ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসির সিয়াম

মালিহা ও ঘোষদাদু

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

মালিহা  ও  ঘোষদাদু

স্কুলের ঘণ্টা পড়ছে এমন সময় মেইনগেটের সামনে এসে দাঁড়াল একটি রিক্সা। রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে নেমে আসলেন মালিহা ও তার আম্মু। মালিহার আম্মুকে দেখেই এগিয়ে এলেন স্কুলের দারোয়ান বিনয় ঘোষ। বেশ বয়স হলেও পরিবারে রোজগার করার মতো আর কেউ না থাকায় তাকে এখনও কাজ করতে হয়। সবাই তাকে ঘোষবাবু বলেই ডাকেন। আর স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা ডাকেন দাদু বলে। ঘোষবাবু মালিহার আম্মুকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আজ রিক্সায় করে এলেন কেন, আপা? ঘোষবাবুর কথা শুনে মালিহার আম্মু একটু হাসলেন। সালামের জবাব দিয়ে উত্তর দিলেন, আর বলবেন না ঘোষবাবু, রাস্তায় গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। সেখান থেকে রিক্সায় করে আসতেই অনেক দেরি করে ফেললাম। এমন সময় ঘোষবাবুরও মনে পড়ল যে, স্কুল শুরুর ঘণ্টা পড়ে গেছে। তিনি মালিহাকে বললেন, ক্লাস মনে হয় শুরু হয়ে গেছে। মালিহা বাবু তুমি তাড়াতাড়ি ক্লাসে চলে যাও। একথা শুনেই মালিহার বিরক্তি লাগছে। সে মোটেই এই লোকটাকে পছন্দ করে না। সবসময় একই নোংরা পোশাক পরে থাকেন তিনি। তাছাড়া মালিহা অনেকবার তাকে বাবু বলে ডাকতেও নিষেধ করেছে। কিন্তু এই লোকটা তবুও আজ তাকে বাবু বলেই ডাকছে। মালিহা স্কুলে ঢুকছে না দেখে এবার আম্মু তাকে তাড়া দিয়ে বললেন, কি হলো মালিহা, তোমাকে না দাদু তাড়াতাড়ি ক্লাসে যেতে বললেন? ক্লাস তো শুরু হয়ে গেছে । মালিহা উত্তর দিল, আমি ক্লাসে যাচ্ছি। তবে এই লোকটা মোটেও আমার দাদু না, মামণি। কথা শেষ করেই দৌড়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকে গেল সে। মালিহার কথায় তার আম্মু বেশ লজ্জিত বোধ করছেন। তিনি ঘোষবাবুর কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, তিনি বাসায় ফিরে মালিহাকে বুঝিয়ে বলবেন এমনটা আর না করতে। জবাবে ঘোষবাবুও বললেন, থাক না আপা। ও ছোট মানুষ, এতকিছু বোঝে না। বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে বকাবকি করবেন না । - না, বকাবকি করব না। কিন্তু ছোট থেকেই যদি ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে শুনিয়ে আদব কায়দা না শেখাই, তবে বড় হলেও ওর আচরণে পরিবর্তন আসবে না। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না, প্লিস।- কি যে বলেন! ওকে আমি আমার নিজের নাতনির মতোই দেখি। আজ বেঁচে থাকলে সেও মালিহার মতই হতো। জন্মের সাতদিন পর আমার ছেলে তার বৌ আর মেয়েকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরছিল। কিন্তু রাস্তায় এক্সিডেন্টে ওরা সবাই মারা যায়। ঘোষবাবুর চোখ ছলছল করছে দেখে মালিহার আম্মুর বেশ খারাপ লাগল। এই বয়সে যে লোকটার বাড়িতে বসে আরাম করার কথা ছিল, আদরের নাতনির সঙ্গে খেলার কথা ছিল, ভাগ্যের দায়ে আজ তাকে কষ্ট করে কাজ করে যেতে হচ্ছে। অনেকটা সময় কেটে গেল। এবার মালিহার আম্মু বাসায় রওনা দিবেন। বিদায় নেওয়ার সময় তিনি ঘোষবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন, আপনি ভাল থাকবেন। আর আমার মেয়েটাকে একটু দেখে রাখবেন কষ্ট করে। এরপর ঘোষবাবুও নিজের কাজের জায়গায় ফিরে গেলেন। দেখতে দেখতে টিফিন পিরিয়ড চলে এলো। বাচ্চারা কি সুন্দর মিলেমিশে বিভিন্ন রকমের খেলা খেলছে! কানামাছি, এলাটিং বেলাটিং, চোর পুলিশ, কুমির কুমির খেলাসহ আরও কত কি! গেট থেকেই তিনি বাচ্চাদের খেলাগুলো দেখেন। ঘড়িতে