ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তাহেরা বেগম জলি

নাট্যসম্রাজ্ঞী বিনোদিনী দাসী

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

নাট্যসম্রাজ্ঞী বিনোদিনী দাসী

নাট্যসম্রাজ্ঞী বিনোদিনী দাসী কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক বেদনাবিধূর ইতিহাস। ক্ষণজন্মা এই নারী জন্মেছিলেন তাঁর সময়ের অনেক আগেই। প্রতিভার মধ্য গগণে যখন এই গুণী শিল্পী, তখনই তিনি ছিটকে পড়েছিলেন তাঁর প্রিয় অভিনয় জীবন থেকে। এই বিস্ময় নারীর জীবনে পরতে পরতে লেখা আছে বেদনার কাব্যগাথা। তিনি অন্ধকার থেকে আলোতে বের হয়ে আসার স্বপ্ন দেখেছিলেন। অন্ধকারের বিরুদ্ধে করেছিলেন বিদ্রোহ। ভাগ্যদেবী হয়তো সেদিন অলক্ষ্যে বসেই হেসেছিলেন। নিজের প্রতিভা এবং কর্মক্ষমতা দিয়েই যে সমাজের নিষ্ঠুরতা অতিক্রম করা যায় না বিনোদিনী দেবী তার জ্বলন্ত উদাহরণ। দেহে মনে কর্মকে ধর্ম জ্ঞান করা মানুষ সচরাচর জন্মায় না। যে দুই/চারজন এ পৃথিবীতে আসেন, নটী বিনোদিনী তাঁদেরই একজন। পৃথিবীকে উজাড় করে দিয়েÑ কলঙ্কের ডালি মাথায় নিয়ে বিদায় নিয়েছে, এমন মহীয়সীর সংখ্যা আমাদের দেশে নিহায়তই কম নয়। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী গওহরজান এই ইতিহাসেরই অংশীদার। অবশ্য নটী বিনোদিনী নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দা ছিলেন না। কলকাতারÑ ১৪৫, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের এক দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন তিনি। নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের সরাসরি তত্ত্বাবধানে, বাংলার নাট্যমঞ্চে প্রথম শ্রেণীর অভিনেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন এই বিস্ময় নারী। যৌবনের পরিপূর্ণতা নিয়ে সবে তিনি তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং তৎকালীন নাট্যজগতের সম্ভ্রান্ত আসনে নাট্যাভিনেতাদের সঙ্গে বিনোদিনীও লড়াই করে চলেছেন, বাংলার নাটককে, কীভাবে আরও সমৃদ্ধ আসনে দাঁড় করানো যায়। ঠিক তখনই এক বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে তিনি বিদায় নেন তাঁর বড় ভালোবাসা নাট্যাঙ্গন থেকে। তখন তার বয়স মাত্র ২৩। এ যেন নক্ষত্র পতন! তার এই আসা যাওয়ার ইতিহাস বড় বেদনার। এই প্রতিভাবান নারীর অভিনয় ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছিলেনÑ স্বামী বিবেকানন্দ, সাহিত্য সম্রাট বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র বিনোদিনীর মৃণালিনী নাটক দেখে বলেছিলেন, আমি মনোরমার চরিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে ইহা প্রত্যক্ষ দেখিব দেখিতেছিÑ। রামকৃষ্ণ পারমহংস দেব তার চৈতন্যলীলা নাটক দেখে, তাকে চৈতন্য মুখ বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। চৈতন্যলীলা নাটকে চৈতন্যের ভূমিকায় বিনেদিনী অসাধারণ অভিনয় প্রতিভার পরিচয় দেন। তারপরও তাঁকে যেতেই হলো। এবং তা বড় অসময়ে। এ যেন আনারকলির জীবনন্ত সমাধি। বাংলার আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র বিনোদিনী দাসীর জন্ম ১৮৬৩ তে। পাঁচ বছরের শিশু বিনোদিনীকে বিয়ের পিঁড়িতেও বসতে হয়েছিল। তাঁর এই বিবাহ শেষ পর্যন্ত টেকেনি। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, এই কথাটা বিনোদিনীর জীবনের সঙ্গে যেন মিশে আছে। তৎকালীন গায়িকা গঙ্গাবাঈ বিনোদিনী দাসীকে গানের তালিম দেন, বিনোদিনীর বয়স যখন সাত বছর। এবং গঙ্গাবাঈ বিনোদিনী দাসীর গানের প্রথম গুরু। শুধু গানে আটকে থাকাতে বিনোদিনীর মনে হয় সায় ছিল না। তাছাড়া গঙ্গাবাঈও বুঝতে পেরেছিলেন বিনোদিনীর ভিতরে আছে এক অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতা। ঘরে ছিল প্রচ- অভাব। কিন্তু অভিনয়কে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন উপায় হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন, এ প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং এই অভিনয় জগতই তাঁর সর্বস্ব নিয়েছে। অভিনয় জগত এবং জীবন তার কাছে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এ এক বিরল ইতিহাস। ১৮৭৪ সালে ১২ বছর বয়সে-ব্রজনাথ সেন এবং পুর্নচন্দ্র মুখপাধ্যায়ের হাত ধরে তিনি প্রবেশ করেন অভিনয় আঙিনায়। ১০ টাকা বেতনে যোগ দেন ভুবন মোহন নিয়োগরি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে। তার প্রথম অভিনীত নাটকের নাম শত্রু সংহার, সেখানে তিনি অভিনয় করেছিলেন দৌপদীর সহচরী রূপে। ঠিক এর পরেই, হরলাল রায়ের হেমলতা নাটকে হেমলতার ভূমিকায় অভিনয় করেন। নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। বিনোদিনী গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ছিলেন ১৯ মাস। এরপর ২৫ টাকা মাসিক বেতনে, শ্রী শরৎচন্দ্র ঘোষের বেঙ্গল থিয়েটারে যোগ দেন বিনোদিনী দাসী। এই বেঙ্গল থিয়েটারেই মেঘনাদ বধ, বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনী, দুর্গেশনন্দিনীসহ অনেক বিখ্যাত নাটকে অভিনয় করে, অভিনয় জগতে অদ্বিতীয় অভিনয় শিল্পীতে পরিণত হন। জীবন্ত কিংবদন্তি গিরিশচন্দ্র ঘোষ তখন বাংলার নাট্যাঙ্গনে বসে আছেন মহাদেবের আসনে। গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং ন্যাশনাল থিয়েটারের (গ্রেট ন্যাশনাল এবং ন্যাশনাল ভিন্ন দুটি থিয়েটারে) স্বত্বাধিকারী কেদারনাথ চৌধুরী প্রায়ই বেঙ্গল থিয়েটারে যেতেন। বিনোদিনীর কপালকু-লা নাটক দেখে, বাবু কেদারনাথ চৌধুরী মুগ্ধ হন। নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শ্রী শরৎচন্দ্র ঘোষের বেঙ্গল থিয়েটার থেকে অনেকটা অনুরোধ করে বিনোদিনী দাসীকে নিয়ে আসেন। তিনি একটি থিয়েটার করবেন এই আশা জানিয়ে। বেঙ্গল থিয়েটার ছিড়ে ১৯৭৭ সালেই বিনোদিনী চলে আসেন নাট্যগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাছে। জহুরী যেমন সোনা চিনতে ভুল করে না। তেমনি নট এবং নাট্যগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষও সেদিন বিনোদিনীকে চিনতে ভুল করেননি। এরপরই গুরু শিস্যের দীর্ঘ পথ চলা। বিনোদিনীর একথা বুঝতে দেরি হয়নি, গুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষই তার প্রকৃত ঠিকানা। এই সময় থেকেই শুরু হয় বিনোদিনী দাসীর নাট্য জীবনের প্রকৃত সাধনা। এবং গুরু শিস্যের বন্ধন আর কোনদিন ছিন্ন হয়নি। মহাতারকা বিনোদিনী দাসী নাট্যগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের সান্নিধ্যে এসে যেন পেলেন এক নতুন