ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২০ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

তৃতীয় অধ্যায় ॥ বাগেরহাটে এক বছর (গতকালের পর) সহকারী জেলা প্রশাসক জমিরউদ্দিন আহমদ আমাকে আরও জানালেন যে, বাগেরহাটে বেশ কিছুদিন মহকুমা প্রশাসক এবং যথাসংখ্যক হাকিম না থাকায় আমাকে একটু বেশি কাজ করতে হতে পারে। বস্তুতপক্ষে বাগেরহাটে স্থানীয় উৎসাহ, আগ্রহ এবং উদ্যোগ আমাকে অনেক বড় মাপের কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। আমি বাগেরহাটে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র আইন বলবত হয় এবং তার অধীনে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও সভাপতি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমার মনে হয় ৪০০ সদস্য পদের জন্য অন্তত ৩ হাজার প্রার্থী নির্বাচন করেন এবং প্রত্যেক প্রার্থীকে ৫০ টাকা নিরাপত্তা জামানত দিতে হয়। আমি বাগেরহাটে পৌঁছেই বাগেরহাট এলাকা সম্বন্ধে বিশেষভাবে জানবার উদ্দেশ্যে জেলা গ্যাজেটিয়ারের শরণাপন্ন হই। এছাড়া ২-৪টা বইয়ে সে সম্বন্ধে কিছু জানতে পারি। সম্রাট আকবরের সেনাপতি খানজাহান আলী বাগেরহাটে এসে রাজকার্য ছেড়ে দিয়ে ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করেন। বিরাট ষাটগম্বুজ মসজিদ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পর অনতিদূরে তার মাজার গড়ে ওঠে। তিনি ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট সফল হন। ১৮৫৪ সালে যশোর জেলার অধীনে খুলনা হয় ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহকুমা। সম্ভবত ১৮৬০ সালে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাগেরহাটে হাকিম নিযুক্ত হন এবং তিনি যে বাড়িতে আদালত ও বসবাস দুটিই করতেন সেই দ্বিতল বাড়িটি ছিল আমার সময়ে মহকুমা হাকিমের (এসডিও) আদালত ও দফতর। বাগেরহাট ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে মোটেই জনবহুল এলাকা ছিল না। মুঘল আমলে এলাকাটি ছিল বরিশাল জেলার অংশ। বরিশাল জেলায় ছিল বর্তমানের বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, বাগেরহাট, খুলনা এবং সাতক্ষীরা। ব্রিটিশ আমলে বরিশাল ও যশোর হলো দুটি জেলা। এই আমলেই খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট মহকুমা হয়। বরিশাল ও ভোলা ছিল লাঠিয়াল ও দুর্ধর্ষ লোকজনের অঞ্চল। বাগেরহাট এলাকায় বসতি বৃদ্ধির জন্য এসব দুর্ধর্ষ লোকজনের প্রয়োজন হয়। ক্যাপ্টেন মোরেল এদের ডেকে এনে মোরেলগঞ্জে বসতি বৃদ্ধি করে। রামপাল ও শরণখোলাও দুর্ধর্ষ জনগণই আবাদ করে। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাংলা প্রেসিডেন্সি ও পাঞ্জাব প্রদেশ বিভক্ত হয়। তখন খুলনা জেলা হয় ভারতের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম বাংলার একটি জেলা এবং মুর্শিদাবাদ হয় পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব বাংলার অংশ। কিন্তু র‌্যাডক্লিফ সীমানা কমিশন যখন পূর্বাঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করল তখন খুলনা হলো পাকিস্তানের অংশ এবং মুর্শিদাবাদ হলো ভারতের অংশ। এই দুই জেলার কর্মচারীবৃন্দকে