ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

তৃতীয় অধ্যায় ॥ বাগেরহাটে এক বছর আমি ভেবেছিলাম যে, আমার বাগেরহাট সময় নিয়ে একটি বিস্তৃত বিবরণী দেব। বিশেষ করে বাগেরহাটের সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা এবং সামাজিক শ্রেণীভেদ নিয়ে কিছু বলব। আমার ভরসা ছিল, বাগেরহাট থেকে যখন বদলি হই তখন আমি বাগেরহাটের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রণয়ন করি। আমি ভেবেছিলাম যে, এই প্রতিবেদনের খসড়া বোধহয় আমার কাছে আছে। কিন্তু তা খুঁজে পেলাম না। তবে বাগেরহাটে সম্ভবত আমি সেখানে পৌঁছার কিছুদিন পরেই আমার এক ছোট ভাই সুজনকে নিয়ে যাই। সে তখন লেখাপড়ার দিকে তত নজর দিত না। সুতরাং আমার উদ্দেশ্য ছিল যে, তার পড়াশোনার দিকে নিবেদন নিবিড় করব। সে বাগেরহাটে কোন স্কুলে যাবে না তাকে একজন শিক্ষকের কাছে পড়তে হবে। বাগেরহাট স্কুলের একজন শিক্ষক কালিপদ বাবু তাকে তালিম দিতেন। বাগেরহাট থাকাকালেই সে ১৯৬০ সালে প্রাইভেট প্রার্থী হিসেবে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে খুলনা যায়। তার সহায়তায় এবং বাগেরহাটের আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আমি বাগেরহাটের স্মৃতি জাগরূক করতে প্রচেষ্টা নিই। বাগেরহাটে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা বহুদিন থেকে খুবই প্রভাবশালী ছিলেন। প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজের বেশ নামধাম ছিল। ফকিরহাট থানার মূলঘর এলাকাটি ছিল খুবই প্রতিপত্তিশালী এবং তার অধিবাসীরাই বাগেরহাটে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকতেন। তবে এক সময়ে এটি একেবারেই হিন্দু সম্প্রদায় প্রভাবিত ছিল। আমার সময়ে অর্থাৎ ৪৭ বছর আগে অবস্থা সে রকম ছিল না। আমার সময়ে বাগেরহাট শহরে চারটি উচ্চ বিদ্যালয় ছিল, যার মধ্যে একটির নাম ছিল নূরুল আমিন উচ্চ বিদ্যালয় এবং মেয়েদের স্কুলে মুঈনুন্নেছা ছাত্রীনিবাস। সম্ভবত ১৯৪৩ সালে এই মহকুমায় প্রথম মুসলমান মহকুমা হাকিম হয়ে আলী আহমদ পদায়িত হন। তিনি সিলেটের জেলা প্রশাসক হিসেবে আমার পরিচিত ছিলেন। তিনি বাগেরহাটে প্রায় ৩ থেকে ৪ বছর ছিলেন এবং এই সময়ে একদিকে বাগেরহাটের মুসলমান নেতৃবৃন্দ সামনে আসেন এবং অন্যদিকে বাগেরহাটে মুসলিম ইতিহাস সংরক্ষিত হয়। খানজাহান আলীর মাজার, ষাট গম্বুজের মসজিদ এগুলোর সংস্কারে আলী আহমদ বিশেষ সাফল্যের পরিচয় দেন। তার সময়েই বাগেরহাটের মুসলিম গণ্যমান্য কতিপয় ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় খেতাব লাভ করেন। এসব ব্যক্তির দুয়েকজন যেমন খান বাহাদুর সৈয়দ সুলতানের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। আমার সময়ে হিন্দু ব্যবসায়ী ও উকিল-মোক্তারের সঙ্গে অনেক মুসলমানও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে আবার দুটি দল বিশেষভাবে প্রভাবশালী ছিল। একটি দলের নেতা ছিলেন ডাঃ মোজাম্মেল হোসেন। আর অন্য দলের নেতা ছিলেন আইনজীবী রোকা মিয়া ওরফে হেমায়েত উদ্দিন আহমদ। টাকা-পয়সার দিকে সম্ভবত মোজাম্মেল ডাক্তারের প্রভাব একটু বেশি ছিল এবং রোকা মিয়া আশরাফ গোষ্ঠীর নেতা বলে নিজেকে মনে করতেন। তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি (মারামারি নয়) ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। সরকারী সব কর্মকা-ে কিন্তু তারা দু’জনেই সাগ্রহে সাড়া দিতেন। বাগেরহাটে আমি এক বছরের কয়েকদিন বেশি নিযুক্ত ছিলাম। আমি ১৯৫৯ সালের ১১ জুলাইতে বাগেরহাটে পৌঁছি এবং পরবর্তী বছরের জুলাই মাসের ১৫ তারিখে ঢাকার পথে বাগেরহাট ছাড়ি। তখন আমার বিয়ে হয়নি বলে কাজকর্ম এবং বিকেলে খেলাধুলাতে আমার সব সময় ব্যয় হতো। বাগেরহাটে গানবাজনার চর্চা ছিল বেশ উন্নতমানের। প্রতি সন্ধ্যায়ই পাড়ায় পাড়ায় গান ও বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ পাওয়া যেত। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নাচ-গানের অনুষ্ঠানে খুব আগ্রহী ছিল এবং ওস্তাদ অর্থাৎ গান-শিক্ষকরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রায়ই ছোটখাটো অনুষ্ঠান করতেন। আমি এসব অনুষ্ঠানে প্রায়ই যেতাম। সেখানে আমি একটি খুব ভাল গায়িকাকে আবিষ্কার করি। সে সম্ভবত বিদ্যালয়ের শেষ ধাপের ছাত্রী ছিল, তার নাম ছিল ছায়ারানী। তাকে আমি কিছুদিন পরে ঢাকা রেডিও স্টেশনে মহড়া দিতে পাঠাই। কিছুদিন পর থেকে সে মাঝে মাঝে ঢাকা রেডিওতে গান গাইত। আমার ছাত্রজীবনের পরিচিত রেডিও দফতরের বন্ধুজনেরা ছায়াকে রেডিওতে সুযোগ পেতে সহায়তা করেন। বাগেরহাটে সম্ভবত ফটোগ্রাফির একটি স্টুডিও ছিল। ফটোগ্রাফার মনে হয় আমার বয়সীই ছিল। সে আমার অনেক ছবি তুলত এবং আমার তোলা ছবি প্রক্রিয়াজাত করত। সে সব সময়েই কালো চশমা পরত এবং সবাই তাকে চিনত, তার নামটি ভুলে গিয়েছি। বাগেরহাট তখন মোটামুটিভাবে যথেষ্ট উন্নত এলাকা হলেও যোগাযোগ ছিল খুবই দুর্বল। ৭টি থানার মধ্যে একটি দুটি ছাড়া সবখানেই ছিল নৌকায় যোগাযোগ। বাগেরহাটের আর একটি বিশেষত্ব ছিল, সেখানে সেই সময়ের তুলনায় যথেষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল যেগুলো বেশিরভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাগেরহাটে আমার সময় ৪০টি ইউনিয়ন ছিল এবং সেখানে আমি কম সময় থাকলেও প্রতিটি ইউনিয়ন পরিদর্শনের প্রত্যয় নিই এবং তাতে সফল হই। আমার সময়ে বাগেরহাটের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ লাখ। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ। আমার সময়ে বাগেরহাটে থানা ছিল ৭টি। এখন আছে ৯টি। পৌরসভা ছিল ১টি শুধু বাগেরহাটে। এখন মংলা পোর্ট এবং মোরেলগঞ্জও পৌরসভা হয়েছে। ৭টি থানার মধ্যে ছিল বাগেরহাট সদর থানা, ফকিরহাট থানা, মোরেলগঞ্জ থানা, রামপাল থানা, রায়েন্দা থানা, কচুয়া থানা এবং মোল্লাহাট থানা। বর্তমানে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিতলমারী এবং মোংলা উপজেলা দুটি। মোংলা তখন খুবই অনুন্নত ছিল; তখনও এ্যাঙ্কারেজটি স্থাপিত হয়নি। বাগেরহাটের ৭টি থানার মধ্যে শুধু সদর এবং ফকিরহাটে স্থলপথে ঘোরাফেরা করা যেত। অবশ্যি রাস্তার গুণগত মান খুবই নিম্ন ছিল। বাগেরহাটে আমার খুব ব্যস্ত সময় কাটে। সেই ব্যস্ততার শুরু হয় প্রথম থেকেই যখন খুলনার জেলা প্রশাসক মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী, সিএসপি আমাকে জানালেন যে, বন্যার ফলে শরণখোলা এবং রায়েন্দা এলাকায় এক ধরনের দুর্ভিক্ষ চলছে এবং সেখানে টেস্ট রিলিফের কাজ হচ্ছে; তিনি আমাকে এই বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে বললেন। চলবে...
×