ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

মূর্ত-বিমূর্ততায় দ্বৈতসত্তা

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

মূর্ত-বিমূর্ততায় দ্বৈতসত্তা

চিত্রকলা হচ্ছে নিঃশব্দ কবিতা, যা কথা বলে। শিল্পের মাধ্যমে ব্যক্তির মননশীলতার বিকাশ ঘটে। দৃশ্যত যা দেখা যায় তাই সব নয়। অন্তরদৃষ্টি অর্থাৎ অন্তরলোকের যা থাকে তাই-ই সারবস্তু। আর এমন ভাবনা সবাই ভাবতেও পারে না। কেউ কেউ তা পারেন। যারা ভাবেন তারা অন্যদেরও ভাবাতে পারেন। তাদের দৃষ্টিশক্তি শুধু চোখ নয়, অন্দরদৃষ্টি নামের তৃতীয় নয়ন তাদের পথ দেখায়। আলোকিত করে নিজেকে, সমাজকে এবং দেশকে। এমন ধারার একজন গুণী শিল্পী মুর্তজা বশীর। মুর্তজা বশীর আধুনিক চিত্রশিল্পী যাকে একই সঙ্গে মূর্ত ও বিমূর্ততার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা দ্বৈতসত্তার এক শিল্পীই বলা যায়। তিনি শুধু একজন চিত্রশিল্পই নন, একাধারে শিল্পকলার শিক্ষক, কবি, উপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্প নির্দেশক, গবেষক ও মুদ্রাতত্ত্ব বিশারদ। যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের শিল্পজগতকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন নতুনত্বে ও মৌলিকতায়। তিনি এখনও আত্মানুসন্ধানে নিবেদিত। শিল্পী মনের অস্থিরতায় সৃষ্টি করেন মহৎ শিল্প। তার শিল্পী জীবনের সূচনালগ্নে আঁকা ছবি চিত্রভাষার দিক থেকে মূলত পশ্চিমা বাস্তববাদী বা একাডেমিক রীতির অনুসারী হলেও এর বিষয়বস্তুতে ছিল নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পারিপার্শ্বিক জীবনবাস্তবতার প্রতিফলন। তার কাজের পরিধি বিস্তৃত, ব্যাপক এবং নতুনতর। তার চিত্রকর্ম আমাদের বাংলাদেশের শিল্পে আধুনিকতা ও তার পরবর্তী সময়ের পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দেয়। শুধু তাই নয় রবীন্দ্রনাথের শিল্পে বিমানবিকীকরণের যে তুরীয়পন্থা তাও মনে করিয়ে দেয়। যদিও মুর্তজা বশীর প্রাথমিক বিচারে ঘনবাদের যুক্তিযুক্ত ঘরানার শিল্পী। তার নব্বই ও একানব্বই সালে করা কোলাজগুলো মনে করিয়ে দেয় সেই সব কবি শিল্পীর হাতে গড়া নিজস্ব প্রকাশবাদী ভাষার কথা, যারা রবীন্দ্রনাথের মূর্ত আর বিমূর্ততার মেলবন্ধনের ফসল। চিত্রতলের দ্বিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য ও চিত্রগঠনে জ্যামিতিক কাঠামোর সুচিন্তিত ব্যবহার তার কাজে পরিলক্ষিত হয়। মুর্তজা বশীর তার শিল্পী জীবনের প্রথম দিকে এঁকেছেন সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা, সুখ-দুঃখ, ফুটপাথে ও দোকানে দেখা সাধারণ মানুষ, নর-নারীর প্রেম, অবসর, বিনোদন, নৌকা, ঘরবাড়ি, পাখি ইত্যাদি। ক্রমে ত্রিমাত্রিকতা থেকে সরে এসে তিনি দ্বিমাত্রিক চিত্রতল নির্মাণে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। বাস্তবতার যথাযথ যৌক্তিক উপস্থাপনার পরিবর্তে নানা বিক্ষিপ্ত ইমেজের সমন্বয়ে তার ছবি প্রতীকী ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ এক কাব্যময় রূপ পরিগ্রহ করে। তার ছবিতে চিত্রিত বস্তু বা আকৃতির ফর্মগুলো ছেদহীন বহিঃরেখা দ্বারা নির্মিত, রং ও আকৃতিতেও রয়েছে সরলীকরণ। এই পরস্পর ছেদযুক্ত রেখা দ্বারা বিভিন্ন গতিপথ নির্দেশের দ্বারা দর্শকের দৃষ্টিকে চালিত করার দিকে তার সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তার কিছু কিছু কাজে পাবলো পিকাসোর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পিকাসোর