জীবন। এবং নাট্যাচার্যের নিবিড় পরিচর্যায়, খোরস ছেড়ে স্বপ্রতিভায় আবির্ভূত হলেন এই বিস্ময়নারী। অতঃপর গিরিশচন্দ্র ঘোষের হাত ধরে ১৮৭৭ সালেই যোগ দেন কেদারনাথ চৌধুরীর ন্যাশনাল থিয়েটারে। অভিনয় জীবনে ব্যর্থতা শব্দের সঙ্গে তার কোন পরিচয় ছিল না। মঞ্চের প্রতিটি চরিত্রে তিনি সফলতার চিহ্ন রেখে ক্রমাগত এগিয়ে গেছেন। চৈতন্যলীলা, মেঘনাদ বধ, বিষবৃক্ষ, বুদ্ধদেব, মৃণালিনী, দুর্গেশনন্দিনী, কপালকু-লা প্রভৃতি নাটকে অসামান্য অভিনয় করে একদিকে নিজেকে তুলে ধরেন উচ্চতার এক মহান আসনে। অন্যদিকে নাটককে সমাদৃত করে তোলেন প্রকৃত গুণী সম্প্রদায়ের কাছে। কারণ তখনও নাটক ছিল শুধুই ভোগ-বিলাসের অংশ। ১২ বছরের অভিনয় জীবনে তিনি ৮০টি নাটকে ৯০টি চরিত্রে অভিনয় করে, হয়ে উঠেছিলেন নাট্যজগতের বিস্ময়রমণী। একই নাটকে অনেক চরিত্রে অভিনয়ের মতো চ্যালেঞ্জ তাঁকে নিতে হয়েছে বার বার। মেঘনাদ বধ নাটকে প্রমিলা, বারুনি, রতি, মায়া, মহামায় ও সীতা এই ছয়টি ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি তার সহজাত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ক্রমশ তিনি সমগ্র ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেত্রী হিসেবে সকলের দৃষ্টি কেড়ে নেন। তার দিকে অভিভূত হয়ে চেয়ে রইল বাংলার নাট্যজগত। বিনোদিনী হয়ে উঠলেন বাংলার নাট্য জগতের অপরিহার্য শক্তি। নাট্যাচার্য গিরিচন্দ্র ঘোষ দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করেছেন, তার (গিরিশচন্দ্র ঘোষের) নাটকের সাফল্যের মূলেই ছিল বিনোদিনী দাসী। তিনি এ কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন, বিনোদিনীর অভিনয় ক্ষমতা, গুরুর শিক্ষাকে অতিক্রম করে স্বকীয়তা অর্জন করেছে। সে সময়ের প্রতিটি সংবাদপত্রে বিনোদিনীর অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করে সংবাদ ছাপানো হতো। তাঁর অভিনয়ের অসাধারণ ক্ষমতার মুগ্ধ হয়ে, তাঁকে না না উপাধিতে ভূষিত করেছে সে সময়ের পত্র-পত্রিকা। ফ্লায়ার অফ দি নেটিভ স্টেজ, প্রাইমা ডোনা অফ দি বেঙ্গলী উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে বাংলার মহা তারকা বিনোদিনী দাসীকে। পরবর্তী পর্যায়ে গড়ড়হ ড়ভ ঃযব ংঃধৎ ঃযবধঃৎব উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করা হয়। অভিনয় ছাড়াও আরও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন এই বিদূষী নারী। তাঁর সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রও ছোট নয়। বিনোদিনীর নাট্যচর্চার সময়কাল বারো বছর কিন্তু সাহিত্যচর্চা করেছেন দীর্ঘ চল্লিশ বছর। কবি বিনোদিনীর কাব্যগ্রন্থ ‘বাসনা’ এবং কাব্যপন্যাস ‘কনক ও নলিনিতে’ তাঁর কাব্যপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর রচিত তাঁর অসামাপ্ত স্মৃতিকাহিনী ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় এবং নির্মলচন্দ্র সম্পাদিত রূপ ও রঙ্গ নামের মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বিনোদিনী রচিত আমার ‘স্মৃতি কথা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ। যেখানে ধারণ করা আছে এই উজ্জ্বল নক্ষত্রে উত্থান পতনের ইতিহাস। তবে এটা, সৃষ্টিশীল নারীর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। নাট্যসম্রাজ্ঞী