ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২০ নভেম্বর ২০১৬

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন

সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তিনি। একজন সাহিত্যিক ও সমাজসেবক হিসেবেও পরিচিত তিনি। সওগাত পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই সর্বাধিক খ্যাতি তার। ১৯১৮ খ্রিাব্দের ২ ডিসেম্বর তিনি প্রথম মুসলিম সম্পাদক হিসেবে সওগাত পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকা প্রকাশের পর চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে স্বাভাবিক প্রকাশনা ব্যাহত হলে কিছুদিন পত্রিকা বন্ধ রাখেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় প্রকাশনা শুরু করেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে নাসিরউদ্দীন ‘সওগাত সাহিত্য মজলিস’ নামে একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে তোলেন। সে সময়ের সওগাত পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, শামসুন্নাহার মাহমুদ, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। তাঁর উদ্যোগে এবং সম্পাদনায় সওগাত নামে আরও কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যেমন ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে বার্ষিক সওগাত প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে সাপ্তাহিক সওগাত প্রকাশিত হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে সচিত্র মহিলা সওগাত প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াও কিছুদিন শিশু সওগাত প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মূল পত্রিকাটি চালু ছিল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই। কলকাতা থেকে মহিলাদের জন্য ‘বেগম’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ নবেম্বর চাঁদপুর জেলার পাইকারদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আবদুর রহমান এবং মায়ের নাম আমেনা বিবি। তিনি ছিলেন বাবা-মার বড় সন্তান। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল হরিণা গ্রামে ইংরেজী উচ্চবিদ্যালয়ে। যখন তাঁর বয়স আঠারো বছর তখন তাঁর বাবা মৃত্যুবরণ করেন। বাবার অবর্তমানে সংসারের গুরুদায়িত্ব বহন করতে হয় তাঁকে। তখন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তিনি স্বল্প বেতনে স্টিমার কোম্পানিতে স্টেশন মাস্টারের সহকারী হিসেবে চাকরি শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওরিয়েন্টাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের এজেন্টের কাজ নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। এখানে কাজ করে অর্থ সঞ্চয় করেন। কিছুটা পুঁজি হলে চাকরি ছেয়ে দেন এবং কলকাতায় সাহিত্যসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে নাসিরউদ্দীন সপরিবার ঢাকায় চলে আসেন। সে সময় সওগাত ও বেগম পত্রিকাও তখন কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। ঢাকায় এসে নুরজাহান বেগম ৩৮নং শরৎগুপ্ত রোডের বাড়িতেই বেগমের প্রকাশনা শুরু করেন। এখানেই হয় পত্রিকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেগম ক্লাব’। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, সেক্রেটারি হন নুরজাহান বেগম। বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নারীদের উৎসাহিত করার জন্য তিনি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ‘বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ২১ মে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার শুভ জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা। স্মরণ ॥ কবি সুফিয়া কামাল কবি সুফিয়া কামাল। একজন প্রথিতযশা কবি ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯১১ সালের ২০ জুন তিনি বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামাবাড়িতে জš§গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ আবদুল বারী। যেই সময়টিতে সুফিয়া কামালের জš§ তখন বাঙালি মুসলিম নারীদের কাটাতে হতো অনেকটা গৃহবন্দি জীবন। স্কুল-কলেজে পড়া অনেকের পক্ষেই সুযোগ ছিল না। পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ এক রকম নিষিদ্ধ ছিল। ওই পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। তিনি পারিবারিক নানা উত্থান-পতনের মধ্যে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। মা সাবেরা বেগমের কাছে বাংলা পড়তে শেখেন সুফিয়া কামাল। মাত্র ১২ বছর বয়সে তাকে সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা বাসন্তী ‘সওগাত’-এ প্রকাশিত হয়। ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখের দেখা পান। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’ রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা সুফিয়া কামালের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’র মুখবন্ধ লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ায়। যাদের মাঝে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। ১৯৩২ সালে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু তাকে আর্থিক সমস্যায় ফেলে। তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত থাকেন। ১৯৩৯ সালে কামালউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। দেশ বিভাগের আগে তিনি নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী বেগমের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন। তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। গ্রন্থনা ঃ দুলাল আচার্য
×