তাদের কর্মস্থল পছন্দের সুযোগ দেয়া হয়। অন্যত্র এই সুযোগটি শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের দেয়া হয়। সে কারণে খুলনায় প্রচুর মুর্শিদাবাদী লোকজন হিজরত করে। তাদের অনেকেই বাগেরহাটে বসতি স্থাপন করে। তাই বাগেরহাটে ছিল প্রভাবশালী হিন্দু জনগণ, বাগেরহাটের আদি মুসলমান বাসিন্দা এবং মুর্শিদাবাদী এক বড় গোষ্ঠী। আমার ব্যক্তিগত সহকারী ছিল নুরুল ইসলাম ও পেশকার ছিল এনায়েত হোসেন এবং এরা দু’জনই ছিল মুর্শিদাবাদী। আমার জমাদারও ছিল মুর্শিদাবাদী। আমার নাজির সইলুদ্দিন ছিল বাগেরহাটের মানুষ, আমার পিয়ন রামও ছিল বাগেরহাটের সন্তান। তারা বেশ ভালভাবেই মিলেমিশে যায়। কিন্তু মূলঘরে ছিল অন্য রকম পরিবেশ। সেখানে অনেক মুর্শিদাবাদী মুসলমান, বাগেরহাটের হিন্দু অধিবাসীদের ঘরবাড়ি ও জমিজমা তাদের মুর্শিদাবাদের সম্পত্তির সঙ্গে বিনিময় করে। এই বিনিময়ের সুযোগে অনেক স্থানীয় লোকও ভূমিদস্যুতায় শামিল হয়। মূলঘর এলাকার জমিজমা নিয়ে ছিল নানা ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি। দুর্ভাগ্যবশত প্রফুল্ল কলেজের কতিপয় শিক্ষকও এই ভূমি দখলের খেলায় মেতে পড়েন। তারা সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু জমিদারদের জমি বন্দোবস্ত নেয়ার পাঁয়তারা করেন। বাগেরহাটে প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজটির বেশ সুনাম ছিল। এই কলেজে আমার সময়ে অধ্যক্ষ ছিলেন আবদুুল আউয়াল। কলেজ পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভাতেই দাবি উঠল যে, এই কলেজে বিজ্ঞান ক্লাস শুরু করা প্রয়োজন। আমার কাছে প্রস্তাবটি ভালই মনে হলো। তবে এজন্য যে অর্থের প্রয়োজন হবে সেটা সংগ্রহ করা কষ্টকর মনে হলো। বাগেরহাটের বিদ্যালয়গুলো বেশ উন্নতমানের ছিল; কিন্তু মেয়েদের স্কুলে ছাত্রীদের থাকার খুব অসুবিধা ছিল। শহরে ম্যাকফারসন পাবলিক লাইব্রেরি নামে একটি গ্রন্থাগার ছিল মহকুমা হাকিমের অফিসের খুব কাছেই। এছাড়া ছিল এসি লাহা নামক একটি ক্লাব। ক্লাবটি যখন নির্মিত হয় তখন নিশ্চয়ই সেটি খুব সুদৃশ্য ছিল এবং ক্লাবের অনতিদূরে একটি পুকুরও ছিল। এর কাছেই ছিল গার্লস স্কুল। ক্লাবের সমস্যা ছিল দুটি। প্রথমত, সামান্য বর্ষাতেই ক্লাবের ছাদ দিয়ে পানি পড়ত। আর ক্লাবের টেনিস বল প্রায়ই পুকুরে চলে যেত। কিছুদিনের মধ্যেই বাগেরহাটের সমাজসেবী লোকজন এবং উকিল ও মোক্তার গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে আমার পরিচয় বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মোজাম ডাক্তার এবং রোকা মিয়া ছাড়াও যাদের সঙ্গে বেশ পরিচয় হয় তাদের মধ্যে যাদের নাম এখনও মনে আছে তারা ছিলেন ফকিরহাটের আলী আহমেদ, শহরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী সায়েম উদ্দিন কাজী, জমিদার কিরণ দাস, যুবক সৈয়দ রওনক আলী ওরফে হারু মিয়া, যুবক শেখ আমজাদ আলী ওরফে গোরাই মিয়া। বিশিষ্ট কয়েক আইনজীবী- এনসাফ উদ্দিন আহমদ, মীর মোশাররফ আলী, ভূপেশ চন্দ্র আইচ এবং সৈয়দ মোস্তাজাবুল হকের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভূপেশ বাবু খুব সহজে সুন্দর কবিতা রচনা করতে পারতেন। চলবে...
×