ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

জার্নাল

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

জার্নাল

অন্য এক অলিন্দে আকাশে কখনও কখনও মেঘ জমে, কখনও জমে না। দুপুরে মেঘ ছিল, এখন আকাশে মেঘ নেই। শেষ বিকেলে গাইড এলো। সারাটা দিন ব্যস্ততায় কেটেছে, বেশ ক্লান্ত ছিলাম। আমরা বের হলাম সন্ধ্যার ঠিক আগে। এখানে একমাত্র বাহন অটো আর বাইক। গাইড তার পরিচিত একটি অটো ভাড়া করল। আমার কর্মস্থল থেকে সুরেশ্বর দরবার শরীফ। ‘গাইড’ আসলে কোন পেশাদার ব্যক্তি নন। এই এলাকার একটি কলেজের তরুণ প্রভাষক। তিনি ইতিহাস পড়ান। এই এলাকার যা কিছু ঐতিহাসিক স্পট, যা কিছু ‘হেরিটেজ’, মাজার-মন্দির, যে ক’টা এ পর্যন্ত আমার দেখা হয়েছে সবই তার কল্যাণে প্রায় চল্লিশ মিনিট পর এবড়ো খেবড়ো আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে যখন সুরেশ্বর দরবার শরীফে পৌঁছলাম, তখন ধীরে ধীরে দিনের আলো নিভে যাচ্ছে মাজার এলাকায় ঢুকতেই গানবাজনার শব্দ কানে এলো। মাজার মসজিদের অন্দর মহলে যেখানে প্রচুর লোকজন, অসংখ্য নারি-পুরুষ উচ্চৈঃস্বরে মাইকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছে। গাইড বললেন, স্যার চলুন আগে পদ্মার ঢেউ দেখে আসি। সেদিন একটি বালক নদীতে মারা গেছে। আমরা এগিয়ে গেলাম। একটি বাঁধানো ঘাট আছে। সেখানে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। একটি বিবর্ণ হলুদ একতলা ঘর ডানপাশে। এখানে পদ্মা বিশাল এবং বিস্তৃত। বিরাটাকারের সব ঢেউ, অসংখ্য ঢেউ ঘাটশীলায় কী এক অজানা ক্ষোভে ভেঙ্গে পড়ছে। পদ্মার বুকে এত ক্ষোভ জমা হয়ে আছে! ঘাটের ওপর কী এক উচ্ছ্বাসে সে ভেঙ্গে পড়ছে। এই উন্মত্ত পদ্মাকে দেখলে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমাদেরও গ্রাম ছিল একদিন। গ্রামে বাড়িঘর ছিল, জমিজমা ছিল। বিক্রমপুরে সিরাদিখানের সেই সব বাড়িঘর পদ্মার উন্মত্ত আক্রোশে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। দাদা আবার নতুন করে বাড়িঘর করেন। এটা চল্লিশ সালের কথা। এখন শ্রাবণ মাস। বর্ষাকাল। পদ্মা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আবার শীতকালে তার অন্য রূপ। শীর্ণ এবং শান্ত। আমি তার দুইরূপ দেখেছি পদ্মা কী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে বর্ষাকালে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পথের ধারে অনেক ক’টা খাবারের দোকান বসেছে। একটা ফুচকা- চটপটির দোকান চোখে পড়ল। গাইড বললেনÑ ক্ষুধা লেগেছে, আসুন স্যার খেয়ে নিই। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বেস সুস্বাদু। মনে হলো যেন ঢাকার চটপটি খাচ্ছি। আগরবাতি-মোমবাতির বেশ ক’টা দোকান পাশাপাশি গড়ে উঠেছে। গাইড বললেন, আজ সুরেশ্বরে ছোট মাপের একটা অনুষ্ঠান আছে। আমরা মূল ও প্রধান ফটকের কাছে এগিয়ে গেলাম। গাইড কাকে যেন টেলিফোন করল। আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটা বিল্ডিংয়ের উঠানের মতো সামনের খালি জায়গায়। অল্প বয়সী পাঞ্জাবি পরা একজন যুবক এসে আমাদের অন্দর মহলে নিয়ে গেল। আমরা দু’তিনটি কক্ষ পেরিয়ে প্রধান কক্ষে এলাম বিশাল এক কাঠের পালংকের ওপর একজন মহিলা বসে আছেন। তার মাথায় ঘোমটা তিনি বর্তমানে গদিনশিন ঘরটি আগরবাতির গন্ধ ভরে আছে। পাশের ঘরে বিশাল ডেগচিতে মাংস রান্না হচ্ছে। চমৎকার গন্ধ বের হচ্ছে। রাতে এশার নামাজের পর দোয়া হবে, তারপর সবাইকে প্যাকেট দেয়া হবে। দুটো চেয়ারে আমাদের বসতে দেয়া হলো। লক্ষ্য করলাম, একজন দু’জন করে লোকজন আসছেন, খাটে বসে থাকা মহিলার কোমড় ছুঁয়ে অনবরত হয়ে পায়ে সালাম করছেন। পরে হাতে টাকা গুজে দিচ্ছেন। মহিলার চোখ নির্মিলিত। তিনি ধ্যানে আছেন। আগরবাতির নীল ধোঁয়ার সমস্ত ঘর ভরে আছে। এখন ভিড় নেই। অল্প বয়সী একটি যুবতী মেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। এখন আর এই ঘরে কেউ আসতে পারবে না। গাইড আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন মহিলার বয়স চল্লিশের নিচে হবে। শরীরের রং উজ্জ্বল-শ্যামল। ছয় বছর আগে তার স্বামী মারা যাওয়ার পর তাকে এবং তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেকে গদিনশিন হতে হয়। মাজারটি তার শ্বশুরের। এখানে তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। এখানেই তিনি থিতু হয়েছিলেন। এখানে এই মাটিতে, তিনি চিরবিলীন হয়েছেন। সবাই তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। পায়ে ছুঁয়ে সালাম করেন। হাতে টাকা গুঁজে দেন। তিনি সবার সমস্যার কথা খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনেন সাধ্যমতো সমাধান দিতে চেষ্টা করেন। এভাবেই ব্যস্ততার ভেতর সারাটা দিন কেটে যায়। মধ্যরাতে আবার দোয়া কালাম পড়েন। ইবাদত-বন্দেগী করেন। ব্যক্তিগত সময় বলে তার কিছু নেই। ছেলে স্থানীয় কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। মেয়েটি ছোট সে ক্লাস সিক্সে পড়ছে। তিনি যখন স্কুল-কলেজে পড়তেন, তিনি খুব চঞ্চল ও প্রাণবন্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন খুব সামাজিক ও বহুমুখী স্কুল-কলেজের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি অংশগ্রহণ করতেন। কলেজে উঠে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মকা-ে নিজিকে জড়িয়ে ফেলেন। এসব কথা প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন, সেই নারী মাথায় কাপড় ঢেকে এখন বসে আছে দরবারে।
×