ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

নাসিরনগর থেকে গোবিন্দগঞ্জ পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা তৎপর

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

নাসিরনগর থেকে গোবিন্দগঞ্জ পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা তৎপর

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস হামলা এবং হত্যাকা-ের জন্য প্রশাসনের ব্যর্থতা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় দলীয় কোন্দলের কথা গণমাধ্যমে বারবার বলা হলেও নেপথ্যের কুশীলবদের সম্পর্কে কাউকে তেমন উচ্চকিত হতে দেখিনি। যে কোন অপরাধের তদন্তে প্রথমেই যে কারণটি খোঁজা হয়- ঘটনায় কে বা কারা লাভবান হচ্ছে? বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে রামু থেকে নাসিরনগর পর্যন্ত যত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সব একই সুতোয় গাঁথা, একই উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি বাংলাদেশে অমুসলিম নাগরিকদের ওপরÑ বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, হত্যা, গৃহে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, জমিদখল, মন্দির ও বিগ্রহ ভাংচুর একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যে কারণে এ বছর দুর্গাপূজার সময় কোন মন্দির বা প্রতিমা না ভাঙার খবর গণমাধ্যমে ঘটা করে ছাপা হয়েছে। প্রশাসন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেÑ যেন বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নির্মূল হয়ে গেছে! অনেক গবেষক, বিদ্বজ্জন মনে করেন সংখ্যালঘুদের ওপর উপর্যুপরি হামলার প্রধান কারণ তাদের জমিদখল। আওয়ামী লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলেন, যেহেতু সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় সব সময় আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, সেহেতু প্রতিপক্ষরা সুযোগ পেলেই হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও যে ধর্মীয় কারণ আছে এ কথা বলতে অনেকে আড়ষ্ট বোধ করেন। বাংলাদেশে এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়Ñ ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম কোন সন্ত্রাস অনুমোদন করে না, কিংবা বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই, আমরা জাতি হিসেবে অসাম্প্রদায়িক ইত্যাদি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাঙালীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনেক কাহিনী আছে। আবার এই বাঙালী পাকিস্তান আন্দোলনও করেছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, বাঙালী, পাহাড়ী, আদিবাসী নির্বিশেষে এদের সবাই অংশগ্রহণ করেছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যাশায়। ১৯৭২-এ প্রণীত বাংলাদেশের আদি সংবিধানে সেই চেতনাই প্রতিফলিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে পাকিস্তানীকরণ, মৌলবাদীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ আরম্ভ হয়েছে তা এখনও বন্ধ হয়নি। ১৯৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশে অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় ছিল পাকিস্তানের এদেশীয় এজেন্ট স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। দীর্ঘ সময় ধরে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াতে ইসলামীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যে কারণে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম দাবিÑ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ হলেও জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের দাবি আজও পূরণ হয়নি। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করেছিল প্রধানত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের অঙ্গীকারের কারণে। গত আট বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সন্তোষজনক অগ্রগতি সাধিত হলেও চার মূলনীতির পুনঃস্থাপন ছাড়া সংবিধানে এখনও জেনারেল জিয়ার ‘বিসমিল্লাহ...’ এবং জেনারেল এরশাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ রয়ে গেছে। যার ফলে ধর্মের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবহারের বহুমাত্রিক উদ্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জামায়াত-হেফাজতের ব্যানারে পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা ইসলামের নামে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ভিন্নধর্মের প্রতি ঘৃণার বিষ উদ্গিরণ করছে। বাংলাদেশে প্রধান মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী, যে দল এবং সমগোত্রীয়দের রাজনীতি ’৭২-এর সংবিধানে নিষিদ্ধ হলেও ’৭৫-এর পর নতুন উদ্যম ও কৌশলে মাকড়সার জালের মতো জামায়াতের বিস্তার ঘটেছে। এই জালে বিএনপিকে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে জামায়াত এখন আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করছেÑ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে দলটিকে বিচ্যুত করে মওদুদীবাদ তথা সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াবার জন্য। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর কাপুরুষোচিত হামলার প্রধান কুশীলব ছিল জামায়াত। জামায়াত তখন নেপথ্যে থেকে মাঠে নামিয়েছিল হেফাজতসহ স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবরে নাসিরনগরের হিন্দুদের ওপর হামলার জন্য নিঃসন্দেহে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা দায়ী। তবে হামলার আগের দিন জনসভায় হিন্দু সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে যারা কদর্য উক্তি করেছে, স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি তাদের শুধু রসরাজ দাসকে উপলক্ষ করে হিন্দুবিরোধী সমাবেশ করার অনুমতি দেননি, স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ২৯ অক্টোবর আহলে সুন্নতওয়ালাদের সমাবেশ যারা করেছে দলীয় পরিচয়ে তারা হে-জা-বি, হেফাজত-জামায়াত বিএনপির অনুসারী। আওয়ামী লীগের স্থানীয় তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বদলি করা হয়েছে, বিএনপির একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তবে হেফাজত-জামায়াত এখনও অধরা থেকে গেছে। এ কথা আমরা রামুর ঘটনাকাল থেকে বলছিÑ দল থেকে বহিষ্কার বা বদলি কোনও শাস্তি নয়, তারপরও এর ভেতর দিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসন কিছুটা হলেও নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করেছে, যা বিএনপি-জামায়াত জোটের জমানায় কখনও দেখিনি। নাসিরনগরের ঘটনার পর মেজর হাফিজউদ্দিনের নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধি দল উপদ্রুত এলাকা সফর করে রাজধানীতে ফিরে এসে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে। এ সময় মেজর হাফিজউদ্দিনের একবারও মনে পড়েনি ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় শুধু তার নির্বাচনী এলাকায় একটি গ্রামে দেড় শ’ হিন্দু নারী ও শিশু ধর্ষণ করা হয়েছিল, যাদের বয়স ছিল দশ থেকে সত্তর বছর। বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের প্রথম ১৫০০ দিনের ওপর আমরা তিন খণ্ডে বিশাল শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিলাম, যেখানে ২৭৮৬টি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এরপর বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে গঠিত সাহাবুদ্দিন কমিশনের প্রতিবেদনে জঙ্গী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রায় দশ হাজার ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, যা ঘটেছিল বিএনপি, জামায়াতের জমানায়, তখনকার সরকার এটা স্বীকার করেনি। এমনকি সিরাজগঞ্জের পূর্ণিমার বহুল আলোচিত গণধর্ষণের ঘটনাও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেছিলেন তার দলের ছেলেরা পূর্ণিমার ওড়না টেনেছিল, গায়ে হাত দেয়নি। এই ঘটনার বিচার হয়েছিল, কারণ ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’সহ বহু সংগঠন ও ব্যক্তি পূর্ণিমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামের মতো প্রথিতযশা আইনজীবীরা সিরাজগঞ্জে গিয়ে পূর্ণিমার জন্য লড়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত আসামিদের শাস্তিও হয়েছে। পূর্ণিমা ও অধ্যক্ষ গোপালকৃষ্ণ মুহুরির হত্যাকা- ছাড়া অন্য কোনও ঘটনায় কারও বিচার বা শাস্তি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানি, এসব ঘটনার প্রতিবাদ করার জন্য মুনতাসীর মামুন ও আমাকে একাধিকবার গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়েছিল। মহাজোট সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোন ঘটনা সরকার অস্বীকার বা আড়াল না করলেও আওয়ামী লীগের কিংবা প্রশাসনের কাউকে এর জন্য শাস্তি দেয়ার কথাও শুনিনি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শিক প্রণোদনা। অর্থনীতির কথা যদি বলি ২০০১ সালে আমরা দেখেছি হতদরিদ্র হিন্দু, যার জমি-জমা কিছুই নেই সেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়েছে। বহু নির্যাতিত পরিবার বলেছে, তারা ভয়ে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার পরও হামলা থেকে রেহাই পায়নি, কারণ একটাইÑ ধর্মীয় পরিচয়ে তারা হিন্দু। বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই। আইয়ুব খানের জমানায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার চক্রান্ত, যা স্বাধীন বাংলাদেশেও অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশকে একটি মনোলিথিক মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করার আদর্শিক ক্ষেত্র তৈরি করেছে ‘মওদুদীবাদ’ ও ‘সালাফিবাদ’। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর জগতে ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত বা ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসীদের কোন স্থান নেই। এমনকি সুন্নি মুসলমানরাও যদি মওদুদীর সালাফি ইসলামের বিরোধিতা করেন তাহলে তাদের হত্যা ইসলামের নামে জায়েজ করা হয়েছে। ’৭১-এর গণহত্যা থেকে আরম্ভ করে গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর হত্যাকাণ্ড কিংবা রামু থেকে নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা একই উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছে। খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে পাকিস্তান থেকে জিহাদী নেতারা এসে বাংলাদেশে ঘটা করে ‘হরকত-উল-জিহাদ’ গঠন করেছিলেন, যখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে জামায়াতবিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের তিক্ততা পাকিস্তান কখনও ভুলতে পারেনি। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের নিকট আত্মসমর্পণ করলেও তাদের দ্বিতীয় বাহিনী জামায়াতের আলবদর-আলশামস আত্মসমর্পণ না করে পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আত্মগোপন করেছিল বাংলাভাষী হওয়ার সুযোগে। জামায়াতের দলীয় প্রকাশনায় বলা হয়েছেÑ ’৭২ সালে সাংবিধানিকভাবে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই তারা আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক গঠন করে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। যে কারণে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষনেতাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তান সরকার বিবৃতি দিয়ে বলেছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত-বিএনপির নেতারা ছিলেন পাকিস্তানের খাঁটি নাগরিক। পাকিস্তান জানে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান থাকলে একদিন ঢাকার ট্রাইব্যুনালে পাকিস্তানী জেনারেলদেরও বিচার হবে। এ কারণে পাকিস্তানী দূতাবাস বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস যেমন উস্কে দিয়েছে, একইভাবে পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা একের পর এক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটাচ্ছে। এই প্রেতাত্মারা কখনও বিএনপিকে ব্যবহার করছে, কখনও আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করছে। বলির পাঁঠা বানাচ্ছে পার্থ সাহা, উত্তম বড়ুয়া, রসরাজ দাস কিংবা নিরীহ সাঁওতাল ও আদিবাসীদের। বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা হে-জা-বিরা উত্তরপূর্ব ভারত ও কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ মনে করে। ২০০১ সালে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো বেগম খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিল, শেখ হাসিনা তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনে করেন, কিন্তু খালেদা জিয়ার বিবেচনায় তারা স্বাধীনতাসংগ্রামী। বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিজীবীরা এখন টেলিভিশনের টকশোতে কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য মায়াকান্না করছেন। কিছুদিন আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ভাষণে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদী হরকত-উল-মুজাহিদীনের অধিনায়ক বুরহান ওয়ানিকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নওয়াজ শরীফের এই দাবি মানতে হলে পাকিস্তানকে মানতে হবে ’৭১ সালে বাঙালীরাও বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিল না, তারা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী। বঙ্গবন্ধুকে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। নওয়াজ শরীফের উচিত হবে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বাধীনতা সংগ্রামী বলার আগে ’৭১-এর গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মহান স্বাধীনতার সংগ্রামী ঘোষণা করে তাদের পাঠ্যপুস্তকে ’৭১-এর ইতিহাস নতুনভাবে লিপিবদ্ধ করা। ’৭১-এ পাকিস্তান নজিরবিহীন গণহত্যা চালিয়েও বাঙালীর স্বাধীনতার সংগ্রামকে পরাজিত করতে পারেনি। ’৭১-এর পরাজয়ের বদলা নেয়ার জন্য পাকিস্তান যেভাবে তাদের প্রেতাত্মাদের লেলিয়ে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকার যদি তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় তা শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও আত্মঘাতী হবে। মহাজোট সরকার ভারতের দখলে থাকা ছিটমহলগুলো উদ্ধার করে প্রশংসিত হয়েছে। তবে আমাদের সংবিধানসহ বিভিন্ন মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ব্যবসায়িক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পাকিস্তানের যে সব ছিটমহল রয়েছে, যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানীদের যে সব সম্পদ রয়েছে তার ওপর বাংলাদেশের স্বত্ব এখনও প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ...’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ যুক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পাকিস্তানীকরণের জন্য। মনোজগতে পাকিস্তানী মওদুদীবাদী দর্শন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে চেতনার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে দেশ ও জাতিকে এর জন্য চরম মাসুল দিতে হবে। ১৭ নবেম্বর ২০১৬
×