নটী বিনোদিনীই আজ আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। স্বাপ্নিক বিনোদিনী দাসীর স্বপ্ন ছিল, অভিনয়শিল্পীরা নিজেরা গড়ে তুলবে স্বাধীন নাট্যকেন্দ্র। সেখানে অভিনয় শিল্পের উৎকর্ষতায় নিজেদের উৎসর্গ করবে শিল্পীসমাজ। পরস্পর হয়ে উঠবে পরম আত্মীয়। এই ভাবনা যখন তাঁর ভিতরে দানা বাঁধতে শুরু করে, ঘটনা চক্রে তখন ন্যাশনাল থিয়েটার নিলামে ওঠে। এবং নতুন স্বত্বাধিকারী হিসেবে আসন গ্রহণ করেন শ্রী প্রতাপচাঁদ জহুরী নামে এক মাড়োয়ারী। এবং কারণে অকারণে শিল্পীদের পারিশ্রমিক আটকিয়ে দেয়া স্বাভাবের বাবু প্রতাপচাঁদের সঙ্গে, বিনোদিনী বড় ধরনের গোলাযোগে জড়িয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নেন ন্যাশনাল থিয়েটারে আর নয়। কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার বাবু অমৃত মিত্রের অনুরোধে তাঁকে আরও কিছুদিন সেখানে থেকে যেতে হয়। তবে শর্ত থাকে, নিজেরা একটা থিয়েটার গড়ে তুলবেন। নতুন থিয়েটার গড়ার অর্থ আসবে কীভাবে, সে ভাবনা বিনোদিনীর উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার-নাট্যচার্য গিরীশচন্দ্র ষোঘ ন্যাশনাল থিয়েটারে বেতন চুক্তিতে কাজ করতেন। ধারণা করা যেতে পারে, একটা থিয়েটার নির্মাণ করার অর্থনৈতিক সাধ্য তাঁর ছিল না। এ ক্ষেত্রে বিনোদিনীই একমাত্র সহায়। বিনোদিনী দেবীর একান্ত ব্যক্তিগত জীবনও এখানে আলোচনার দাবি রাখে। বিনোদিনী এক ধনবান যুবকের প্রণয়ে আবদ্ধ ছিলেন। এবং জীবন চলার নিয়মেই, বিনোদিনীর দৈনন্দিন ব্যয়ভার উল্লিখিত যুবকই বহন করতেন। বিনোদিনী দাসীর জীবনে তখন সচ্ছলতার কোন টানাপোড়েন ছিল না। কিন্তু হঠাৎই, ভদ্র পাড়ার সম্ভ্রান্ত যুবক, নিজের ঘরকান্নার দিকে মনোযোগী হয়ে, বিরূপ হয়ে উঠলেন বিনোদিনীর প্রতি। অত্যন্ত একরোখা বিনোদিনীও তখন এই মতে আসেন, এবার নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করবেন ভালবাসার জীবন নাট্যজগতের প্রতি। তারকা জতগের মহাতারকা, বিদূষী বিনোদিনী নিজের ভাবাবেগকে উপেক্ষা করে একাকার হতে চাইলেন নাট্যজীবনের সঙ্গে। যৌবনের প্রথম উপেক্ষিত ভালবাসার ধাক্কায় কিছুটা হলেও থমকে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তাঁর নিজের ভাষায় ‘এই সময় আমার অতিশয় সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়িতে হইয়াছিল।’ তবে শোক নিয়ে বেশিদিন বদ্ধ ঘরে থাকার অবসর তিনি পাননি। মনের এই অবস্থা নিয়েই বন্ধুদের অনুরোধে মনকে থিয়েটার গড়ার দিকেই টেনে নিয়ে গেলেন। স্বয়ং গিরিশচন্দ্র ঘোষ চাইলেন বিনোদিনী নিজেকে পুরোই উৎসর্গ করুক। নাট্যাঙ্গনের বেদীতে। বিনোদিনী কখনো গুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবাধ্য হয়েছেন, তা জানা যায় না। এই সময় গুর্মুক রায় নামে এক মাড়োয়ারি যুবক শিল্পী সমাজের থিয়েটার গড়তে সমস্ত ব্যয় বহন করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু শর্ত থাকে যে, বিনোদিনীকে তার চাই। বিনোদিনীর বিনিময়েই সে শিল্পীসমাজের থিয়েটার গড়ে দেবে। তৎকালীন সমাজের বিচারে, তথাকথিত সভ্য সংসার বিনোদিনীর জন্য বরাদ্দ ছিল না। কিন্তু বিনোদিনী দাসী টাকার বিনিময়ে ভালবাসা লেনদেন করার স্তরের নারীও