ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জিলাপি ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে বসে কৃষকের আড্ডা-

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

জিলাপি ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে বসে কৃষকের আড্ডা-

শীতের মিঠেকড়া রোদে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষকের আড্ডার আমেজই আলাদা। বিশেষ করে জিলেপি, মুড়ির মোয়া আর ভাপা পিঠা নিয়ে কৃষকরা আড্ডায় কাটিয়ে দেয় দিনের বড় অংশ। আড্ডায় উঠে আসে কৃষকের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার নানান গল্প। পরিবারের সদস্যদের বিয়ে, লেখাপড়া থেকে ক্ষেতের ফলনসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসে আড্ডায়। বাদ যায় না প্রেম ভালবাসার কথাও। সাগরের তীর ঘেঁষা দক্ষিণাঞ্চল মানেই কৃষি আর মৎস্যনির্ভর জীবন। আবহমান কাল থেকে এ অঞ্চলের মানুষ মাটির তলা ফুঁড়ে শস্য উৎপাদনে অভ্যস্ত। আগে দক্ষিণাঞ্চলে বছরে মাত্র একবার স্থানীয় জাতের আমন ধান উৎপাদন হতো। এখন কৃষি ব্যবস্থার ধরন ধারণ পাল্টেছে। উফশীসহ নানা জাতের ফসল উৎপাদনে কৃষকের ব্যস্ততা বছর ভর। তবে সব এলাকা এখনও সমান নয়। কোথাও কোথাও ব্যস্ততার মাত্রা কমবেশি রয়েছে। তবে গোটা দক্ষিণে বছরের এ সময়টাতে কৃষকের ব্যস্ততা একটু বাড় বাড়ন্ত। ক্ষেতে ক্ষেতে আমন ধানে সোনালী রং ধরেছে। আমন আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। সামনে ফসল যত বেশি উঠবে, ব্যস্ততা তত বাড়বে। ব্যস্ততা যতই হোক, তাই বলে দক্ষিণের কৃষকের জীবন থেকে শীতের সময়ের আড্ডার ছবি আজও মুছে যায়নি। আড্ডার ছবি প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। কৃষকের আড্ডার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে- আড়াই প্যাঁচের জিলেপি, মুড়ির মোয়া আর চিতই, ভাপাসহ বিভিন্ন ধরনের পিঠা পায়েস। এ অঞ্চলের কৃষকদের বড় অংশ হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের চাষী। পুরো বর্ষা দিনভর ক্ষেতে কাজ করায় মেলেনি আড্ডার সুযোগ। এখন ফসল উঠবে, এরই মাঝে চলবে আড্ডা। কৃষকের আড্ডার উপাদান অর্থাৎ জিলেপি, মুড়ির মোয়া আর পিঠার যোগান দিতে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীও নেমে পড়ে মাঠে। যাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘গাওয়াল’। এরা জিলেপি, মুড়ির মোয়া ও পিঠার ঝাঁকা মাথায় ঘুরে বেড়ায় এক ক্ষেত থেকে আরেক ক্ষেতে। এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে। এই ঘুরে বেড়ানোকে আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘গাওয়ালি’। গাওয়ালদের চিৎকারে জেগে ওঠে পাড়া-মহল্লা, মেঠোপথ। কখনও কখনও গাওয়ালরা জিলেপি কিংবা পিঠা ভাজার চুলাসহ সব উপাদান ধানের ক্ষেতেই নিয়ে যায়। গরম জিলেপি কিংবা মুড়ির মোয়া তুলে দেয় কৃষকের হাতে। টাটকা পিঠা কিংবা মুড়ির মোয়ার স্বাদ আর গন্ধ কৃষককে মাতোয়ারা করে। এ গাওয়াল নিয়ে গ্রামাঞ্চলে ঘটে নানা মজার ঘটনা। বিশেষ করে প্রত্যন্ত চর-দ্বীপাঞ্চলে। ক্ষেতে কৃষক তো আর নগদ পয়সা নিয়ে যায় না! অথচ গাওয়ালের চিৎকারে কৃষকের খিদে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আড্ডার জন্য মন উসখুস করে। এ সময় কৃষক চালাকির আশ্রয় নেয়। চাষী মহাজনের ধান চুরি করে সের হিসেবে মেপে তুলে দেয় গাওয়ালের হাতে। গাওয়ালরা চাষীর হাতে তুলে দেয় পিঠা কিংবা জিলেপি। মহাজনের চোখ এড়াতে চাষীরা দল বেঁধে নির্জন জায়গায় লুকিয়ে পড়ে। সেখানে বসে চলে লাগাতার আড্ডা আর জিলেপি, মুড়ির মোয়া কিংবা পিঠার স্বাদ নেয়া। অনেক সময়ে চাষীরা মহাজনের পরিবারের কোন সদস্যকে লোভ দেখিয়ে সঙ্গী করে নেয়। অবস্থাপন্ন মহাজনদের শত শত মণ ধান ওঠে। চাষীরা সরাসরি সে ধান গোলায় কিংবা হাটে নেয় না। স্তূপ করে ফেলে রাখা হয় ক্ষেতে। রাতে সে ধান চাষীদের পাহারা দিতে হয়। তাই ক্ষেতে বানানো হয় অস্থায়ী ঘর। সে ঘরের মাঝে দল বেঁধে পাহারার ফাঁকে চাষীদের চলে আড্ডা। এসব আড্ডাতেও উপাদান হয়ে আসে মুড়ির মোয়া, পিঠা কিংবা জিলেপি। এ অঞ্চলে দু’ধরণের জিলেপি ভাজা হয়। চিনি আর খেজুড়ের গুড়ে। স্বাদে গন্ধে খেজুড়ের গুড়ে তৈরি জিলেপি কৃষকদের বেশি পছন্দ। দক্ষিণের কৃষকদের এ আড্ডায় যে বা যারাই একবার গেছে, তারাই আকৃষ্ট হয়েছে। এমন আড্ডা কার না পছন্দ? মহাজন বাড়ির বধূরাও অনেক সময় কৃষকদের আড্ডার সুযোগ করে দেয়। বধূরা শীতের নরম রোদে খোলা আকাশের নিচে পিঠা বানাতে বসে, কৃষকরা তার চারপাশে গোল হয়ে বসে। -শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×