ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের বিকেলে জমে ওঠে আড্ডা

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

শীতের বিকেলে জমে ওঠে আড্ডা

আড্ডার কথাই আলাদা। ছেলে-বুড়ো সকলেই আড্ডার ভক্ত। জেন্ডারের কোন ভেদাভেদ নেই। আড্ডার পালা শুরু হলে তা আর থামতে চায় না। এর যেন শেষ নেই। অমীমাংসিতই থেকে যায় আড্ডার বিষয়। তবু আড্ডা জমে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা শরত হেমন্ত বসন্ত কোন বাধা নেই। কখনও বলা হয়, আড্ডায় না গেলে, না জমলে পেটের ভাত হজম হয় না। আড্ডার সেই চিরন্তন গান গেয়েছেন মান্না দে। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই... কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই... একটা টেবিলে সেই তিনচার ঘণ্টা... কখনও বিষ্ণু দে কখনও যামিনী রায় এই নিয়ে লেকচার চলতো... চার থেকে শুরু করে জমিয়ে আড্ডা মেরে সাড়ে সাতটায় ঠিক উঠতাম...।’ সেদিনের সেই কফি হাউসে আড্ডা যে আজও জমে ওঠে সেই কথাও গানের শেষে বলা আছে এভাবে। ‘সেই সাতজন নেই আজ তবু টেবিলটা পড়ে আছে সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই। একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুড়ি শুধু সেই সেদিনের মালি নেই। কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়। কতজনই এলোগেল কতজনই আসবে কফি হাউসটা তবু থেকে যায়...।’ আড্ডা সব দেশে সব জাতির মধ্যে আছে। কেউ কাজে আড্ডা। কেউ কাজ নেই তাই খই ভাজ আড্ডা। কেউ আড্ডার মধ্যমপন্থায়। তবে আড্ডার মধ্যে থেকে যে অনেক সৃষ্টির উৎস মেলে, এটাও ঠিক। মুনিঋষিরা এ কথা বলে গেছেন। তাদের বেলাতেও তা প্রযোজ্য হয়েছে। ঋতুর যে কোন দিনই আড্ডা বসে। কম আর বেশি। আড্ডা যেমন বর্তমানে নানা ধরনের কফি হাউসে, রেস্টুরেন্টে হয় তেমনই খোলা জায়গাতেও হয়। বিশেষ করে পার্কে, দর্শনীয় স্থানে। মহানগরী ঢাকার আড্ডা সবচেয়ে ভাল জমে চন্দ্রিমা উদ্যানে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তবে এসব আড্ডা নিয়ে নানা কথাও শোনা যায়। তারপরও নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে বর্তমানের তরুণরা থোরাই কেয়ার করে। আড্ডা চালিয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর ছিল ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সৃষ্টিশীল আড্ডার চারণভূমি। কত কবি-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক শিল্পীর জন্ম হয়েছে এসব আড্ডায়। আজও আড্ডা হয়। তবে সেদিনের সেই আড্ডার মধুময়তার ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশের এমন কোন জেলা উপজেলা বা গ্রাম নেই, যেখানে আড্ডা নেই। একেক আড্ডার ধরণ আলাদা তবে বৈশিষ্ট্য একই সুতোয় বাঁধা। প্রতিটি জেলা শহরের আড্ডার কিছু পয়েন্ট থাকে। এখন এসব পয়েন্টে জনসমাগম দেখে চটপটি, ফুচকাওয়ালা, বাদামওয়ালারা পসরা সাজিয়ে বসে। আগে তারা মাথায় পণ্যের ডালা নিয়ে রাস্তার ধারে বসেছে। ঘুরে ঘুরে ফেরি করেছে। দিনে দিনে এই ফেরিওয়ালাদেরও মান উন্নীত হয়েছে। এখন চৌকোনা বড় বাক্সের