ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিজানুর রহমান বেলাল

হাসান হাফিজের কবিতা স্বপ্নকল্পনার আল্পনা

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

হাসান হাফিজের কবিতা  স্বপ্নকল্পনার আল্পনা

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন- ‘কবির কর্তব্য তার প্রতিদিনের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতায় একটা উপলব্ধির মাল্যরচনা’। তেমনি এটাও তিনি মুক্তভাবে স্বীকার করেছিলেন-‘কাব্যরচনা ও কাব্যবিবেচনা একই ব্যাপারের প্রকারান্তর’। কবি হাসান হাফিজ বিষয়টা জানেন। কবিতা যেন এক দীর্ঘ পথপরিক্রমা, যা মানব সভ্যতার সমান প্রাচীন ও নিরন্তর পরিবর্তমান। তা না হলে, কবি হাসান হাফিজ কবিতার ভুবনে রুচিশীল, মানত্তীর্ণ, স্বাতন্ত্র্য চিন্তার উদ্বাবক হতেন না। আধুনিক কবিতার বিষয়বৈচিত্র্য এবং ভাষার নির্মাণশৈলী এমনই অভূতপর্ব যে, আধুনিক কবিতাকে কোন একটি সংজ্ঞা বা বিশ্লেষণ দ্বারা চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। এক্ষেত্রে কবিদের দায়িত্ব শতগুণ বেড়েই যায়, প্রগাঢ় বোধ, চেতনা, রুচি এমনকি ইমোশনাল বিষয়গুলো কবিতায় বহিঃপ্রকাশ করার। কবি হাসান হাফিজ সফলভাবেই তা সম্পূর্ণ করেছেন। এরই পাশাপাশি চিরচলিঞ্চু জীবনের নানান খ- খ- ঘটনাবলী, স্মৃতিচারণ, হাসি-কান্না, আনন্দ-কল্পনা, প্রাত্যহিকতাসহ নানান বিষয়ের শব্দাল্পনা কবি হাসান হাফিজের কবিতায়। এই সব মিলেই তো আমাদের জীবন। আর এই জীবনের জলছবি যদি, কবিতায় স্পষ্টভাবে ভেসে না ওঠে, তাহলে কবিতার অপূর্ণতা থেকে যায়। কবি হাসান হাফিজের কবিতায় জীবনের জয়গান স্পষ্ট। কবিতায় জীবনের জলছবি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। এই কারণেই, বাংলা কবিতার সিরিয়াস ধারার মেধাবী পাঠকদ্বয়- প্রিয় কবি হিসেবে অনেকে হাসান হাফিজকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কবিতাকে কোন পূর্বপরিকল্পিত বিধিনিষেধের শৃঙ্খল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা যায়নি কখনও। কবিতা কোন নির্দিষ্ট বৃত্তের সীমানায় আসতে পারে না- বৃত্তের সীমানায় আটকে গেলে, সাবলীলভাবে কবিতার মাধুর্য খুঁজে পেতে কষ্টসাধ্য হয়। কবিতা গভীর অনুভবের বিষয়, শৃঙ্খলমুক্ত ভ্রম; পালকের মতো। শব্দ, চিত্রকল্প, প্রকরণ, আঙ্গিক বিশ্লেষণ করে কবিতাকে যাচাই করা যুক্তিহীন। বিজ্ঞান ও দর্শন অর্থনীতির মতো বোঝার বিষয় কবিতা নয়। কবিতা সৌন্দর্য বিকাশের স্বপ্নসারথি। কবিতা ও রস আবেগ প্রকাশের চিত্রকল্প। কার্ল গুস্তাভ জাংয়ের ঊদ্ধৃতি স্মর্তব্য- Perhaps art has no meaning at least not as we understand meaning. Perhaps it is like mature, which simply is and means nothing beyond that. তবে কবিতায় কবি সত্তার ও বুদ্ধিজীবীর পার্থক্য চোখে পরার মতো। কবি হাসান হাফিজ- একজন কবি, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, সাংবাদিক, ক্লাসিক্যাল কলামিস্ট। সব পরিচয় ছাপিয়ে, তিনি মূলত একজন কবি। সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান ও মেধাবী কবি। কবিতায় ছন্দের স্পন্দন সৃষ্টিতে এই কবি খুব