ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহ বুলবুল

জীবনবোধের মহান সাধক

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

জীবনবোধের মহান সাধক

১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে বাউল মতের জন্ম হলেও ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তা একটি পরিপূর্ণ মতবাদের আকার ধারণ করে। এটা বৈষ্ণব ও মুসলমান ফকিরদের যৌথ ধর্ম হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জন্ম ও বিকাশ ঘটে। এটাকে অনুমেয় সময় ধরা হয়। অনুমেয় ও শাস্ত্রীয় বক্তব্য ছাড়াও অনেকে মনে করেন, ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বাউল ধর্মের সূচনা এবং ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ ২৬০ বছর কালব্যাপী এ ধর্মের উৎপত্তি, বিকাশ ও বিস্তৃতি। সাধারণভাবে মনে করা হয়, হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের নিঃস্ব এক শ্রেণীর মানুষই সাধারণত ‘বাউল’। এরা সচরাচর ভিক্ষাজীবী। দেশ-সমাজ, রাষ্ট্র-লোকাচার, প্রতিপত্তি, লোভ-লালসা সকল উপাদানের উর্ধে বাউলেরা ‘জীয়ন্তে মৃতে’র প্রতিবিম্ব। বাউল মতের জনক মাধব বিবি ও আউল চাঁদ হলেও এদের শিষ্য নিত্যানন্দ ও পুত্র বীরভদ্র বাউল মতকে মানব মানসে প্রত্যাশা, পবিত্র ও প্রত্যয়ের মাঝে এক অনন্য জীবনের প্রতিচিত্র হিসেবে তুলে ধরেন। মূলতঃ এ সময়ই বাউল মতবাদ জনপ্রিয়তার পরশ পাথরে সর্বদিক জয় করে নেয়। বাউলেরা কোন শাস্ত্র, বই পুস্তক বা প্রচলিত ধর্মের ধার-ধারেনি। মানব ধর্মই এদের পরম উপাস্য। মাটি ও মানুষের গানই এদের প্রাণ এবং জীবন-জীবিকার একমাত্র সম্বল। বাউল পথিক সাধনে-ভজনে-গানে-লোক কবিতায় অশান্ত পৃথিবীকে শান্তি ও প্রেমের ডাক দিয়ে যায়। আজন্ম কাল ধরে বাঙালীর মননে যে মরমীয়াবাদ পালন হচ্ছে সেই সাধনায় সর্বকালের ভাব নিসৃত এক নাম ‘লালন শাহ’। যাঁকে বলা হয় বাউল সমাজ ও সম্প্রদায়ের মুকুটহীন সম্রাট। বাউল সম্রাট লালন শাহ। জন্ম ও জীবন নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গ্রন্থ, তথ্যচিত্র, চলচ্চিত্র। সৃষ্টি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আখ্যান। কেউ বলে, লালন কায়স্থ সন্তান। কেউ বলে কর। আবার কেউ কেউ দাশ বলে দাবি করেছেন। তবে লালন শাহের জন্ম সম্পর্কিত সর্বাধিক সমর্থিত মতটি হচ্ছে- বাউল লালন শাহ এক সাধারণ হিন্দু ঘরে জন্ম নেওয়া হিন্দু সন্তান। কুমার খালির কোন এক গাঁয়ে ১৭৭৪ সালে লালন শাহ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার ১১৬ বছর বয়সে সেঁউড়িয়া গ্রামে এই বাউল সম্রাট ইহ জগৎ ত্যাগ করেন। বর্তমানে সেঁউড়িয়া গ্রামে লালন শাহের মাজার অবস্থিত। অল্প বয়সে বিয়ে করা লালন একদিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তীর্থ দর্শনে যান। তীর্থ দর্শন শেষে বাড়ি ফেরা পথিক লালন শাহ পথেই মারাত্মক বসন্ত রোগের মুখে পতিত হয়। বসন্তে আক্রান্ত লালন শাহকে