বেলা বারোটা বেজে গেছে। মর্নিং শিফটের ছাত্রছাত্রীদের ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেল এই মাত্র। সবাই লাইন ধরে এক এক করে গেট দিয়ে বের হচ্ছে। সবার আব্বু আম্মু এসেছে তাদের বাসায় নিয়ে যেতে। এক সময় মালিহাও বেরিয়ে এলো। কিন্তু আশপাশে খুঁজেও তার আম্মুকে দেখতে পেল না। হঠাৎই তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সবাই আব্বু-আম্মুর সঙ্গে বাসায় চলে যাবে এখন। আর তাকেই শুধু আম্মুর অপেক্ষায় একা একা বসে থাকতে হবে। প্রায় আধা ঘণ্টা যাবত গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মালিহা। ঘোষবাবু প্রথম থেকেই খেয়াল করছিল ওকে, কিন্তু ও রেগে যেতে পারে ভেবে তিনি কাছে যাননি। দাঁড়িয়ে থাকায় হয়ত কষ্ট হচ্ছে ভেবেই তিনি মালিহার কাছে গিয়ে বললেন, দাঁড়িয়ে থাকতে তো তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি তার চেয়ে আমার পাশে এসে বস। তোমার আম্মু এলে চলে যেও। ঘোষবাবুর কথা শুনে মালিহা আবারও রেগে গেল। বলল, আমি আপনার পাশে গিয়ে কখনই বসব না। আপনি আমার কাছ থেকে সরে যান। আর আমি একাই বাসায় যেতে পারব বলেই, মালিহা তাড়াহুড়া করে রাস্তা পার হতে যাচ্ছিল। ঠিক এমন সময় দ্রুত গতিতে একটা সিএনজি এসে মালিহাকে ধাক্কা দিল। ঘোষবাবু ছুটে গেলেন রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা মালিহার কাছে। উপুর হয়ে পড়ায় মাথায় প্রচ- ব্যথা পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে অনেক রক্তও ঝরছে। ঘোষবাবু মালিহাকে কোলে নিয়ে দ্রুত রাস্তার ঐ পাশে চলে গেলেন। এক্ষুণি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি একটা রিক্সা করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন তিনি। পথে যেতে যেতে মালিহার আম্মুকে ফোন করে হাসপাতালে আসতে বললেন। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর জানালেন, মালিহার শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝরে যাওয়ায় শিগগিরই ওকে রক্ত দিতে হবে। তবে ওর রক্তের গ্রুপ ‘ও নেগেটিভ’, যেটা তাদের কাছে নেই। খুব তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে সমস্যা হতে পারে। মালিহার আম্মু সবকিছু শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। তার আর মালিহার রক্তের গ্রুপও আলাদা। পাশে থাকা ঘোষবাবু তখন মালিহার আম্মুকে অভয় দিয়ে বললেন, স্কুলের আইডি কার্ড বানানোর সময় তার রক্ত পরীক্ষা করে রক্তের গ্রুপ জানাতে হয়েছিল। তখন তিনি জেনেছেন, তার রক্তের গ্রুপও ‘ও নেগেটিভ’। তিনিই মালিহাকে রক্ত দিতে পারবে। রক্ত দেয়ার পর প্রায় দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। মালিহা জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। সে এখন আম্মুর সঙ্গে ধীরে ধীরে কথাও বলতে পারছে। তবে ঘোষবাবু সেই ঘরে ঢুকতেই মালিহা যেন বিরক্ত হল । এমনটা দেখে মালিহার আম্মু মালিহাকে তার এক্সিডেন্টের কথা মনে করিয়ে দিলেন। জানালেন, তাকে বাঁচানোর জন্য যে রক্ত দেওয়া হয়েছে সেটা এই ঘোষবাবুই দিয়েছেন। সবকিছু শুনে মালিহা অবাক হয়ে গেল। যে লোকটাকে সে সহ্যই করতে পারে না, সেই তাকে রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচাল! অথচ তার সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করলে সে কখনই তার সঙ্গে আর বন্ধুত্ব করে না। মালিহা ঘোষবাবুর হাত ধরে বলল, আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তবে আর কখনও তোমাকে কষ্ট দেব না, দাদু। ছোট্ট মালিহার কথা শুনে ঘোষবাবু আর তার আম্মু দু’জনেই এক সঙ্গে হেসে উঠলেন।
×