মতো ভ্যানগাড়ি বানিয়েছে। কাঁচে ঘেরা থাকে কিছু অংশ। প্যাডেল বসিয়ে চাকাও লাগিয়েছে। টেনে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নেয়া যায়। বাক্সের সঙ্গে এলপিজি সিলিন্ডার-চুলাও আছে। কোন গাড়িতে আছে স্টোভ। গাড়ির ভেতরে ফুচকা, চটপটি, সিদ্ধবুট, পুরী, পিঁয়াজুসহ মুখরোচক খাবারের ব্যবস্থা থাকে। কোন মোড়, পার্কের গেট, লোক সমাগমের জায়গাগুলোতে এরা বিকেলে বসে। অনেক রাত অবধি বেচাকেনা করে। হালে এরা যে পয়েন্টগুলোতে গাড়ি নিয়ে দাঁড়ায়, সেখানে কাঠের বেঞ্চ প্লাস্টিকের চেয়ার সাজানো থাকে। আড্ডাবাজরা এসে একটু আয়েশে বসে ফুচকা, চটপটি খায়। আড্ডাও দেয়। বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থল সাত মাথায় প্রধান ডাকঘরের সামনে, নবাববাড়ি সড়কে জিলা স্কুলের সামনে রাস্তার ধারে, শহীদ খোকন পার্কের গেটের সামনে ফুচকা-চটপটিওয়ালারা কাঠের বাক্সে কাঁচ দিয়ে ঘেরা গাড়ি নিয়ে দাঁড়ায়। বিকেল থেকে এসব স্থানে জমে ওঠে আড্ডা। কার্তিকের মধ্যভাগ থেকে আড্ডার পালা বাড়তে থাকে। চলে বসন্তকাল পেরিয়ে গ্রীষ্মের অনেকটা সময় ধরে। শীতের বিকেল একটু তাড়াতাড়ি শুরু হয়। এ সময় থেকে আড্ডাবাজরা আসতে থাকে। সন্ধ্যার জমজমাট আড্ডার আসর শীতের রাতে ন’টার পর ফাঁকা হতে থাকে। দিন বড় হওয়ার সঙ্গে এই সময় বাড়তে থাকে। গ্রীষ্মে মধ্যরাত পর্যন্ত ফুচকার দোকানকে ঘিরে আড্ডা সরব থাকে। এই দোকানগুলোর কাছেই বসে কাবাবের দোকান। আড্ডা জমে ওঠার সঙ্গে বেচাকেনাও জমে ওঠে। এসব দোকানকে ঘিরে ভ্রাম্যমান চায়ের দোকানিরাও আশপাশেই অবস্থান নেয়। বর্তমানে চায়েরও অনেক ধরণ। লাল চা বলতে বোঝায় ‘র’ চা। লেবু চা, আদা চা, গ্রীন টি, দুধ চা, র-কফি, ব্লাক কফি, দুধ দেয়া কফি, তুলসী চা, টি-ব্যাগ, মসলা চা, মরিচ চা... চায়ের যে কত ধরণ। ফুচকা, চটপটির দোকানের আড্ডার পর শেষ পর্বে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চলে চা-আড্ডা। রাত গভীর হওয়ার পথে আড্ডার রণে ক্ষান্ত দিয়ে ঘরে ফেরা। এসব আড্ডা মূলত প্রস্তুতি ছাড়াই। বিষয়বস্তু নির্ধারণ থাকে না। রাজা-উজির মেরে, ইতিহাস-পাতিহাস নেড়ে তবু কথার শেষ নেই। হাসিনা-খালেদা কেউই বাদ পড়ে না আড্ডার বিষয় থেকে । বলা যায়, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও মধ্য বয়সীদের সময় কাটানোর উত্তম স্থান। চাকরিজীবী, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী (কখনও রাজনৈতিক নেতাকর্মীও) শরীক হয় এসব আড্ডায়। অনেক পরিবার বাড়ির সদস্যদের নিয়ে ফুচকার দোকানে বসে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক তরুণ-তরুণী ও মধ্যবয়সীরা তাদের বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় সময় কাটায়। ক’জন বললেন- চায়নিজ রেস্তরাঁ, আধুনিক মার্কেট সংলগ্ন কফিশপে আড্ডা দেয়া যায়। তবে তা পকেটে ধস নামায়। এর চেয়ে অনেক কম খরচে ফুচকা, চটপটির দোকানে চেয়ার বেঞ্চে বসে আড্ডায় সময় কাটানো অনেক বেশি সাশ্রয়ী। এতে আড্ডাও হয়ে ওঠে মুখরোচক। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×