ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাগলামি ছাড়া সৃষ্টিশীল কোন কাজ হয় না ॥ ভিএস নাইপল

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

পাগলামি ছাড়া সৃষ্টিশীল কোন কাজ হয় না ॥ ভিএস নাইপল

মনোয়ার হোসেন ॥ রাজধানীতে চলছে সাহিত্য উদ্্যাপনের অনন্য এক আয়োজন। তবে সাহিত্যের এই উদ্যাপন যে খুব গুরুগম্ভীর তেমন নয়। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধসহ সমকালীন বিশ্বের নানা বিষয় উঠে আসছে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে। সেই সঙ্গে চলছে গল্পকারের গল্প বলা, শিল্পীর কণ্ঠে পালাগান-জারি গান, কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, অভিনয়শিল্পীর মঞ্চ নাটকের অভিজ্ঞতাসহ বৈচিত্র্যময় নানা অনুষ্ঠান। এভাবেই ঢাকা লিট ফেস্ট সাহিত্যের সূত্র ধরে শিল্পের সংযোগে হয়ে উঠেছে বৈভব। শ্রোতা-দর্শক চাইলেই অংশ নিতে পারছেন আপন মননের উপযোগী যে কোন অধিবেশনে। বৃহস্পতিবার থেকে বাংলা একাডেমির পাঁচটি মঞ্চে শুরু হওয়া এ সাহিত্য উৎসবের দ্বিতীয় দিন ছিল শুক্রবার। এদিনের অধিবেশনের সূচনা হয় আধ্যাত্মিক গানের পরিবেশনা দিয়ে। শেষ হয় এ বছরের সাহিত্য শাখায় নোবেলজয়ী কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী বব ডিলানকে নিবেদিত গানের মাধ্যমে। তার আগে দিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধিবেশনটিতে ছিল ত্রিনিদাদের নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিক ভি এস নাইপলের কথোপকথন। ঘণ্টাব্যাপ্তির আলোচনায় সাহিত্য অনুরাগী শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন ত্রিনিদাদ থেকে যুক্তরাজ্যে আবাস গড়া এই কিংবদন্তি কথাশিল্পী। নাইপলের মুগ্ধতা ছড়ানো অধিবেশন ॥ ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা ছয়টা পেরিয়েছে। লিট ফেস্টের মূল মঞ্চ আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন তখন কানায় কানায় পূর্ণ। আসন না পেয়ে ভিএস নাইপলের কথা শোনার অপেক্ষায় অনেকেই বসে পড়েছেন মিলনায়তনের মেঝেতে। আর হুইল চেয়ারে চেপে যখন মঞ্চে এলেন নাইপল, তখন করতালির পাশাপাশি সবাই দাঁড়িয়ে অভিবাদন ও সম্মান জানালেন বিশ্বখ্যাত এই কথাশিল্পীকে। সঙ্গে এলেন লেখকের স্ত্রী নাদিরা নাইপল। প্রায় এক ঘণ্টার কথনে উন্মুখ সাহিত্য অনুরাগীদের সামনে তুলে ধরলেন তাঁর লেখক জীবনের অভিজ্ঞতা। গুরুগম্ভীর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পাশাপাশি হাস্যরসাত্মক আলোচনায় অধিবেশনটিকে করে তুললেন প্রাণবন্ত। মুহুর্মুহু করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মিলনায়তন। যে কোন সৃষ্টিকর্মের নেপথ্যে উন্মাদনার কথার উল্লেখ বলেন, সৃষ্টিশীল যেকোন কাজের পেছনে কাজ করে অদ্ভুত পাগলামি। আর পাগলামি ছাড়া কোন সৃষ্টিশীল কাজ হয় না। উৎসব পরিচালক আহসান আকবর সঞ্চালিত অধিবেশনের শিরোনাম ছিল ‘দ্য রাইটার এ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’। নিজের লেখক হওয়া প্রসঙ্গে ভিএস নাইপল বলেন, আমার লেখালেখির জীবনটা ছিল জাদুর মতো। আমি ভাগ্যবান, আমি সেই পথে হেঁটেছি। আমি লেখক হতেই চাইতাম। আমার লেখক বাবাকে দেখে সেই ইচ্ছা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম না, কি লিখব। আমার অনেক লেখায় আমার বাবার জীবন কাহিনীর ছাপ রয়েছে। লেখক হওয়ার প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে নাইপল বলেন, শুরুতে কি লিখব, তার কিছুই জানতাম না। কিন্তু লিখব, এটা জানতাম। আমি বুঝতে পারলাম, এজন্য আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। আমার কাছে বিষয়টি খুব বিব্রতকর ছিল। লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। নিজের ব্যাপারে নিজেই বিরক্ত হতাম। এক সময় বিবিসির লন্ডন অফিসেরর ডার্করুমে বসে টাইপরাইটারে বসে লিখতে শুরু করলাম। এবং