ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চবিতে মিলনমেলা

কোথায় ছিলে বন্ধু, তোমায় খুঁজেছি কতো দূর অজানায়...

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

কোথায় ছিলে বন্ধু, তোমায় খুঁজেছি কতো দূর অজানায়...

মাকসুদ আহমদ ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রথম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ভিন্ন মাত্রার। এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দীর্ঘ ৫০ বছর পার হয়ে আসা শিক্ষার্থীরা আজও তাদের ছেলেপুলে, নাতি-নাতনির কাছে গর্ব করে বলেন,‘আমরা এ দেশের এমন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, যার সঙ্গে অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা হয় না...।’ শুধু আকার আয়তনেই নয়, পাহাড় সবুজে ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে গড়ে উঠেছে এর আঙ্গিনা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা ক্যাম্পাস নিজ চোখে ঘুরে দেখার শখ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরও। শহুরে আঙ্গিনায় গড়ে তোলা হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে পাহাড়, লেক আর জলধারা। তাই বড়াই করে অনেকেই বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কারণ এখানে শুধু পড়ালেখাই নয়, প্রকৃতির কাছ থেকেও শেখার রয়েছে অনেক কিছু। ফলে চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের প্রথম টার্গেটই থাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চির সবুজের আদলে গড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু যে কবি সাহিত্যিকদের মন কাড়ে তা নয়। ভালবাসার অদৃশ্য আলিঙ্গন রয়েছে এখানকার প্রকৃতিতে। সবুজ শ্যামল আর ছায়াঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতির এক উপহার। যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পদধূলি রাখার সুযোগ পেয়েছেন তাদের জীবন সায়াহ্নে এসে কখনও জাগতিক ও মানসিক বেগ পেতে হয়নি। কারণ প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম-ভালবাসার অপার সুযোগ রয়েছে এই আঙ্গিনায়। এখানকার বিশাল ক্যাম্পাস যেন আপনা আপনি প্রকৃতির অপার মহিমায় গড়ে উঠেছে। কলেজের গ-ি পেরুলেই চলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আপ্রাণ চেষ্টা-ভর্তিযুদ্ধ। কারও কারও মধ্যে থাকে রাজধানীর বুক চিরে গড়ে ওঠা ইট সিমেন্টের অট্টালিকার আকর্ষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বাসনা। আবার যারা প্রকৃতির প্রেম-ভালবাসায় নিজেকে গড়ে তুলতে চায় তারা ওই বাসনাকে উপড়ে ফেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগটুকু নিতে চায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা ৫০ বছর আগে বের হয়ে এসেছেন তারা যেমন এবার জাঁকজমকপূর্ণ সুবর্ণজয়ন্তীতে অংশ নিয়েছেন তেমনি বছরখানেক পার হয়নি এমন শিক্ষার্থীরাও হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন এর বিশাল আঙ্গিনায়। শুধু সহপাঠীদের এক পলক দেখার নিমিত্তে। সকলেরই একই কথা ‘কোথায় ছিলে বন্ধু, তোমায় খুঁজেছি কতো দূর অজানায়’। তবে পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করতেই আজ শনিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নবীন-প্রবীণের মিলন-মেলার মহাসমুদ্রে পরিণত হবে। রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আসা ১৯৬৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার এবং চলমান শিক্ষা জীবনের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আরও প্রায় ২৪ হাজার শিক্ষার্থীর এই মিলনমেলা । শহর থেকে প্রতিদিন চারটি শাটল ট্রেনে চেপে ২২ কিমি উত্তরে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা পৌঁছায় বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনে। কাকডাকা ভোরের সেই শাট্ল ট্রেনে সকাল ৭টা ১০ মিনিটে এক সময় চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে প্রথম ট্রিপ চলে যেত। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী। এই ট্রিপে ট্রেনটি শতভাগ শিক্ষার্থী নিয়ে যেতে পারত না। কারণ ঘুম থেকে উঠেই কোন রকমে শাট্ল ট্রেনের শক্ত সিটে আসন পেতে তাড়া থাকত বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের। তবে বাণিজ্য কিংবা কলা অনুষদের শিক্ষার্থীরাসহ অন্যান্য অনুষদের শিক্ষার্থীরা চেপে বসত সকাল ৮-১০ মিনিটের শাট্লে। মাত্র ৭ থেকে ৮টি কোচের শাট্ল ট্রেনে শিক্ষার্থীরা তাদের সহপাঠী বন্ধুদের জন্য সিট দখল করে চলে যেত ঝাউতলা স্টেশন ও ষোলশহর স্টেশন পর্যন্ত। তবে এই সিট দখলে তখনকার দিনে কোন বাগ্বিত-া ছিল না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এটি কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ আমি তো কাল তুমি। এভাবেই চলছে শাট্ল ট্রেনের জীবন, দিনের পর দিন। এ ট্রিপে ছিল সবচেয়ে বেশি চাপ। তবে সকাল সাড়ে ১০টা বা সাড়ে ১১টার ট্রিপে কোন ঝামেলা ছিল না। অনেকটা খালিই যেত ট্রেনটি। সকাল ৭টার শাটল ট্রেনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে পৌঁছানো মাত্র শিক্ষার্থীরা দৌড়ে যেত ঝুপড়ির আদলে গড়া হোটেলগুলোতে। যেখানে ১/২টাকায় সিঙ্গারা, সমুচা কিংবা ৫ টাকায় সকালের নাস্তার ব্যবস্থা ছিল ৯০-এর দশকেও। বিশেষ করে ‘মউর দোয়ান’ এর প্রতি টার্গেট ছিল সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর। এর কারণ, এ দোকানে কখনও সিঙ্গারা বা সমুচা গুনে দেয়া হতো না। এ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ইচ্ছেমতো সিঙ্গারা সমুচা দিয়ে পুষিয়ে দিচ্ছে দোকানি। বন্ধু-সহপাঠীদের নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে যে যার ইচ্ছেমত গুনে টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে দোকানিকে। সেই আরাম আয়েশ বা বড় মনের দোকানি শহরে মেলে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক প্রধান ফটক ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ছাউনি দোকান। এ ফটক থেকেই কেউ রিক্সায়, আবার কেউবা ক্যাম্পাসের বাসে চড়ে এক সময় যেতে পারলেও এখন ক্যাম্পাসের ভেতরে বাস চলাচল করছে না। তবে রিক্সায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে নির্দিষ্ট ভাড়ায়। এক সময় শাহজাহান হল, শাহ আমানত হল, এফ রহমান হল ঘুরে শরীর চর্চা কেন্দ্রের সামনে দিয়ে কলা ভবন ও বিজ্ঞান অনুষদের দিকে চলে যেত বাস। তবে ফরেস্ট্রি বিভাগের জন্য আলাদা বাস ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে বাঁ দিকে। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে দু’ধারে পাহাড়বেষ্টিত ছড়া দিয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে মাটির রাস্তায় শহীদ মিনার পার হয়ে ক্যাম্পাসে হেঁটে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে এটি প্রথমে ইটের সোলিং ও পরে পিচ ঢালাই রাস্তায় পরিণত হয়েছে। এখন আর ওইসব দর্শনীয় হল ঘুরে যেতে হয় না শিক্ষার্থীদের। তবে এ সড়কে এখনও পায়ে হেঁটে চলার অভ্যাস রয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের। দুপুর গড়িয়ে বেলা প্রায় সাড়ে ১২টা কি পৌনে ১টা। ক্যাম্পাস থেকে জ্ঞান অর্জন শেষে শিক্ষার্থীরা বাড়ি ফেরার পালায় যেন আরেক প্রতিযোগিতায় নামে ১টা ২০ মিনিটের শাট্ল ট্রেনের জন্য। যে যার মতো ট্রেনে সকালের মতোই সিট দখল করার প্রবণতা থাকলেও এক্ষেত্রে কিছুটা বাগ্্বিত-া লেগে যায় একটি ব্যাচের সঙ্গে অপর ব্যাচের শিক্ষার্থীদের। সিনিয়র জুনিয়রের এই পালায় যেন শিক্ষার্থীরা কেউ হার মানতে নারাজ। সকলেই চায় নিজের কোলে ঝোল টেনে অন্যকে চুপ করিয়ে দিতে। ২০১০ সালের পর কোচভিত্তিক রাজনীতি শুরু হলে কোচের সিট দখল নিয়ে অনেক মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। শাটল ট্রেনে বিভিন্ন কোচের নাম দেয়া হয়েছে সিক্সটি নাইন, কশপিট ইত্যাদি। শুধুই যে শিক্ষার্থীরা ট্রেনে চড়ে যাচ্ছে তা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন শিক্ষার্থীদের জন্য বাস যেমন বরাদ্দ দিয়েছে, তেমনি গণপরিবহন ও নিজস্ব পরিবহনে চলে যাচ্ছে বিশাল এই বিদ্যাপীঠে। কি নেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে-এমন প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা জবাব দিয়ে থাকেন নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রয়েছে ঝর্না ও গহীন অরণ্য। তবে পাখ-পাখালির কুহুতান আর হরিণসহ বিভিন্ন ছোট প্রাণীর বিচরণ রয়েছে বিভিন্ন অংশে। প্রায় সাড়ে ১৭শ’ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠা এ ক্যাম্পাসে ছোট লেক, জলাশয়, বিশাল পাহাড় আর বনের বেস্টনিতে প্রকৃতির সব ধরনের স্বাদ নিতে পারে শিক্ষার্থীরা। শাল, মেহগনি, সেগুন আর জারুল যেমন রয়েছে, তেমনি কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে মোহিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ১৯৬৬ সালে ১৮ নবেম্বর হাটহাজারীর সুবরবন এলাকায় গড়ে উঠেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ১ হাজার ৭৫৩ দশমিক ৮৮ একর পাহাড়ী এলাকায় গড়ে উঠা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে কিয়দংশে রয়েছে প্রাকৃতিক হ্রদ। গড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, মিউজিয়াম, কাঠের ঝুলন্ত ব্রিজ ছাড়াও রয়েছে নানা সুবিধাদি শিক্ষার্থীদের জন্য। ৮ ফ্যাকাল্টিতে বর্তমানে ৪৩টি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। এছাড়াও ৭টি ইনস্টিটিউট, ৫টি রিসার্চ সেন্টার, ১টি মেডিসিন ফ্যাকাল্টি, ১টি অপথালমোলজি ইনস্টিটিউট। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় রয়েছে ২২টি কলেজ। শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম, এমবিবিএস, বিএসসি ইন (টেক্সটাইল, মেডিক্যোল টেকনোলজি এ্যান্ড নার্সিং), পিজিডি, ডিপ্লোমা এবং কিছু সার্টিফিকেট কোর্সও রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য। জীবন গড়ার এই বিদ্যাপীঠে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে অনেকের এমফিল, পিএইচডি, এমডি এবং এমপিএইচ ডিগ্রী নেয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসন সঙ্কট নিরসনে ৮টি পুরুষ ও ৪টি মহিলা হল রয়েছে। এছাড়াও আছে একটি হোস্টেল। এখানে বর্তমানে ২৩ হাজার ৮৭৬ জন শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত, এমন পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে।
×