ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

সবার মধ্যেই কি এক টুকরো ট্রাম্প জায়গা করে নিয়েছেন?

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২০ নভেম্বর ২০১৬

সবার মধ্যেই কি এক টুকরো ট্রাম্প জায়গা করে নিয়েছেন?

(গতকালের পর) ॥ তিন ॥ নাসিরনগর থেকে গোবিন্দগঞ্জের ঘটনা আরও করুণ, মর্মান্তিক! সাঁওতালদের আমরা চিনি না। আগে বাংলায় সাঁওতাল পরগনা নামে একটি এলাকাই ছিল। এমনিতে তারা নিরীহ, নিজেদের মতো থাকেন। ১৮৫৫ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত নিজেদের মুক্তির জন্য তারা ‘হুল’ বা বিদ্রোহ করেছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। বিরাট অঞ্চল মুক্তও রেখেছিলেন দুই ভাই সিধো-কানহুর নেতৃত্বে। সেই সময় একটি গান গাওয়া হতো- “ও সিধো, সিধো ভাই, তোর কীসের তরে রক্ত ঝরে কী কথা রইল গাঁথা ও কান্হু তোর হুল হুল স্বরে দেশের লেগে অঙ্গে মোদের রক্তে রাঙ্গা বেশ জান না কি দম্য বণিক লুটলো সোনার দেশ।” পশ্চিমবঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে তাদের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। অথচ ইতিহাসের আমরা খোঁজ রাখি না। এমনকি ১৯৭১ সালের ইতিহাস জানি না কতটাই বা তার মনে আছে। কারণ, পাকিস্তানের মতো ইতিহাস এখানেও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। ১৯৭১ সালের প্রাথমিক প্রতিরোধে সাঁওতালরাও ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের অনেকে শহীদ হয়েছিলেন। গোবিন্দগঞ্জে মিল শ্রমিক, পুলিশ, আওয়ামী লীগের এমপির নেতৃত্বাধীন সহযোগী বাহিনী সাঁওতালদের ওপর যা করেছে তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার দরকার নেই। টিভি ও সংবাদপত্রে তা আমরা দেখেছি। তিনজন সাঁওতাল নিহত হয়েছেন। আহত অনেক। হাসপাতালে আহত সাঁওতালদের কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। জঙ্গীদের পুলিশ কিন্তু ‘হুজুর’ বলেন। এ ঘটনা ঘটেছে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক হলো। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ের দিনই বোধহয় গোবিন্দগঞ্জের ঘটনা ঘটে [নাকি নাসিরনগরের]। সপ্তাহখানেক পর আওয়ামী লীগের এক তদন্ত কমিটি নাসিরনগর যায়। গোবিন্দগঞ্জেও গিয়েছিল। নাসিরনগরে কয়েকজন মন্ত্রী পরে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। গত দু’সপ্তাহে নাসিরনগরের ঘটনায় পুলিশ অবশ্য জনা ৪০ কে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু আঁখির বা অন্য নেতাদের কিছু হয়নি। গোবিন্দগঞ্জ নিয়ে বিভিন্ন সমাজের লোকজন কথা বলছেন, ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন। না কোন মন্ত্রী সেখানে যাননি। লেফটিদেরও কেউ না। সাঁওতালরা আসন্ন শীতে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। খাওয়া নেই। ওষুধ নেই। চিনি কল কর্তৃপক্ষ সাঁওতালদের হটিয়ে দিয়ে সে জায়গায় কাঁটাতার দিচ্ছে। শিল্প সচিব ঘোষণা করেছেন, চিনি কলের জায়গা কাউকে দেয়া হবে না। অনেকদিন পর সরকারের তরফ থেকে ত্রাণ নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম আলোর রিপোর্টটি দেখুন- ‘গতকাল সোমবার সকালে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল হান্নান গাইবান্ধার এই উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নের মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে যান। দেড় শ’ পরিবারের প্রত্যেককে ২০ কেজি চাল, এক লিটার তেল, এক কেজি ডাল, এক কেজি আলু, এক কেজি লবণ ও দুটি করে কম্বল বিতরণের কথা ছিল। ইউএনও মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে ত্রাণ নেয়ার অনুরোধ জানালেও কেউ ত্রাণ নিতে রাজি হননি। সকাল থেকে মাদারপুর গির্জার সামনে ত্রাণ নিয়ে অপেক্ষা করে সন্ধ্যায় তিনি উপজেলা শহরে ফিরে আসেন। সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমিন বাস্কে মুঠোফোনে বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা প্রশাসনের কোনো ত্রাণ নেবেন না। তাঁরা বাপ-দাদার জমি ফেরত চান। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। ফিলিমিন বলেন, সাঁওতালদের নিহত হওয়া, বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনায় কোনো মামলা বা তদন্ত কমিটি পর্যন্ত হয়নি। উল্টো মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁদের হয়রানি করা হচ্ছে। [প্রথম আলো, ১৫.১১.২০১৬] জমি সাঁওতালদেরই ছিল। বলেছেন গবেষক আবুল বারকাত। তার গবেষণায় ভুল হওয়ার কথা নয়। আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে তিনি অনেকদিন গবেষণা করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেনÑ‘জমি যে সাঁওতালদেরই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কাগজে দেখা যায়, ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই একটা চুক্তির মাধ্যমে চার মৌজার ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। চুক্তিপত্রের ৫ ধারায় বলা আছে, চিনিকল এবং আখ চাষের জন্য জমি নেয়া হলো। যদি কখনো এ জমিতে এছাড়া (আখ চাষ ছাড়া) অন্য কিছু হয়, তাহলে এটা মূল মালিকদের ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু তার আগেই ২০০৪ সালে চিনিকল লে-অফ ঘোষণার পরে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীকে নামে-বেনামে এ জমি লিজ দেয়া হয়েছে। অধিগ্রহণের সময় ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বারকাত বলেন, অধিগ্রহণের সময় তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছিল এমন তথ্য তিনি এখনো কোনো কাগজে পাননি। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, অধিগ্রহণের শর্তই ছিল আখ চাষ না হলে জমি ফেরত দেয়া হবে। একই তথ্য দিয়ে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমিন বাস্কে বলেন, ১৯৪৮ সালের অধিগ্রহণ আইন অনুসারে যে চুক্তি হয় তাতে বলা হয়েছে, জমিতে আখ ছাড়া অন্য ফসলের চাষ হলে প্রকৃত মালিকদের জমি ফেরত দিতে হবে। কিন্তু ১ হাজার ৮৪২ একর জমির মধ্যে মাত্র ১০০ একর জমিতে আখ চাষ করা হচ্ছে। বাকি জমিতে ধান, তামাকসহ বিভিন্ন শস্য চাষ হচ্ছে। তাই তারা এখন জমি ফেরত চান। [ঐ] এলাকার সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগে আছেন। সাঁওতালরা জানিয়েছেন, সংসদ সদস্যকে নিয়েই তারা গত চার বছর জমি উদ্ধারের সংগ্রাম করছিলেন। এখন তিনি অন্য পক্ষে চলে গেছেন। পক্ষ মানুষ কখন বদলায়? ॥ চার ॥ ঢাকা শহরে ভূমিদস্যুদের কোন মন্ত্রী, কোন সচিব, কোন পুলিশ কিছু করতে পেরেছেন? তাদের সামনে হাত কচলানো ছাড়া? ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ছাড়া কাউকে তারা উচ্ছেদ করতে পেরেছেন? পেরেছেন অবৈধ জায়গা থেকে তুলে দিতে? কাওরানবাজার, গুলিস্তান থেকে পেরেছেন? কোন সচিব, কোন মন্ত্রী পেরেছেন ঢাকা শহরের বিত্তশালীদের অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে? কিন্তু, তারা সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দিয়ে সেই জমি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিতে পারেন। পাকিস্তান আমল বুঝলাম ঔপনিবেশিক শাসন ছিল। ১ হাজার ৮৪২ একর জমি থেকে তারা সাঁওতালদের উৎখাত করেছিল। ইক্ষু ফল তো এখানে কখনই লাভজনক হতো না। কলও তো বন্ধ। তা হলে সেই জমি কেন ফেরত দেয়া হবে না? শিল্প মন্ত্রণালয় চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেনি। অধিগ্রহণকৃত জমির