সহযাত্রীরা পথের মাঝেই অসহায়ভাবে রেখে যান। এমতাবস্থায় সিরাজ ফকির নামক এক নিঃসন্তান পালকি বাহক মৃত্যু পথের পথিক লালন শাহকে ঘরে নিয়ে আসে। পালকি বাহক সিরাজ ফকির ও তার স্ত্রীর সেবা শুশ্রƒষায় লালন তিলে তিলে সুস্থ হয়ে উঠলেও তার এক চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এদিকে লালনের সহযাত্রীরা বসন্ত আক্রান্ত লালন শাহকে পথে ফেলে গিয়ে এলাকায় প্রচার করেন যে, বসন্ত রোগে লালন মারা গেছে। সুস্থ হয়ে লালন কুমারখালীর নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু মুসলমান হাতে সেবা পেয়ে নতুন জীবন প্রাপ্ত লালনকে তার হিন্দু সমাজ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। মুসলমান হাতের সেবা গ্রহণে লালনের ধর্ম বিকিয়ে গেছে এমন অভিযোগে লালন শাহের পরিজন এমনকি স্ত্রী পর্যন্ত লালনকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। জীবনের দুর্গম পথে ধর্মের এমন বৈরিতা লালনের মনকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সংসার পরিজনের এমন নিষ্ঠুর আচরণে জন্ম নেয় সংসার ধর্ম বিবাগী বিদ্রোহী সত্তার আর এক লালন। নতুন জীবনের সন্ধানে পুনরায় সিরাজ সাঁইয়ের কাছে আসেন এবং সাঁইকে গুরু পদে বরণ করে লিখতে বসেন বাউল জীবন ও বাউল সম্প্রদায়ের এক স্বর্ণগর্ভা অধ্যায়। লালন নানা তীর্থ স্থান ও ধর্ম দর্শন করে আত্মার নিভৃত জমিনে যে নতুন মর্মের সন্ধান পান তার ভিত্তিতেই বাউল সম্প্রদায়কে করেছেন অনেক অনেক সমৃদ্ধ। এভাবে নানা তীর্থ স্থান ভ্রমণ শেষে ১৮২৩ সালে ছেঁউড়িয়া গ্রামে জোল জাতের এক মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে ছেঁউড়িয়া গ্রামেই বসবাস করতে থাকেন। জীবনের চরম দুঃসময়ে স্বধর্ম ও স্বজনহারা লালন শাহ কোন ধর্মেই বিশ্বাসী হতে পারেননি। লালন শাহ আমৃত্যু মানবের ¯িœগ্ধ জমিনে বসে গেয়ে গেছেন মানব প্রেমের গান। দর্শনে গানে বিলিয়েছেন মানবতাবোধের এক অমীয় সুধা। নিজের ভেতরে একটু একটু করে সাধনায় সৃষ্ট সংগীত ও দর্শনের সঙ্গে মানবপ্রেম মিশিয়ে গেঁথেছেন মানুষে মানুষে অভেদ আত্মার সেতুবন্ধন। যেখানে জাত, ধর্ম, কুলাচার, বিভেদ, বৈষম্যের স্পর্শও নেই। বাউল সম্রাট লালন দর্শনের জ্যান্ত প্রমাণ মুসলিম বাউলের হিন্দু শিষ্য আর হিন্দু বাউলের মুসলমান শিষ্য। জানা যায়, বাউল মনাই শেখের শিষ্য ছিল কালা চাঁদ মিস্ত্রি এবং কালা চাঁদ মিস্ত্রির শিষ্য হারাই ছিল নমঃশূদ্র এবং তার শিষ্য দিনু ছিল জাতিতে নট। বাউল নিত্যনন্দের শিষ্য ছিল বলা কৈর্বত আবার বলা কৈর্বতের শিষ্য ছিল মাধা পটিয়াল, কাপালি এবং তার শিষ্য গঙ্গারাম। লালন শাহকে বলা হয় বাউল সম্প্রদায়ের মুকুটহীন সম্রাট কারণ তার হাতেই বাউল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি ও সৃজনশীলতা সৌরভ ছড়িয়েছে আপন মহিমায়। বাউল মতবাদের সৃচনা থেকে পূর্ণতা প্রাপ্তির ৩০০ বছরের ইতিহাসে লালন শাহ ছিল এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা। নিশ্চিন্তে বলা যায়, লালন শাহের আগে কোন বাউল তাদের মতে এত গৌরব ও সম্মান অর্জন করতে পারেননি। বাউল সমাজের এই অমূল্যধন আমৃত্যু বাউল সংগীত ও সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ফলে ভিক্ষাজীবী বাউল সম্প্রদায়ের লালন শাহের আগমন ছিল আঁধার ভাঙ্গা আলোর মহা প্রলয়। এ কথা সবারই জানা, আমাদের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালন শাহের দর্শন ও গানের অনুরাগী ছিলেন। কবি গুরুর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা, ভাবধারা সবকিছুতে শান্তি আর হিংসামুক্ত মানবিক পৃথিবীর কথা বলেছেন। ১৯১০ সালে রচিত বাউল রাগে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গান যেন সে কথাই বলছেÑ আামার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তায় সকল খানে। আছে সে নয়নতারায় আলোকধারায়, তাই না হারায়ÑÑ ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায় তাকাই আমি যে দিকÑপানে। এছাড়াও ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে হীবার্ট বক্তৃতায় লালন শাহের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ শিরোনামে বাউল তত্ত্ব বিষয়ে ‘ ঞযব সধহ ড়ভ সু যবধৎঃ ’ এ মূলত বাউল সম্রাট লালন শাহের কথাই স্বীকার করেছেন। লালন শাহ প্রথাগত ধর্ম, আচার, মোহের অনেক অনেক উর্ধে বসে নিজের ভেতর রচনা করেছেন আমার ‘আমিত্ব’ নামক এক অন্যরকম স্বর্গ। যেখানে মানবপ্রেম জন্ম নিতো অবরিত ফসলের নিত্য চাষবাসে। ১১৬ বছরের জীবনে এই মহাপুরুষ মানব প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে দেহতাত্ত্বিক গানের সম্ভারকে করেছেন সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর। বাউল সম্রাটের গানের সংখ্যা কত এই নিয়ে বেশ মতান্তর থাকলেও মতিলাল দাশ, আনোয়ারুল করিম, ড. উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য, রিয়াজুল হক, ড. আশরাফ সিদ্দিকী এর মতো লালন গবেষকরা লালনের গান সহস্রাধিক বলে অভিমত দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, লালন শাহ শুধু সহস্রাধিক গানেরই রচয়িতা ছিলেন না বরং সুরও দিয়েছেন মানুষের মনÑপ্রাণ স্পর্শ করে। এই বাউল সম্রাটের হাতেই বাউল গানের ভিন্ন ধাঁচ ও নতুন ঘরানার এক লৌকিক সৌধ তৈরি হয়। বাউল সম্প্রদায়ের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব মুকুটহীন বাউল সম্রাট লালন ছিলেন উভয় বাংলার আড়াই লাখ বাউলের গুরু। এই বাউল গুরুর মরমীয়াবাদ আজও আমাদের অন্তরস্থলকে ভাব ও মানব প্রেমের এক অমিয় সুধায় আবিষ্ট করে রাখে। লালন শাহের সাধনা, চর্চা সবই ছিল মানুষের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর প্রেমে প্রজ্বলিত। তিনি জাতÑপাত বৈষম্যহীন মানব সমাজের সাধনা করতেন। লালনের চেতনায় মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে বিচার করতে হবে। এক মানুষ আরেক মানুষকে ভাবতে হবে ভাবনার সর্বোচ্চ আসনে রেখে। একজন মানবপ্রেমী সংস্কারমুক্ত বাউল হিসেবে লালন এই সম্পর্কিত গানে বলেছেন- ‘জাত না গেলে পাইনে হরি কি ছার জাতের গৌরব করি ছঁসনে বলিয়ে। লালন কয় জাত হাতে পেলে পুড়তাম আগুন দিয়ে।’ বাউল সাধনার যাপিত মালার প্রতি গোটাই দেহকে কেন্দ্র করে। তাই বাউল সাধনাকে দেহতাত্ত্বিক সাধনাও বলা হয়। লালন শাহ তেমনি সাধনার শীর্ষ চূড়ায় মানব দেহকেই সাধনার পূর্ণতীর্থ বলে মেনে নিয়েছেন। বাউল সম্রাট লালন শাহের গানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেহতাত্ত্বিক গান বলা হয় কারণ লালন মনে করতেন, এই দেহের মধ্যেই পরম মানুষের নিভৃত বসবাস। যে নিজেকে চিনবে ও জানবে সেই খুঁজে নিতে পারবে আত্মার ভেতকার বসতীকে। আমরা দেখতে পাই, লালন শাহ তার গানে মানব দেহকে নানা উপমায় উপস্থাপন করেছেন। যেমন- ‘ঘর’, ‘খাঁচা’, ‘আরশিনগর’ ইত্যাদি। সব নাম ও ব্যাকুলতার আড়ালে লালন শাহ দেহ ঘরের অলিতে গলিতে পরম করুণাময়ের সন্ধান করেছেন। যা তাঁর গানের ভাষায় আকুল হয়ে কাঁদে- ‘আমার ঘর খানায় কে বিরাজ করে। জনম ভরে একদিনও তারে দেখলাম না রে। নড়ে চড়ে ঈশানকোণে দেখতে পাইনি এ নয়নে হাতের কাছে যার ভবের হাট বাজার ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে’। লালন শাহ তার আমৃত্যু সাধনায় পরম আত্মার সঙ্গে নীরব নিবিড় বন্ধন গড়ে গেছেন। যেখানে স্বর্গের লোভ বা নরকের ভয় ছিল না। বরং তার চেয়ে মহৎ ও মানবিক চিন্তা বাউল লালন শাহকে করেছে বাউল জগতের মুকুটহীন সম্রাট। তার দর্শন ও সাধনার ফসল বিশ্বময় মানুষের মানবিক দিগন্তে ঘটে যাওয়া স্থায়ী রেনেসাঁ। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব কটি দেশের মানুষ আজ মানবাধিকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। ধর্ম, বংশ, ক্ষমতা, সীমাহীন উপার্জনের বিষধর লোভ মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। খুনের নেশায় মত্ত বিশ্ব আজ যুদ্ধের জ্বলন্ত কু-। যখন তখন সেখানে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সভ্যতা কাঁদছে। কান পাতলেই বিবেক দংশিত হচ্ছে মানুষের অসহায় আর্তচিৎকারে। এই হত্যার প্রতিযোগিতা পৃথিবী নামক গ্রহের অন্য কোন জীবের সঙ্গে নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের। দেশে দেশে মানবাধিকার কমিশন গঠিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে শক্তিশালী ও স্বাধীন মানবাধিকার। অথচ দিনের শুরুটাই হচ্ছে একটি মানুষের লাশ-লাশের বীভৎষ ছবি, হত্যা-হানাহানি বা দখলদারিত্বের আদিমতা নিয়ে। প্রতিহিংসার রণাঙ্গনে বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে আরেকবার প্রশান্তি দিতে আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বাউল সম্রাট লালনের দর্শন। সব পেরিয়ে এটাই ধ্রুব সত্য যে, লালন শাহের ভাব মোহনায় মিশে গিয়ে জয় করতে হবে অভাব, যুদ্ধ আর অবিশ্বাসের অজেয় রাজ্য।
×