ছিলেন না। তার একদিকে নিজের জীবন, পিছনে আছে ভালবাসার বন্ধন। অন্যদিকে শিল্পীসমাজের কাতর অনুরোধ- ‘তুমি যেভাবে পারো আমাদের একটা থিয়েটার বানিয়ে দাও’। গিরিশবাবু বললেন, থিয়েটার ই বিনোদিনীর উন্নতির সোপান। নিজেকে বিসর্জন দেওয়ার এটাই তার নির্ধারিত বেদী। ততদিনে আবার ফিরে এসেছে সেই প্রেমিক যুবক। দাঁড়িয়েছে বিনোদিনীর মুখোমুখি। অবশেষে ভালবাসা ব্যক্তিগত জীবন সবকিছু পায়ে মাড়িয়ে, নিজের অস্থিমজ্জাকে গুড়িয়ে, মাতৃরূপে বিনোদিনী দাসী দাঁড়ালেন থিয়েটারের পাশে। এ এক নতুন বিনোদিনী। গুর্ম্মুখ রায়ের কাছে বাধা দিলেন নিজেকে। যেন সীতা চলেছেন অগ্নীপথে। নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়ে দান করার এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনি। একেই মনে হয় বলে, ইহলোকে ত্যাগ না করেই জীবন দান করা। বিনিময়ে গুর্ম্মুখ রায়কে দিয়ে শুরু করলেন শিল্পী সমাজের এতদিনের স্বপ্ন থিয়েটার নির্মাণের কাজ। গুর্ম্মুখ রায়ের রক্ষিতা বিনোদিনী হয়ে উঠলেন শিল্পী সমাজের দুর্গতিনাশিনী। চুন পাথরের গন্ধে এগিয়ে চলল থিয়েটারসৌধের নির্মাণ কাজ। গুর্ম্মুখ রায় বিনোদিনীকে ৫০ টাকা নিয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ঝামেলা বাদ দিয়ে তুমি বরং নিজের জীবন গুছিয়ে নাও। ষড়যন্ত্রের কিছু আভাস সম্ভবত গুর্ম্মখ রায় আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন। বিনোদিনীর এক কথা- ‘আমার একটা থিয়েটার হল চাই, এবং তা যত টাকাই লাগুক-। তাই হলো, বিনোদিনীর জীবন এবং শ্রমের বিনিময়ে সত্যিই একদিন গড়ে উঠল শিল্পী সমাজের স্বপ্নথিয়েটার। এক নির্মম প্রতারণা অপেক্ষা করছিল বিনোদিনী দাসীর সামনে, যা ভাবতেও পারেননি, থিয়েটারসৌধ সৃৃষ্টির স্রষ্টা নটী বিনোদিনী। সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল, নতুন থিয়েটারের নাম হবে ‘বি থিয়েটার’। কিন্তু অন্য সকলের সঙ্গে বিনোদিনীও এক সকালে দেখলেন, বি থিয়েটার নয়। সেখানে নাম হিসেবে জ্বল জ্বল করছে স্টার থিয়েটার। কারণ তখন বিনোদিনীর মধ্যে, সুধী সমাজ আবিষ্কার করলেন, বিনোদিনী তো রক্ষিতা। বিপদের কান্ডারি বিনোদিনী রাতারাতি হয়ে গেলেন রক্ষিতা। তারপর শুরু হয়ে গেল বিনোদিনীকে স্টার থিয়েটার থেকে নির্বাসনের আয়োজন। এই ষড়যন্ত্রের ফলে দুইমাস স্টার থিয়েটার থেকে দূরেও থাকতে হয়েছিল তাকে। নাট্যচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ তার হাতে গড়া প্রতীমাকে বিসর্জন দিতে রাজি না হওয়াই এবং স্বত্বাধিকারী গুর্ম্মুখ রায় বিনোদিনী বাদে থিয়েটার চালাতে রাজি না হওয়ার ফলে, আবার ফিরিয়ে আনা হয় তাকে। গুরু গিরিশচন্দ্র এবং বিনোদিনীর হাত ধরেই স্টার থিয়েটারের প্রথম নাটক ‘দক্ষযজ্ঞ’ মঞ্চায়িত হয়। স্টার থিয়েটার তৈরি হওয়ার পর গিরিশচন্দ্র ঘোষের ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠলো, কীভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দক্ষতা আরও বাড়ানো যায়। থিয়েটার শুধু বিনোদন নয়। মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠানও। এটাই ছিল গিরিশ চন্দ্র ঘোষের নৈতিক মন্ত্র। যখন নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে স্টার থিয়েটার, তখন হঠাৎ বেঁকে বসলেন শ্রী গু¤ুর্§খ রায়। বিনোদিনীর প্রতি শিল্পীসমাজের এতবড় অন্যায় সম্ভবত গুর্ম্মুখ রায় কখনও ভুলতে পারেনি। স্টার থিয়েটারের স্বত্ব বিনোদিনীর হস্তান্তর করে, তিনি বিনোদিনীর জীবন থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। হওয়ার কথা ছিল বিনোদিনীর থিয়েটারে। ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে হয়ে গেল স্টার থিয়েটার। বিনোদিনীর প্রতি এই নিষ্ঠুরতা রায় মেনে নিতে পারেননি। তিনি জানিয়ে দিলেন এই থিয়েটারে যার জন্য প্রস্তুত করেছি, আমি তাকেই এর স্বত্ব দিয়ে চলে যাব। কিন্তু গুর্ম্মুখ রায়ের এই ইচ্ছার সঙ্গে এক মত হতে পারেননি-নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তিনি বললেন বিনোদকে ফেলিয়া তো আমি কখনো অন্যত্র কার্য করিব না। আমরা কার্য করিব; বোঝা বহিবার প্রয়োজন নাই। গাধার পিঠে বোঝা দিয়ো কার্য করিব। গুরুকে প্রণাম করে আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করলেন বিনোদিনী দাসী। গিরিশচন্দ্র ঘোষ বিনোদিনীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, অভিনয়ে উৎকর্ষের ছাড়া শিল্পীদের আর কিছু চাইতে নাই। বিনোদিনীও ধর্মজ্ঞানে নিজেকে সমর্পণ করলেন নাট্যবেদীতে। এই সময় কিছু বিখ্যাত নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল নাট্যপ্রেমীদের। নল-দময়ন্তী, ধ্রুবচরিত্র, শ্রীবৎস-চিন্তা ও আরও দুই একটা বিখ্যাত নাটক তখন মঞ্চে আসে। থিয়েটারের সুনামের ফলে তখন মানুষকে বসার জায়গা দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। এই সময়ই প্রথমে- চৈতন্যলীলা এবং পরে দ্বিতীয় ভাগ চৈতন্যলীলার মঞ্চায়ন শুরু হয়। গিরিশচন্দ্র এবং বিনোদিনীর এ এক অনবদ্য সৃষ্টি। চৈতন্যলীলা দ্বিতীয় অভিনয় করতে গিয়ে পরবর্তী ছয় মাস বিনোদিনী আর কোন নাটকে অভিনয় করতে পারেননি। কারণ চৈতন্য চরিত্র থেকে তিনি বের হয়ে আসতে পারতেন না। এর আগে পাশাপাশি দুই/তিনটা নাটকে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করা বিনোদিনীর জন্য ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু চৈতন্য চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসা তার জন্য হয়ে দাঁড়ালো দুঃসাধ্য ব্যাপার। বিনোদিনী দাসীর মতানুসারে এই সময় তারা জীবনে একটা ভিন্ন ধরনের অনুভূতি দেয়া দেয়। মাত্র কিছুদিন আগেই নাটকে পরিবেষ্টিত সজ্জন দ্বারা প্রতারিত হওয়া এবং চৈতন্যলীলা নাটককে কেন্দ্র করে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাহচর্যে আসা। এই স্বত্ব যারা কিনে নিয়েছিল সেই সকল শিল্পীও ধীরে ধীরে শিল্পী থেকে বনে গেল মালিক। তিনি অনুভব করলেন এই নাট্যজগত তার নয়। এটা তিনি চাননি। এই নাট্যজগতে বিনোদিনী দাসীর দাঁড়ানোর আর কোন জায়গা নেই। নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের মন্ত্র ছিল ‘নাট্যাঙ্গন শুধু বিনোদনের কেন্দ্র নয়। মানুষ সৃষ্টির কারখানাও এটা। কোথাও হারিয়ে গেলো সেই মন্ত্র। মহান শিল্পী বিনোদিনী দাসী, চোখভরা জল গোপন করে তাই আশ্রয় নিলেন জীবনের কোন এক নিভৃত বাংলার নাট্যভুবন হারাল তাদের প্রাণসত্তা। সূত্র : প্রমীলা স্মৃতিকথা- সংকলন ও সম্পাদনা- বিজিত ঘোষ আমার কথা- লেখক- বিনোদিনী দাসী।
×