মতোই একাকিনী নারীর অবয়ব বার বার তার বিষয়বস্তুরূপে এসেছে। চিত্রপটে ব্যবহৃত বহিঃরেখা বস্তুর আকৃতি নির্মাণে সীমাবদ্ধ না থেকে ক্রমান্বয়ে অর্জন করেছে অভিব্যক্তিময় স্বতন্ত্র সত্তা। তার ছবিতে দেখা যায় অন্যান্য রঙের সঙ্গে সোনালি ও রুপালি রঙের প্রয়োগ। বিমর্ষ ধূসর, ক্লান্ত অবসিত সবুজ আর ফ্যাকাশে নীল রঙের স্থান অধিকার করে নিয়েছে উজ্জ্বল লাল, সোনালি এবং রুপালি রঙের উচ্ছ্বাস। আগের ছবিতে যে নীল আর সবুজ রং ছিল বিমর্ষতার প্রতীক পরবর্তীতে তা অন্য প্রতিভাসে বাক্সময়। আগে যেখানে ছিল প্যালেট নাইফ বা ব্রাশে সূক্ষ্ম রেখা সেখানে স্থান করে নেয় বলিষ্ঠ চওড়া রেখা যা অনেকটা জ্যামিতিক। তার ছবিতে সব সময়ই পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রবণতা উপস্থিত। এই অন্বেষণে-উদভ্রান্ত হয়ে কিংবা বিভ্রান্তির সঙ্গে না, বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গভীর প্রত্যয়ে। ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি একজন ফিগারেটিভ চিত্রকর হিসেবইে পরিচিত ছিলেন। এরপর তার চিত্রকলায় পরিবর্তন আসে। এ সময় তার মানসলোকেব উন্মোচিত হয় একটি বাস্তব প্রতীক দেয়াল। যাতে তিনি খুঁজে পান বিমূর্তের মধ্যে মূর্তের সন্ধান। বস্তুত এই দেয়াল সিরিজ মুর্তজা বশীরের শিল্পচর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যেখানে একই সঙ্গে মূর্ত-বিমূর্ততাকে, বাস্তব-অবাস্তবতাকে, বস্তু ও নির্বস্তুতাকে হয়ত শিল্পী উদ্দিষ্ট করতে চেয়েছিলেন। কিংবা নিরেট দৃশ্য অভিজ্ঞতাকে রূপান্তরিত করতে চেয়েছেন এক প্রতীকী ব্যঞ্জনায়, যা আমাদের নিয়ে যায় অদৃশ্য অবয়বের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধিতে। এ সময় তিনি ফিগার বাদ দিয়ে শুধু টেক্সচার নিয়ে কাজ করেছেন। পুরনো, খসখসে, বর্ণহীন, নোনা ধরা, ভাঙ্গা দেয়ালগুলোর মধ্যে মানব সঙ্কট হলেও এর পাশে কোন দেয়ালের দৃঢ় গাঁথুনি যেন শিল্পীর আশাবাদী মনের পরিচয় দেয়। ব্যবহৃত রংও বেশ নিয়ন্ত্রিত, সংখ্যা এবং প্রকাশে লাল, সবুজ, হলুদ, কালো এদের কোনটাই উচ্চকিত নয় বরং খুব অস্পষ্ট হওয়ার জন্য প্রসারিত আর ছড়িয়ে পড়ার চরিত্র পেয়েছে, যার মাধ্যমে জেগে উঠবে এমন এক বাস্তবতা যা বাস্তবতার আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকে। এভাবে আঁকা দেয়াল দেখে যে ধারণা হয় তার ভিত্তিতেই ফর্ম তৈরি হয় যা রেখা সমতল এবং রেখার সঙ্গে পারস্পরিক সংমিশ্রণে নতুন উপলব্ধি জন্ম দেয়। উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে একটি বাস্তব দৃশ্য থেকে এভাবে ক্রমাগত বিমূর্ততা তৈরি হতে থাকে। বিমূর্ত বাস্তবতায় জঙ্গম পরিচয় তার চিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করেন বাংলাদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ম্যুরাল অক্ষম বট। এপিটাফ বা শহীদের সমাধিলিপি সিরিজের ছবিগুলোতে তিনি পাথরের ফর্মকে ব্যবহার করেছেন রঙের অপূর্ব স্নিগ্ধতায়। এই এপিটাফের প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন আদিবাসী পরিবারের মৃত মানুষের সম্মানে পাথর সাজিয়ে রাখার রীতি দর্শনে। সাদা পটভূমিতে বিভিন্ন আকৃতির ভাসমান ফর্ম, ভেতরের আকৃতিসমূহ বিভিন্ন মোলায়েম রঙের সূক্ষ্ম পর্দায় পরস্পর বিলীয়মান। এখানে আকৃতি ও রঙের ব্যবহার নম্র ও কমনীয়, সম্পূর্ণ পরিহার করা হয়েছে টেক্সচার। বাঙালী মুসলামান সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাস মুর্তজার শিল্পপ্রেরণার উৎস হিসেবে দেখা যায়। ধর্মপ্রাণ মুসলমান তাদের দরজায় কোরানের সূরা সেঁটে রাখতে পছন্দ করেন। তিনি এ দৃশ্য তার ছবিতে তুলে ধরেন, সঙ্গে আঁকেন জায়নামাজের নকশা, তাবিজ, আরবী লিপিচিত্র। আনোয়ারা কিংবা সালেহা উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলোকে তার কল্পনা অনুযায়ী রূপদানের চেষ্টা করেন। শিল্পীর নিজস্ব প্রতিকৃতিও বাদ যায়নি তার শিল্পভাবনায়। ইসলামী ক্যালিগ্রাফি অবলম্বনে কলেমা তৈয়বা শিরোনামে বেশ কিছু ছবি এঁকেছেন তিনি। বশীরের প্রজাপতির বর্ণিল ডানা যেন সত্য সুন্দরের প্রতীক। রোমান্টিকতায় ভরপুর। বিভিন্নভাবে ডানাগুলো এঁকেছেন। টেক্সচারে খুব বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। কখনও ফর্ম বড় করেছেন, কখনও ছোট করেছেন। কম্পোজিশনে সমন্বয় প্রতিফলিত হয়। প্রজাপতির ডানা কখনও সম্পূর্ণ মেলানো, কখনও ডানার মাঝের অংশ খুব কাছাকাছি দেখানো হয়েছে। ডানাগুলো বিভিন্ন ফর্মে, বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। ছবিতে স্পেসের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। ক্যানভাসে সরাসরি রং ব্যবহারে অপরূপ ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে। ব্রাশ স্ট্রোকে যে টেক্সচার ফুটে উঠেছে সেটাকে ভীষণ জীবন্ত এবং আকর্ষণীয় মনে হয়। ছবিতে রঙের উজ্জ্বলতায় যে রোমান্টিক আবহ ফুটে উঠেছে তা বর্ণনাতীত। এ ধরনের ছবিগুলোকে বিমূর্ত বাস্তববাদী নামে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। মুর্তজা বশীর লোকজ আধুনিকতা নিয়েও অনেক কাজ করেছেন। পাল যুগের চিত্রকলা, কালীঘাটের চিত্রকলা নিয়ে তিনি কাজ করেন। তার আঁকা চোখগুলো শুরুতে ছিল কালীঘাটের মতো, শুধুই কালো। এরপর ওপরে কালো, নিচে বাদামী, পাল যুগের মতো, এখানেও চারটা রং নীল, সবুজ, হলুদ আর লালের ব্যবহার। এভাবেই একটা নিজস্বশৈলী সৃষ্টি করেন তিনি। শিল্পী নারীর অনেক অবয়ব নির্মাণ করেছেন। অন্যদিকে কোলাজ ব্যবহার করে তৈরি কাজগুলোতে তিনি ছুটি নিয়ে নিয়েছেন স্থান-কাল-পাত্রের সহজ দর্পণ থেকে। কোলাজের ক্ষেত্রে তিনি গোলকায়িত দুনিয়ার রাজনীতি, স্বপ্নের বিশ্লেষণ, সংঘাত, যুদ্ধ ও পাশ্চাত্য শিল্পের ইতিহাসকে বেছে নিয়েছে বিষয় হিসেবে। ক্যানভাসে রঙের অভিনব ব্যবহারের সূত্রে যে গতি অর্জন করা যায়, তার পরিপ্রেক্ষিতে ‘কন্টুর’ ড্রইংকে রং দিয়ে বিমূর্ত করে তোলার মধ্যেই শিল্পকর্মের সার্থকতা। যা তার কাজে পরিলক্ষিত হয়। আজন্ম বাস্তববাদের সমর্থক শিল্পী মুর্তজা বশীর। সিরিজ ছবি আঁকিয়ে এই শিল্পী আমিনুল আসলাম ও মোহাম্মদ কিবরিয়ার মতোই ঘনবাদের জ্যামিতিক বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে মানব অবয়বকে বিমানবিকীকৃত দশায় রূপান্তর করায় ধারণায় স্থির ছিলেন একদা। তার অক্লান্ত শিল্প অন্বেষার নানা পর্বে ছবিতে অবয়ব নির্ভরতা ও বিমূর্ততা ফিরে ফিরে এসেছে। কোন পর্বে শুদ্ধ জ্যামিতিক কাঠামো তার ছবির চিত্রপট নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, আবার ঠিক তার পরের পর্বের ছবিতেই হয়ত ফিরে এসেছে জৈব ফর্মের প্রাধান্য কিংবা অবয়ব ধর্মিতা। মুর্তজা বশীর তার শিল্পী জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় পুনরাবৃত্তি ও একঘেয়েমিকে এড়িয়ে সব সময় নতুন পথের অনুসন্ধান করেছেন। এখনও তরুণ মনের ভাবনায় এঁকে যান সত্য-সুন্দরের গান।
×