছে। এর মধ্যে ভারতের অংশীদারিত্ব ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ নিয়ে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানসহ শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপের অংশ আরও কমেছে। কিছুটা বেড়েছে আফগানিস্তানের। বাংলাদেশ, নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা উচ্চমাত্রায় পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া ভুটান খনিজের ওপর এবং আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত এই অঞ্চলের রফতানি প্রবৃদ্ধির ৮০ শতাংশ এসেছে একই পণ্য ও একই বাজারে রফতানি করে। বাকি ২০ শতাংশ এসেছে একই পণ্য নতুন বাজারে বিক্রি করে। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান বড় হলে তার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। এই অঞ্চলের দেশগুলোতে ছোট ও মাঝারি কোম্পানির সংখ্যাই বেশি, এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ২৭ শতাংশের আকার বড়। অন্যদিকে ভারতের প্রায় ১৩ শতাংশ, পাকিস্তানের ১৬, ফিলিপিন্সের ১৩, ইন্দোনেশিয়ার ২, চীনের ১৩, ভিয়েতনামের ১৮ ও শ্রীলঙ্কার ৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের আকার বড়। বড় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অর্থ সংগ্রহ, ভাল কর্মী নিয়োগ, ঝুঁকি নেয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্ষমতা বেশি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। গবেষণা ও উন্নয়নে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের হার ভারত ও বাংলাদেশে বেশি। এমনকি এ হার পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর চেয়েও বেশি। বাংলাদেশে বড়, রফতানিমুখী, বিদেশী ও পুরনো কোম্পানিগুলোর মধ্যে গবেষণা ও উন্নয়নের প্রবণতা বেশি। ভারতের ৫৬ শতাংশ, বাংলাদেশের ১৯ শতাংশ, পাকিস্তানের ৬ শতাংশ, নেপালের ৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান গবেষণা উন্নয়নের চেষ্টা চালায় বলে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনের তথ্য। এখানে গবেষণা ও উন্নয়ন বলতে মূলত নতুন পণ্য বাজারে ছাড়া, মান বৃদ্ধি, উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে এ উন্নয়ন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনুকরণ করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। তবে উৎপাদন খরচের বাইরে এ দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা নেই। পণ্যের মান, লিড টাইম (ক্রয়াদেশ পাওয়ার পরে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেয়ার সময়), সামাজিক কমপ্লায়েন্স ও টেকসই- এসব ক্ষেত্রে চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়া বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। এক্ষেত্রে ভারত অবশ্য বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক সচল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারায় দ্রুত পথে এগিয়ে চলেছে। যার সুফল হিসেবে দ্রুত দারিদ্র্য মোচন ও জীবনের গড় আয়ু বেড়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ধারা চালু থাকায় আমাদের সামাজিক সংহতি অনেক দেশের চেয়ে ভাল। একমাত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। ইতোমধ্যে সরকারের প্রণিত রূপকল্প ২০২১ কে সামনে রেখে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোনগুলোকে সুচারুরূপে বাস্তবরূপ দান করবে প্রথম চ্যালেঞ্জ।
×