ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাওয়ায় পৌঁছানোর প্রস্তুতি

পদ্মা সেতুর সুপার স্ট্রাকচার স্থাপনে উচ্চক্ষমতার ভাসমান ক্রেন কুতুবদিয়ায়

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

পদ্মা সেতুর সুপার স্ট্রাকচার স্থাপনে উচ্চক্ষমতার ভাসমান ক্রেন কুতুবদিয়ায়

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মা সেতুর উচ্চ ক্ষমতার ভাসমান ক্রেন শুক্রবার রাতে কুতুবদিয়া চ্যানেলে এসে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে এখান থেকে এটি মাওয়ায় পৌঁছানোর পুরো প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এত বড় ভাসমান ক্রেন নেয়ার মতো নৌযান পাওয়া যাচ্ছে না। তাই চট্টগ্রাম পোর্টের বিশেষ টাগ বোট দিয়ে এটি মাওয়ায় নেয়া হবে। ৩ হাজার ৬শ’ টন ক্ষমতার এই ক্রেন পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার ক্রেন। গত ১২ অক্টোবর চীনের জোহাও থেকে মাদার ভেসেলে করে ভাসমান এই ক্রেন রওনা হয়। এই ক্রেন পদ্মা সেতুর সুপার স্ট্রাকচার স্থাপন করবে। প্রতিটি স্প্যান (১৫০ মিটার দীর্ঘ সুপার স্ট্রাকচার) সরাসরি পিলারে বাসাতে হবে। একেকটি স্প্যানের ওজন প্রায় ২ হাজার ৯শ’ টন। আর চীন থেকে আসা ভাসমান ক্রেনের ধারণ ক্ষমতা ৩ হাজার ৬শ’ টন। বাংলাদেশে ভাসমান ক্রেন হিসেবে কোরিয়ান উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ও নির্ভীকের ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার ৪শ’ টন করে। আর চীনা এই ক্রেনের ক্ষমতা আড়াই গুণেরও বেশি। এই ভারি যন্ত্রটি চলে আসায় এখন সুপার স্ট্রাকচার স্থাপনের সব আয়োজনের সমাবেশ প্রায় সম্পন্ন। এখন ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের কাজ চলছে পুরোদমে। এই দু’পিলারের উপরই বসে প্রথম সুপার স্ট্রাকচার। ৩৭ নম্বর পিলারে কাজের অগ্রগতি অনেক এগিয়ে। পিলার সম্পন্ন হওয়ায় এখন পিয়ারের কাজের প্রস্তুতি চলছে। এই পিয়ার হলেই পিলার সম্পন্ন হবে। পরে বসবে সুপার স্টাকচার। পদ্মার ৩৭ নম্বর পিলারের পাইল গ্রুপ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন থেকেই আরও দেড় শ’ ফুট (৩৫ মিটার) উঁচু পিলার বসবে। আর পিলারের উপরেই বসবে সুপার স্ট্রাকচার (স্প্যান)। আর এই পিলার গ্রুপটি দীর্ঘ ১২৮ মিটার। এর মধ্যে নদীর তলদেশ থেকে মাটির নিচে রয়েছে ১শ’ ২২ মিটার। আর ছয় মিটার পানির মধ্যে। বর্তমান পানির লেভেল থেকে পাইল গ্রুপটির উপরি অংশ রয়েছে ছয় ফুট পানির নিচে। এখানে যাতে পানি ঢুকতে না পারে এমনভাবেই রাখা হয়েছে। আর পাইল গ্রুপে নামার জন্য রয়েছে সিঁড়ি। পদ্মা সেতুর পাইল গ্রুপ সম্পন্ন হওয়া এটি প্রথম পিলার। এখান থেকেই পিয়ার তৈরির কাজ চলছে। আর ৩৮ নম্বর পিলারের কাজও দ্রুততার সঙ্গে চলছে। এখানে চারটি পাইল সম্পন্ন হয়ে গেছে। বাকি দু’টিও হওয়ার পথে। সম্প্রতি জার্মানি থেকে আসা ২ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার নতুন হ্যামার ৩৮ নম্বর পাইল স্থাপনে ব্যস্ত রয়েছে। আর পুরনো ২ হাজার ৪শ’ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটি এই সুযোগে সার্ভিসিং করা হচ্ছে। নতুন হ্যামারটি সপ্তাহখানেক আগে চালু করা হয়েছে। এটির আউটপুট ভাল বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এদিকে পদ্মা সেতুর অন্যান্য প্যাকেজেও অগ্রগতি রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমের নদী শাসনের কাজও পুরোদমে শুরু হয়েছে। বুধবার জাজিরা প্রান্তে ৮শ’ কেজির প্লাস্টিক বস্তা ফেলা শুরু হয়েছে। মাওয়া প্রান্তে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয় গত কয়েকদিন আগেই। উচ্চ ক্ষমতার এই ড্রেজার ঘণ্টায় ৪/৫ হাজার মিটার কিউবিক মাটি অপসারণ করছে। ড্রেজিং সম্পন্ন হলেই ফেলা হবে কয়েক ধাপে বস্তা। পাঁচ লেয়ারে ৮শ’ কেজির বস্তা ফেলা হবে সেখানে। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী রজব আলী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন মাওয়া প্রান্তে সেতুর আধুনিক টোল প্লাজার কাজ সম্পন্ন প্রায়। তবে এখনও অফিসিয়ালি এটি বুঝে নেয়া হয়নি। এছাড়া জাজিরা প্রান্তে টোল প্লাজার কাজের অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ। জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্টের কাজও পুরোদমে চলছে। সংযোগ সেতুর পাইলের তলদেশের অবস্থা নিশ্চিত করার জন্য অত্যাধুনিক ইকো সাউন্ডার যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এই যন্ত্র ব্যবহারসহ নানা কারণে জাপানী উচ্চ পর্যায়ের টেকনিশিয়ান মাওয়ায় দশ দিন অবস্থানের পর শুক্রবার সকালে ফিরে গেছেন। চার সদস্যের এই দলটির চার দিন থাকার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে তাদের ১০ দিন অবস্থান করতে হয়েছে। এতে কাজের বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। এদিকে তিন দিনব্যাপী পদ্মা সেতুর প্যানেল অব এক্সপার্ট সভা গত শনিবার শেষ হয়েছে। এই সভাটি সেতুর কাজের জন্য খুবই সফলজনক বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রায় চার মাস পরে এই টিম সরেজমিনে সভা করেছেন। এতে বিদেশী পাঁচ বিশেষজ্ঞসহ ১০ বিশেষজ্ঞ অংশ নেন। এর আগের প্রকল্প এলাকার এই সভা হয়েছিল ১৪ থেকে ১৬ জুলাই। এর আগের সভাটি হয়েছিল গত এপ্রিলে। ৩৭ নম্বর পিলারে সম্পন্ন হওয়া পাইল স্থাপন অনুমোদন দিয়েছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। তাই টিমের নির্দেশনা অনুযায়ী কংক্রিটিং এবং পিয়ার স্থাপন শীঘ্রই হবে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, সেতুর অগ্রগতির জন্য প্যানেল অব এক্সপার্ট সভাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সভাটিতে সুপার স্ট্রাকচার স্থাপন এবং অন্যান্য অগ্রগতি ও সমস্যা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সভায় উপস্থিত দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, সুপার স্ট্রাকচার স্থাপনেও একটি পরিবর্তন আনা হয়েছে তিন দিনের এই সভায়। প্রথম স্প্যান সুপার স্ট্রাকচার জাজিরা প্রান্তে এবং দ্বিতীয় স্প্যানটি মাওয়া প্রান্তে স্থাপনের ব্যাপারে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ছিল। এখন নাব্য সঙ্কটের কারণে জাজিরা প্রান্তে ব্যবহৃত ভারি যন্ত্রপাতিগুলো মাওয়া প্রান্তে আনা যাচ্ছে না। তবে ড্রেজিং চলছে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে। তাই দ্বিতীয় স্প্যানটিও জাজিরা প্রান্তে স্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত এসেছে। পরিদর্শনের পর বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার এই বিশেষঞ্জ দল দিনভর সভা করেন জাজিরা প্রান্তে সার্ভিস এরিয়া-২ এ। দেশের সর্ববৃহত প্রকল্পটির নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠেছে এতে। যার সমাধান দেয়া হয় সভা থেকেই। শনিবার বিশেষজ্ঞ দল সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পদ্মায় সেতুর নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করেন। পরে সাড়ে ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত চূড়ান্ত সভা করেন মাওয়া প্রান্তের দোগাছির সার্ভিস এরিয়া-১ এ। পরে দলটি বেলা পৌনে ৩টায় বিশেষ নিরাপত্তায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়।
×