ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ ভিডিও কনফারেন্সে চবির সুবর্ণজয়ন্তী উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

বর্ণিল শোভাযাত্রায় দুই প্রজন্মের মহামিলন

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

বর্ণিল শোভাযাত্রায় দুই প্রজন্মের মহামিলন

রহমান শোয়েব, চবি ॥ ‘আমি আজ আবার তরুণ হয়ে গিয়েছি। এত এত তরুণের মধ্যে আনন্দ উল্লাস আর হই-হুল্লোড়ে আমি আর বর্তমানের আমি নেই। আমার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ফিরে গিয়েছি। অসাধারণ লাগছে। এত ভাল লাগছে যে, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে শামিল হয়ে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। শুধু আনিসুল হকই নন, এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠের সাবেক-বর্তমান হাজার হাজার নবীন-প্রবীণের একই অভিব্যক্তি। সবাই মিলে নেচে-গেয়ে উদযাপন করছেন চবির সুবর্ণজয়ন্তী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৮ নবেম্বর শুক্রবার পূর্ণ করেছে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর। আজ শনিবার পা রাখছে একান্ন বছরে। ৫০ বছর পূর্তিতে ‘সুবর্ণজয়ন্তী শোভাযাত্রা’ শুরু হয় বিকেল তিনটায়। চট্টগ্রাম নগরীর বাদশা মিয়া রোডের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু হয় শোভাযাত্রা। বেলুন উড়িয়ে শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। শোভাযাত্রাটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সিআরবি শিরীষতলায় গিয়ে শেষ হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন চবির সাবেক শিক্ষার্থী, বর্তমান শিক্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে নবীন-প্রবীণদের মিলনমেলার বর্ণিল শোভাযাত্রা শুরু হয় বিভিন্ন সাজে। হাতি, ঘোড়ারগাড়ি, রিক্সা, ভ্যান সাজিয়ে এতে অংশ নেন নবীন-প্রবীণরা। ঢোল আর বাদ্য বাজিয়ে নেচে-গেয়ে, বেলুন আর ব্যানার হাতে, হই-হুল্লোড় করে মাতিয়ে তোলেন পুরো চট্টগ্রাম শহর! কে বুড়ো কে তরুণ! বয়সের কোন ধরাবাধা নিয়ম নেই। সবাই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নবীন-প্রবীণ বলে কোন কথা নেই। সবাই আজ ১৮ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ। একসঙ্গে দল বেঁধে নেচে-গেয়ে, স্লোগানে স্লোগানে মাতিয়ে তোলেন পুরো এলাকা। কারও কারও সঙ্গে দেখা নেই ২৫ বছর, কারও সঙ্গে হয়তবা তারও বেশি সময়। আজ সেই পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা। কত আবেগ, কত স্মৃতি তাদের সঙ্গে। তেমনই একজন সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন আলম ও চাকসুর সাবেক এজিএস জানে আলম। তাদের মধ্যে গিয়াস উদ্দিন পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের এবং জানে আলম ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। দু’জনই ছিলেন ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। দুজনে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলেন। কথা বললেন ভালবাসা আবেগের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। তারা বললেন, ‘ভীষণ ভাল লাগছে। এত ভাল লাগছে যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বহুদিন পর পুরনো বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা। মনে হচ্ছে যেন এই তো সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। এ আবেগ বলে বুঝাবার নয়।’ শোভাযাত্রার কিছু দূরেই দেখা গেল ইংরেজীতে ‘উই আর স্টিল এলাইভ’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে উচ্ছ্বসিত ঢঙে নেচে-গেয়ে শিরীষতলা পানে যাচ্ছেন একদল তরুণ। সঙ্গে আছেন প্রবীণরাও। পরনে সবার একই রঙের টি-শার্ট। কেন এমন প্ল্যাকার্ড? জানতে চাইলে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ’৯৮-৯৯ শিক্ষাবর্ষের সাবেক শিক্ষার্থী জানালেন, ‘আমরা এখনও হারিয়ে যাইনি। এ বিশ্ববিদ্যালয়কে জীবনেও ভোলার নয়। আমরা আছি, থাকব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এখনও খুবই এ্যাক্টিভ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া বন্ধুদের আমরা হারাতে চাই না কখনও। আমরা যে এখনও আছি সেটি বুঝাতেই এ প্ল্যাকার্ড।’ কথা হলো দৈনিক যুগান্তরের ডেপুটি এডিটর আহমেদ দিপুর সঙ্গে। শোভাযাত্রায় ছিলেন দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু শেরগুল আহমেদ জনি। জনি ছিলেন সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র। দুজনেই ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দিপু পড়েছেন বাংলা বিভাগে। থাকতেন সোহরাওয়ার্দী হলে। তিনি জানান, ‘যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন প্রতিটি ইঞ্চিতে আমার পদচিহ্ন পড়েছে। আজ আবার ২৫-২৬ বছর পর এসেছি, অনেক পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো। কাল (আজ) ক্যাম্পাসে যাব। আমি সোহরাওয়ার্দী হলের ১০৯, ১১০ নম্বর কক্ষে থেকেছি। সেখানে যাব। বন্ধু ও বর্তমানদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠব।’ তবে কিছুটা আক্ষেপও আছে এই সাংবাদিকের কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কিন্তু আজ ও কাল দুই দিন এর জন্য যথেষ্ট নয়। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবার এতদিনের ক্ষুধা তো আর একদিনে মিটে না।’ এভাবেই হাজার হাজার তরুণ নিজেদের আবেগ ভালবাসা সঙ্গে নিয়ে চলেছেন সিআরবি শিরীষতলার পানে। নিজ নিজ ভঙ্গিতে উপভোগ করছেন প্রিয় বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। কেউ কেউ আবার এসেছেন ঘোড়ারগাড়ি নিয়ে। তেমনই একজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১০নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুর। কণ্ঠে তার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা।’ তারা সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেল, ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়েছেন রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। ঘোড়ারগাড়িতে একঝাঁক বান্ধবী নিয়ে রাজকীয় হালে চলেছেন তিনি। বান্ধবীদের মধ্যে ছিলেনÑ রূপা গুহ, আরিফা ইসলাম, লুবনা হারুন। সেখানেই মনসুর নেচে-গেয়ে সেই তরুণ বয়সের মতো মাতিয়ে রাখছেন বান্ধবীদের। তিনি বললেন, ‘কতটা ভাল লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এক কথায় ওয়াও! অসাম!’ কথা হয় তরুণ বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও। প্রবীণদের পেয়ে তারাও দারুণ উচ্ছ্বসিত। দুই প্রজন্মের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না। সবাই সমানতালে নাচছে গাইছে। চবির বর্তমান শিক্ষার্থী আবিদ রব। ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বললেন, ‘অসাধারণ লাগছে। এখানে অনেক সাবেকরা এসেছেন। তাদের অনেকেই আজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রবাসীরাও এসেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ভালবাসা তাদের এতটুকু কমেনি। আজকের আনন্দের এ সুখস্মৃতি ছড়িয়ে দিতে আমি আগামী শতবছর পূর্তিতেও থাকতে চাই।’ সুবর্ণজয়ন্তীর সব শোভাযাত্রা গিয়ে থেমেছে শিরীষতলায়। সেখানে বক্তব্য রাখেন চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীসহ সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং চবির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্ষদের ব্যক্তিবর্গ। শিরীষতলায় শোভাযাত্রার সমাপ্তির পর নগরীর জিইসি মোড়ের জিইসি কনভেনশন সেন্টারে সাবেকদের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে সাবেকদের আড্ডা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাবেকদের সম্মানে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন দেশবরেণ্য শিল্পী রুনা লায়লা। অনুষ্ঠানের প্রথম দিনে শোভাযাত্রা শেষে চবি উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান সকলের। এখানে সাবেক ও বর্তমানদের সহযোগিতা না থাকলে এতবড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হতো না। এজন্য সকলের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী ॥ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে বানানো হয়েছে মঞ্চ। মঞ্চের পেছনেই আয়োজন করা হয়েছে সাবেক শিক্ষার্থীদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা। এছাড়া মাঠের চারপাশে বসানো হয়েছে বিভাগসমূহের বুথ। সাবেক শিক্ষার্থীরা এসব বুথ থেকেই টোকেন সংগ্রহ করে খাবার ও সুবর্ণজয়ন্তীর ব্যাগ, সুভ্যেনির সংগ্রহ করবেন। এছাড়া বর্তমান শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ হল থেকে টোকেন সংগ্রহ করে খাবার সংগ্রহ করবেন। তবে যারা রেজিস্ট্রেশন করেননি তারা এ সুবিধা পাবেন না। সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাসহ চবির ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা প্রদান করা হবে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এ সম্মাননা প্রদান করা হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এছাড়া সুবর্ণজয়ন্তীতে বক্তব্য প্রদান করবেন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। উপস্থিত থাকবেনÑ গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং চট্টগ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এতে সভাপতিত্ব করবেন চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।
×