একটি বড় অংশে অন্য ধরনের চাষাবাদ হচ্ছে। সেগুলো থেকে তো কাউকে উচ্ছেদ করা হলো না। ওদের টাকা আছে দেখে? ওদের রাজনৈতিক কানেকশন আছে দেখে? ওরা বাঙালী দেখে? ১৯৭১ সালের কথায় আবার একটু ফিরে যাই। জানি বিরক্ত হবেন। ইতিহাসে সবাই থাকতে চায়; কিন্তু ইতিহাস জানতে চায় না। ১৯৭১ সালে অনেক মন্ত্রীর বাবা-চাচা, আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির অনেক সদস্যের বাবা-চাচা, যারা এখন রাজনীতি মানে বোঝেন মস্তানবাজি, তাদের অনেকের বাবা-চাচা, সচিবদের অনেকের বাবা-চাচা যখন সহায়সম্পত্তি ফেলে শহর ছেড়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে পালাচ্ছিলেন তখন পথেই অনেকে মারা গেছেন। কন্যা-স্ত্রী ধর্ষিত হয়েছেন। যারা পালাতে পারছিলেন তাদের পিছে পাকি ও তাদের সহযোগীরা [বা জামায়াতীরা]। সামনে অনাত্মীয় সব গরিব। এই গরিব মানুষজন, এই প্রান্তিকজন, এই গরিব হিন্দু-মুসলমান, তাদের আশ্রয় দিয়েছেন নিজেদের তক্তপোষ ছেড়ে, প্রায় উপোস থেকে অতিথিদের খাইয়েছেন। কারণ অতিথি নারায়ণ। মুসলমান ধর্মে অতিথি অবধ্য। সেবা করেছেন। সীমান্ত পেরুতে সাহায্য করেছেন। এই গরিবরা থেকে গেছেন এবং প্রতিরোধ করেছেন। সব সময় তাই লিখেছি, বাংলাদেশ নির্মাণ করেছেন গরিবরা। এই রাষ্ট্রে তাদের হক বেশি। কিন্তু, গত ৪০ বছরে বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর সব দল/শাসক তা সিভিলিয়ান হোক আর আর্মি হোক গরিবদের হক মেরেছে। যাবতীয় লুটপাট করেছে। এ দেশে এখন ২০০০ কোটি টাকা লুট করলে ব্যাংক থেকে দুদক তাকে দেখে না। ১ কোটি টাকা করলে দেখে। ঋণখেলাপীর সংখ্যা কত? তাদের লুটের পরিমাণ কত? তাদের ঋণ অবলোপন করা হয়। আর প্রান্তিক হিন্দু-মুসলমান, সাঁওতালদের ন্যায্য জমি কেড়ে নেয়া হয়, হুমকি দেয়া হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে যদি আমাদের দেশের ইতিহাস ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে তা হচ্ছে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও আমলাদের লুটপাট এবং দখলের ইতিহাস। এসব রাজনীতিবিদের অনেককে আমরা স্মরণ করি ত্যাগী রাজনীতিবিদ হিসেবে। এই মিথ্যা ন্যারেটিভ রাজনৈতিক দলের তাদের অনুসারীরা তৈরি করে এবং তা ওরাল হিস্ট্রি বা আমাদের লেখা ‘নিরপেক্ষ’ ইতিহাসে স্থান পেয়ে যায়। এমন অনেক রাজনীতিবিদের কথা লিখতে পারি যারা জীবনের এক পর্যায়ে অন্যের ধন আত্মসাত করেছেন। এ মিথ্যা ন্যারেটিভ বা ইতিহাস বিকৃতি অবিচার কে স্বীকৃতি দিয়েছে, মানুষের মনে বিভ্রম তৈরি করেছে। তবে, এই দখলদাররা সমষ্টিগতভাবে সম্পদ ভোগ করেছে। রাষ্ট্রীয় অর্থ লুট করেছে। বৃহত্তর সমাজে কোন সম্মান পায়নি। এদের দু’একজন নেতা চলে এসেছেন বিবরণে। আবার এ দেশের ইতিহাস এ ধরনের দখল- বেইনসাফের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ লড়াইয়েরও ইতিহাস। সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই যদি ধরি সেই কৈবর্ত বিদ্রোহের, দিব্যক বা সাঁওতাল বিদ্রোহের সিধো বা বাঙালির বিদ্রোহের শেখ মুজিব। এরা অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায্য লড়াই করেছেন, সারাজীবন নির্যাতিত হয়েছেন এবং খুন হয়েছেন। এদের যারা অনুসারী তাদেরও সারাজীবন একইভাবে কেটেছে, হয়তো শেষ জীবনে খুন হননি। কিন্তু এই যে সমাজ, এগুলো, সে তো তাদের জন্যই। শিল্প-সাহিত্যের উন্নতি হলো তো এই প্রতিবাদ যারা করেছেন তাদের জন্য। লুটেরারা ভোগ করেছেন, প্রতিবাদীরা প্রগতির সংস্কৃতি নির্মাণ করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, ইতিহাস তাদেরই সৃষ্টি। ইতিহাসে বসুন্ধরা, যমুনা, বেক্সিমকোর কথা থাকবে না, হুঙ্কার দেয়া রাজনীতিকদের কথা থাকবে না, ধমকি দেয়া সচিবদের কথা থাকবে না। চলবে...
×