ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বালাও পোড়াও ও গুলিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৮

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ক্লিন অপারেশন ॥ চট্টগ্রামে প্রতিবাদ বিক্ষোভ

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ক্লিন অপারেশন ॥ চট্টগ্রামে প্রতিবাদ বিক্ষোভ

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে অসহায় মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর সে দেশের সেনা-পুলিশ ও বিজিপির বর্বরতা অব্যাহত রয়েছে। হত্যা, ধরপাকড়, জ্বালাও পোড়াও, ধর্ষণ সবকিছু এমন কোন ঘটনা নেই যা এখন ঘটেই চলেছে। রোহিঙ্গা নামের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর এমন বর্বরতম ঘটনাবলীকে প্রকারান্তরে ‘রোহিঙ্গা ক্লিন অপারেশন’ নামেই সে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশা ও এনজিও এবং সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে অবহিত করা হচ্ছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সকল আবেদন নিবেদন উপেক্ষা করে গণতন্ত্রমনা আউং সান সুচির সরকার ইতোপূর্বেকার সামরিক জান্তা সরকারের মতোই আচরণ করছে রোহিঙ্গা নরনারী ও শিশুদের সঙ্গে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে আরও ৮ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। নতুন করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে একটি রোহিঙ্গা এলাকার স্কুল ও তিনটি পাড়া। আগুন নেভাতে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে নির্বিচারে। এতেই নতুন হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে গত ১০ অক্টোবর থেকে রাখাইন প্রদেশে চিরুনি অভিযানে নিহতের সংখ্যা ১৩৮ জনে উন্নীত হয়েছে। তবে অসমর্থিত বিভিন্ন সূত্রে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে সীমান্তের ওপার থেকে মুঠোফোনে এপারে বসবাসরত আত্মীয়স্বজনদের খবর দেয়া হচ্ছে। ১৯৪২ সালে বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাপানী সৈন্যদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে চলে আসে। সেই থেকে অব্যাহতভাবে নির্যাতিত হওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা কেবলই বিভিন্ন পথে অবৈধভাবে দেশান্তরী হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এরা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রসমূহ জানিয়েছে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জাতিগত স্বীকৃতি না দিয়ে আন্তর্জাতিক সকল আইন কানুনকে একদিকে যেমন উপেক্ষা করে চলেছে, তেমনি অন্যদিকে তাদের বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের মুখে ফেলে দেশান্তরী হতে বাাধ্য করা হচ্ছে। এ ঘটনাকে বিভিন্ন সংস্থা ও সচেতন মহলের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গ ক্লিন অপারেশন হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কেননা, সাবেক আরাকান প্রদেশটি (বর্তমানে রাখাইন) এক সময় রোহিঙ্গাদের যে আধিক্য ছিল বর্তমানে তা আর নেই। বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থা রোহিঙ্গাদের বর্তমান সংখ্যা সে দেশে সর্বোচ্চ ৮ লাখ বলে চিহ্নিত করেছে। তবে মিয়ানমার সরকার এ সংখ্যা ৯ থেকে ১০ লাখ বলে উল্লেখ করে থাকে। যেহেতু এসব রোহিঙ্গাকে নিয়ে সে দেশের সরকারের বাস্তবিক অর্থেই কোন পরিসংখ্যান নেই। সেক্ষেত্রে সঠিক তথ্যও নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারী তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩২ হাজার হলেও সাত দশকেরও বেশি সময়ে নির্যাতন নিপীড়নে এরা ক্রমাগতভাবে দেশান্তরি হয়ে তাদের সংখ্যা কেবলই কমছে। এছাড়া মিয়ানমার সরকার সে দেশে রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যতিক্রমী আইন কানুন প্রণয়ন করে রেখেছে। কে কোথায় যাবে, কে কোথায় থাকে, কার ঘরে নবজাতকের জন্ম হচ্ছে সে হিসাবও রোহিঙ্গাদের দিয়ে আসতে হয়। এভাবেই জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু থেকে এরা আরও কমে এখন ৮ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ, শত শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বসবাস। বিশেষ করে আরাকান প্রদেশ জুড়ে ছিল এদের ব্যাপক জনবসতি। সীমান্তের ওপার থেকে