যতœবান। তিনি বিশ্বাস করেন- সংখ্যাগরিষ্ঠ কবিরা কখনও প্রসিদ্ধ কবিতার জনক হতে পারে না। হাসান হাফিজ, কবিতাচর্চায় বেশ আত্মসচেতন। কবিতার ধারা-উপধারা, শব্দ-বাক্যের প্রযুক্তি নিয়ে তর্ক-বিতর্কের পাশ কাটিয়ে তিনি নিজ ধারা, নিজ আঙ্গিকে কবিতার মধ্যে নিমজ্জিত (কবিতা চর্চায় আজ অবধি মগ্ন আছেন)। কবিতা নিয়ে তিনি নিবিড় অভিলাষে যেন একা জেগে আছেন। সীমান্তের কাঁটাতার ছাপিয়ে বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন দেশে প্রবাসী পাঠকদের কাছে সুপরিচিত হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যায, তাঁর কবিতায় স্বপ্ন বলি, ঐতিহ্য বলি, চিত্রকল্পই বলি, যে বিষয় নিয়েই লিখেছেন, সেই বিষয়ের শৈল্পিক উপাদানকে তিনি সেই রুচিকর্ষের নিরিখে প্রস্ফুটিত করেছেন। সংবেদনশীল কারুকাজ, মার্জিত চিত্র-প্রণালী বা ক্লাসিক লোকঐতিহ্য যতœ করে কবিতার বিষয় করেছেন। যার কারণে একদিকে ঘটেছেÑ প্রচলিত ধারাকে ভাংচুর, অন্যদিকে সৃষ্টিকল্পের প্রত্যাবর্তন। সমকালীন কবিতায় পাঠকশূন্যতার কারণ উদ্ধারে নিজ দায়িত্ববোধ থেকেও কর্ম ও চিন্তার আত্মবৈপরীত্য অনুপ্রাস চর্চা করে চলেছেন নিভৃতে। হাসান হাফিজের জন্ম ১৫ অক্টোবর ১৯৫৫, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা এলাহিনগর গ্রামে। তাঁর লেখা প্রথম ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে, যখন ছিলেন স্কুলছাত্র। এ পর্যন্ত তাঁর বই বেরিয়েছে ১৩০টি। এর মধ্যে মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৪১। সাংবাদিকতা পেশায় তিনি ৪১ বছর ধরে যুক্ত। এই সময় পরিধিতে কাজ করেছেন অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা, দৈনিক জনকণ্ঠ, কলকাতার সাহিত্য দেশ (এখন পাঙ্গিক), বৈশাখী টেলিভিশনে। বর্তমানে পাক্ষিক অনন্যাতে কর্মরত। কবি, প্রাবন্ধিক গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন,... ‘ঝোড়ো আকাশে নয়, নীলাকাশে বিদ্যুতের এ মুড়ো ছুটে যাওয়াই কবিতা। অর্থাৎ পরম্পরা। অর্থাৎ ধারাবাহিকতা। ধারাবাহিকতার মধ্যে নতুনের উন্মেষ। হাসান হাফিজ তাঁর কবিতার পর কবিতায় অনির্ণেয় অন্য কোন মানে খুঁজে চলেছেন। এটাই কবিতার কাজ। কবির কাজ।’ হাসান হাফিজের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে : ‘এখন যৌবন যার’ ‘ভালোবাসা, তার ভাষা,’ ‘অবাধ্য অর্জুন’, ‘তুমি বধূ অবিবাহের’, ‘হয়তো কিছু হবে’, ‘হাসান হাফিজের প্রেমের কবিতা’ দূরে পাহাড়ের ঘুম, সকল ডুবুরি নয় সমান সন্ধিৎসু, তৃষ্ণার তানপুরা, ‘ভালোবাসার অগ্নিচমুক,’ ‘হৃদয় বড়ো কাঁদছে’, ‘না ওড়ে না পোড়ে প্রেম’, ‘যে মধুমদ তোমার ফুলে’, ‘বিভ্রমের বিষলতা’, ‘স্তবগান সুন্দরের’ ইত্যাদি। তাঁর কবিতা থেকে উদ্ধৃতি- ‘আজ সারারাত্রি থাকো আমার সঙ্গিনী হয়ে তুমি স্বপ্ন, মানুষের আকৃতি স্বভাব তোমার অস্তিত্ব মাঝে কেন খুঁজে দেখতে যাই তুমি তো দুর্জ্ঞেয় জানি তারপরও বুঝে দেখতে চাই।’ .. (তাচ্ছিল্য ও হেলাফেলা কেন) প্রথমে কবিতার অর্থ নয়, বন্ধনহীন আবেগ পাঠককে উৎফুল করবে। কাব্যের কারুকাজ, চিন্তাপ্রণালী স্বতন্ত্রস্বক্রিয়তায় পরিবর্তন সত্যি অভিনব। এই অভিনব সিরিয়াস কারুকাজের জন্য যেমন একদিকে ঘটেছেÑসনাতন ধারার ভাংচুর, অন্যদিকে তার স্বতন্ত্র চিন্তাধারা স্বার্থক রূপে করেছে প্রত্যাবর্তন। কাব্যবোদ্ধা, মেধাবী পাঠকদ্বয় মহল নীরবে কবির এই চিন্তাসৃষ্টি গ্রহণ করেছে। কবি এখানেই স্বার্থক। কবিতায় এক দিকে যেমন রাত্রি, সঙ্গিনী, স্বপ্নসহ প্রকৃতির কথা ওঠে এসেছে, অন্যদিকে কবির জগতাভিজ্ঞতার মনোদার্শনিক ফুটে উঠেছে। কবির আবেগ অনুভূতিতে দার্শনিক প্রজ্ঞা যথেষ্ট স্পষ্ট। বলা বাহুল্য, প্রত্যেক কবির কল্পনা, ভাবনা, আবেগ-অনভূতিতে একটা জগৎ থাকে। কল্পনা শক্তিরও একটা দায় থাকে, কবি তা মেনে চলেন। একে ইংরেজীতে বলেÑঢ়ড়বঃরপ লঁংঃরপব. আবার কবির বক্তব্য সরাসরি উপস্থাপিত করা দৃষ্টিকটু। বক্তব্য হতে হয় ইংগিতবাহী, ংঁমমবংঃরাব.এই সব বিষয়বস্তু নিরীক্ষা করে, সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যময় চিন্তার বহির্প্রকাশ, বাস্তব সময় পরীক্ষার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করে হাসান হাফিজের কবিতায়। রাত্রি ও সঙ্গিনীর স্কেচে ছন্দস্নাত পঙ্ক্তিগুলোর ধারাবাহিকতায় ‘তাচ্ছিল্য ও হেলাফেলা কেন’ শিরোনামে কবিতা সার্থক হয়ে উঠেছে। কবি এখানে তারুণ্যস্নাত আবেগকে পুঁজি করে দরদি উপলব্ধির বির্নিমাণ করেছেন। বিশেষভাবে মনন ও কল্পনার দেয়ালে রোমাঞ্চ রঙে-ঢঙে মেলে ধরার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ‘‘লিখতে লিখতে তোমাকে ফুরিয়ে ফেলি। নিঃশেষ ছাইয়ের পুঞ্জ ফুঁড়ে তুমি বারবারই আবির্ভূত, জীবন আশ্চর্য ঢেউ, তুমি কি ফিনিক্স? তোমার বিভ্রম কিংবা পথভ্রান্তি বলে কিছু নেই? এতোটা গোলকধাঁধা মরীচিকা ভ্রম ভেঙে কী করে নির্দিষ্ট খামে নিপুণ প্রবেশ করে।” ... (আশকারা পেয়েছে বলে) তীক্ষè অথচ আবেগস্পন্দিত আহ্বান। সবাই আশকারা পেলে পথভ্রান্ত পথে হেঁটে যেতে চায়। আশকারায় যেখানে ভাংচুর করে, অবিশ্বাস সেখানে বংশবিস্তার করে। কবি হাসান হাফিজ রহস্যের ভেতরবৃত্তে প্রবিষ্ট হয়ে কবিতার নিপুণতা প্রকাশ করেছেন। এখানে তিনি পুরোপুরি সার্থক। কবি হাসান হাফিজ কবিতায় শব্দ নির্বাচন ও শব্দ প্রয়োগ সর্বাপেক্ষা যতœবান। বলাবাহুল্য, (বিশেষ্য বিশেষণ, তৎসম শব্দ, ধ্বনি সুষমা, দার্ঢ্য সংযোজন করেন যতœসহকারে। কবিতার স্তরে স্তরে বাস্তব জীবনের সঙ্গে স্বপ্নের রঙিন আলোকরশ্মি সমীকরণের নান্দনিক ব্যবহার পাঠকচিত্তকে মুগ্ধ করে। ভদ্র-শান্ত বিনয়ী স্বভাবের কবি হাসান হাফিজ বিশ্বাস করেন, প্রকৃত মনের মানুষ না হলে প্রকৃত কবি হওয়া যায় না। কিছু কিছু কবির শিষ্টাচার চর্চা আবশ্যক। আর অহঙ্কার কবির অন্বিষ্টের জন্য ভয়ঙ্কর প্রভাববলয়। হাসান হাফিজের কবিতার চিত্রকল্পে নগর, নিসর্গ, যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রকৃতির জন্য গভীর মমতা ও যতেœর প্রচ্ছায়া। এছাড়াও ঐতিহ্যচেতনার মননদীপ্ততায় বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতগুলো কবিতায় গ্রন্থিত করেছেন তিনি। মানুষ-সমাজ কল্যাণের পক্ষে হাসান হাফিজ সবসময়ই সোচ্চার। উদার। তাঁর কবিতার সৌন্দর্যের বাচনভঙ্গি ভিন্নতর। এটাই হাসান হাফিজের কবিতার নান্দনিক পরিচয়। এক কথায় হাসান হাফিজের কবিতা স্বপ্নকল্পনার আল্পনা।
×