নিজেকে বললাম, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত এ ঘর ত্যাগ করব না, যতক্ষণ পর্যন্ত না জানি আমার লেখাটি কি দাঁড়াচ্ছে। লেখালেখির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কৌতুক করে নাইপল বলেন, আমি যে লেখালেখি করেছি, তা ‘ননসেন্স’ ছাড়া আর কিছুই না। আবার এটাও বলতে হয়, কোন কিছুই খুব সহজ না। অনেক চিন্তাভাবনা করে, তারপরেই একটা কিছু দাঁড়ায়। একটা সময় আমি বুক পকেটে নোটবই নিয়ে ঘুরতাম এবং যাদের ভিন্নরকম মনে হতো, তাদের সঙ্গে কথা বলতাম এবং সেগুলো লিখে রাখতাম। ভিএস নাইপলের বক্তব্যের মাঝখানে তাঁর বিখ্যাত বই ‘এ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস’র পা-ুলিপি নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা বলেন নাদিরা নাইপল। তিনি বলেন, এই বইটির পা-ুলিপি ভুল করে রান্নাঘরে ফেলে আমরা প্যারিস চলে গিয়েছিলাম। তার আর কোন কপি ছিল না। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এ পা-ুলিপির কথা মনে পড়ে যায় এবং সেটি উদ্ধারের ব্যবস্থা করি। পরবর্তীতে এ বইটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। দিনের অন্যান্য অধিবেশন ॥ ৯০ অধিবেশনে সাজানো সম্মেলনে দ্বিতীয় দিনে অনুষ্ঠিত হয় ৩৭ অধিবেশন। সকাল ৯টায় কেকে টি স্টেজে মারফতি গানের পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় এদিনের সম্মেলনের কর্মসূচী। এ পর্বে গান শোনান আশরাফ উদ্দিন আলী চিশতি ও তাঁর দল। সকাল ১০টায় প্রধান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় সাধনার শিল্পীদের পরিবেশিত লোকনৃত্য। একই সময়ে কেকে টি স্টেজে ‘ইন আদার ওয়ার্ডস : লাইব্রেরি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক অধিবেশনে ২০০১৬ সালের ম্যান বুকার পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিক ডেবোরা স্মিথ, অরুনাভ সিনহা, চার্লস টার্নার ও কায়সার হক উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন ড্যানিয়েল হার্ন। একই সময়ে একাডেমির বর্ধমান হাউসের লনে ছিল ইংরেজী কবিতার আবৃত্তি। এতে কবিতা পড়ে শোনান শেহজার দোজা, সৈয়দা আহমদ, ফাতেমা হাসান, জেফরি ইয়াং ও আহমাদ জান ওসমান। একই সময়ে ব্র্যাক মঞ্চে ম্যাক্স রোডেন বেকের সঞ্চালনায় ‘ক্যান ইন্ডিয়া স্পিক’ শীর্ষক অধিবেশনে আলোচনা করেন নারেশ ফারনান্দেজ, মঞ্জুলা নারায়ণ ও শ্রীরাম কারি। এ আলোচনায় মূলত ভারতের গণতন্ত্রের চর্চা ও কাশ্মীর প্রসঙ্গ উঠে আসে। একই সময়ে কসমিক টেন্টে প্রদর্শিত হয় তথ্যচ্চিত্র ‘ব্লকেড’। তথ্যচিত্রটিতে বাংলাদেশের বাইরের অনন্যা সমাজ ১৭৭১ সালে পাকিস্তানের নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিবাদ করেছিলÑ সে বিষয়টি উঠে আসে। একই সময়ে বটতলায় ছিল গল্প বলার আসর। এ পর্বে হাঁসের পায়ে ঘুড়ি শিরোনামের গল্প বলেন নাজিয়া জাবিন। সোয়া ১১টায় মূল মঞ্চে ‘দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড ডিজওর্ডার’ শীর্ষক আলোচনায় অনুষ্ঠিত হয়। জাস্টিন রোলাটের সঞ্চালনায় এ বিষয়ে আলোচনা করেন ম্যাক্স রোডেন বেক, বেন জুদা, রোজামান আরউইন ও ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান। নাইন/ইলেভেনের পর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ ঘোষণা এবং তাদের শত্রু রাষ্ট্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়গুলো উঠে আসে। একই সময়ে কেকে টি স্টেজে নারী ও নারীত্ব বিষয়ক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক উদিসা ইসলামের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন নাসিমা আনিস, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পাপড়ি রহমান ও সাদিয়া মাহজাবিন ইমাম। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবস্থান কি হবে এবং নারীর অবস্থান পরিবর্তনের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয় এ অধিবেশনে। একই সময়ে লনে কার্তিকা ভিকের উপস্থাপনায় কথোপকথনে অংশগ্রহণ করেন পুলিৎজারজয়ী সাহিত্যিক বিজয় শেষাদ্রী। একই সময়ে ব্র্যাক মঞ্চে সুফি সোল শীর্ষক আলোচনায় আমিনা ইয়াকিনের সঞ্চালনায় অংশ নেন সাদিয়া দেলভি ও অধ্যাপক সলিমউল্লাহ খান। বেলা দুইটায় মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাহিত্য যখন সবার’ শীর্ষক অধিবেশন। আন্দালিব রাশদীর সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইমতিয়ার শামীম। ইমদাদুল হক মিলন বলেন, প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য সবার জন্য নয়। যদি সবার জন্য হতো, যদি সবার কাছে পৌঁছাতে পারত, তবে বদলে যেত পৃথিবী। থাকত না হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ। আমি মনে করি, সাহিত্যের কাজ হচ্ছে মানুষের মনোজগতকে পরিবর্তন করা। মঈনুল আহসান সাবের বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সাহিত্য সবার কাছে পৌঁছুতে পারে না। সেটা পারবেও না। তবে লেখকরা আকাক্সক্ষা করেন তাঁদের সৃষ্টিকর্ম সবাইকে স্পর্শ করুক। ইমতিয়ার শামীম বলেন, কোন লেখকই পাঠকের কথা ভেবে লেখেন না। লেখক তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা, অনুভূতির দিকে চেয়ে সৃষ্টি করেন সাহিত্যকর্ম। সেই সাহিত্য সবাইকে স্পর্শ করতে না পারলেও অন্তত কিছু মানুষকেও যদি তাড়িত করে সেটাই হবে সাহিত্যিকের স্বার্থকতা। বেলা দুইটায় লনে অনুষ্ঠিত হয় ‘মঞ্চ যখন আমার শিরোনামের’ অধিবেশন। অভিনেত্রী বন্যা মির্জার সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন মঞ্চনাটরে তিন গুণী শিল্পী সারা যাকের, মিতা হক ও সামিনা লুৎফা। এ পর্বে সারা যাকের বলেন, শুধুমাত্র শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক করলে হবে না, নাট্য প্রদর্শনী ছড়িয়ে দিতে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। তিনি আরও বলেন, শিল্পের কোন সীমা নেই। তাই কোন বিদেশী গল্প আশ্রিত করে আমরা নাটক করি সেটাকেও নিজের মনে করি। কারণ, নাটকের ফর্মটা আমরা নিজেদের মতো করে গড়ি। নাটক হতে পারে সমাজ বদলের হাতিয়ার প্রসঙ্গে সামিনা লুৎফা বলেন, শুধু নাটক দিয়ে সমাজ বদল সম্ভব না। সমাজ বদলে একই সঙ্গে শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন। তাই প্রতিটি সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নাট্যকর্মীদেরও থাকতে হবে সামনের সারিতে। দুপুর সোয়া তিনটায় কেকে টি স্টেজে অনুষ্ঠিত হয় ‘টিকে থাকার আজ কাল পরশু’ শীর্ষক অধিবেশন। পশ্চিমবঙ্গের নিউরো সায়েন্টিস্ট গার্গো চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন ফিরোজ আহমেদ, চলচ্চিত্রকার ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী, সাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল ও মানস চৌধুরী। একই সময়ে লনে ‘জীবনের কবিতা’ শীর্ষক আলোচনায় নিজের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে কথা বলেন, নন্দিত কবি নির্মলেন্দু গুণ। অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন শামীম রেজা। বিকেল সাড়ে চারটায় বটতলায় বসেছিল বয়াতী শাহ আলম ও তাঁর দলের পালা গানের আসর। আজ শনিবার ঢাকা লিট ফেস্টের শেষ দিন। এদিনের মূল আকর্ষণ হিসেবে বিকেল সাড়ে ৫টায় মূল মঞ্চে প্রদান করা হবে জেমকন সাহিত্য পুরস্কার। সাড়ে ৬টায় সমাপনী অনুষ্ঠান ও রব ফকিরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ হবে এ সাহিত্য সম্মেলন। যান্ত্রিক আয়োজিত ঢাকা লিট ফেস্টের মূল পৃষ্ঠপোষক ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউন। এ উৎসবের প্লাটিনাম স্পন্সর ব্র্যাক, গোল্ড স্পন্সর এনার্জিস ও পূর্ণভা, গোল্ড পার্টনার ব্রিটিশ কাউন্সিল, সিলভার স্পন্সর হিসেবে রয়েছে ক্রিস্টোফারসন রব এ্যান্ড কোম্পানি ও ইউল্যাব।
×