মুঠোফোনে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, সন্ধ্যার পর কোন রোহিঙ্গার বাড়িতে বাতি না জ্বালাতে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সেনা সদসরা। রাখাইন প্রদেশের মহকুমা শহর সিটওয়ে (সাবেক আকিয়াব) ছাড়া তিনটি জেলা শহর মংডু, রাচিদং ও বুচিদং রয়েছে। ওই তিন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে কোন রোহিঙ্গার বাড়িতে বাতি না জ্বালানোর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি নিজ নিজ বাড়ি-ভিটার ঘেরাবেড়া তুলে নেয়ার এবং দা, ছুরি ও লোহার রড সংশ্লিষ্ট এলাকার বিজিপি ক্যাম্পে জমা করার দির্দেশ দিয়েছে সেনাবাহিনী। তিন দিনের মধ্যে এ নির্দেশ অমান্যকারীদের কোন কৈফিয়ত ছাড়াই আটক করে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে আরাকানে রোহিঙ্গাদের পাড়ায় নিয়মিত টহলরত সেনারা। সূত্র আরও জানায়, ধরে নেয়া রোহিঙ্গাদের ছেড়ে দেয়া দূরের কথা এদের প্রকৃত অবস্থা কি তাও জানা যাচ্ছে না। জাম্বুনিয়া ও রাওবাইল্যায় জ্বালিয়ে দেয়া বাড়ি-ঘরের বাসিন্দারা পাড়ার অদূরে লবণ মাঠে এবং পাহাড়ের পাদদেশে ব্যবহারের কাপড় দিয়ে তাঁবু তৈরি করে বসবাস করছে বলে খবর আসছে। ওদের বাড়িঘর জালিয়ে দেয়ার আগে সেনা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের মূল্যবান মালামাল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনদের মাঝে বণ্টন করে দেয়। ৩ শহরে সহিংসতা ॥ রাখাইনে ১৪ প্রাদেশিক রাজ্যের মধ্যে রাখাইন রাজ্য একটি। ঐ রাখাইন রাজ্যে শহর রয়েছে ১৭টি। তন্মধ্যে সহিংসতা চলছে তিনটি শহর ও শহরতলীসহ প্রায় গ্রামাঞ্চল। ওই তিটি শহর হচ্ছে-মংডু, রাচিদং ও বুচিদং। কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং বরাবর মিয়ানমারে বসবাসকারী লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করলেও তবে কোন ধরনের হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। টেকনাফের হ্নীলা থেকে শাহপরীররদ্বীপ বরাবর মিয়ানমারে মংডু জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়মিতভাবে চলছে নির্যাতন, নীপিড়ন ও হত্যাযজ্ঞ। মিয়ানমারে সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনায় টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলনে প্রতিনিয়ত। তবে বিজিবির সতর্ক অবস্থানের কারণে এরা আটক হয়ে পুনরায় ফেরত যাচ্ছে নিজ দেশে। তবে ব্যাপক সতর্কতার মাঝেও ফাঁকফোকরে কিছু কিছু রোহিঙ্গা এদেশে চলে আসতে সক্ষম হচ্ছে। এদেশে অবস্থানরত তাদের আত্মীয়স্বজনরা তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে। তবে রাখাইন প্রদেশে এ ধরনের ঘটনার পরও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এখনও শান্ত রয়েছে। সে দেশের বিজিপি এবং বাংলাদেশের বিজিবি ব্যাপকভাবে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। উল্লেখ্য, গত ১০ অক্টোবর থেকে রাখাইন রাজ্যে চলছে সেনা অভিযান। এর আগে মংডুর একটি বিজিপি ক্যাম্প থেকে গুলি ও অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। এ জন্য সে দেশের সরকার আরএসও সদস্যদের দায়ী করে আসছে। চট্টগ্রামে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল ॥ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বর্বরতার ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামে লালদীঘি জামে মসজিদ থেকে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ শাখা। বিক্ষোভ মিছিলটি স্লোগান দিতে দিতে প্রেসক্লাব চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় অনুষ্ঠিত হয় বিক্ষোভ সমাবেশ। এ সময় প্রধান অতিথি ছিলেন ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এমএ মতিন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা গণহত্যঅর শিকার। তাদের উপর চলছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে দেশান্তরী করা হচ্ছে। এত কিছুর পরও ইসলামিক দেশ ও বিশ্ব বিবেক কার্যকর কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। তিনি রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন বন্ধে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী, নুরুল ইসলাম, সৈয়দ আবু আজম, আবু নাসের তৈয়ব আলী, মোঃ জয়নুল আলম, ফজলুল করিম তালুকদার, নাসির উদ্দিন মাহমুদ, মাওলানা গিয়াস উদ্দিন নিজামী, জসিমউদ্দিন সিদ্দিকী প্রমুখ।
×