ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

জলবায়ুর প্রভাব শীত ও সাহিত্য

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

জলবায়ুর প্রভাব শীত ও সাহিত্য

জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশে শীত এখন সংক্ষিপ্ত ঋতু। এক সময় প্রচলিত ছিল ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’। সেই হাড় কাঁপানো শীতের সঙ্গে এখনকার প্রজন্মের পরিচয় নেই। ঋতুর হিসেবে পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল হলেও শীত শুরু হতো আসলে হেমন্তকাল থেকেই। বিভ্রম জাগত কার্তিককে শীতের প্রতিনিধি বলে। সেই প্রচ- শীতের এক ধরনের মিষ্টতা ছিল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায় ঋতু বৈচিত্রের এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্রমশ ম্রিয়মান। তবু ঋতুর প্রভাব বাঙালীর জীবনে ও উদযাপনে অনিবার্য। তাই ঋতুর পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয় যাপন, পরিবর্তিত হয় আহার ও উৎসব। আমাদের ঋতু ছয়টি হলেও এখন অনুভূত হয় মূলত তিনটিÑ গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। অন্যান্য ঋতুর মতো শীত যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাধারণ মানুষের, তেমনি লেখক-শিল্পীদেরও আকর্ষিত করে বিশেষভাবে। বিশেষভাবে বললাম, কারণ শিল্পী মাত্রই একজন বিশেষ মানুষ। সাধারণ মানুষ যা দেখেন না, শোনেন না, ভাবেন নাÑ শিল্পী মানুষটি সেই না দেখা, না শোনা, না ভাবা কথাগুলো দৃশ্যগুলো সহজেই এঁকে নিতে পারেন। এ জন্য কবিই একমাত্র বলতে পারেনÑ ‘শিশিরের শব্দের মতোন সন্ধ্যা আসে।’ শীতকে এক দল সাহিত্যিক দেখেছেন নিসর্গের গৌরবে। আরেক দল শীতকে দেখেছেন শ্রমজীবী মানুষের চোখে। নিসর্গের গৌরবে শীত নতুন মাত্রা পেয়েছে। শিশির বিন্দু, কুয়াশার চাদর, পাতা ঝরা, পিঠা-পুলি, খেজুরের রস, মোয়া-মুড়ির মোড়কে শীত বাঙালী জীবনে অপার আনন্দ নিয়ে আসে। আবার বস্ত্রহীন মানুষ, শ্রমজীবী, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের চোখে শীত আসে একটি গরম কাপড়ের হাহাকার নিয়ে। আগুনের আঁচ পাওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে। দ্বিতীয় দল সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় এই গরম কাপড়, কর্মহীনতা, আগুনের আঁচ পাওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে লিখেছেন। আবার এমন সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া যাবেÑ যারা কিনা দুই ভাবেই দেখেছেন, লিখেছেন। আলোচ্য আলোচনায় শুরুতেই শীতের করাল রূপ নিয়ে দু’কথা বলা যাক। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘চ-ীমঙ্গল কাব্য’-এ শীতের জরা, ক্ষয়, দরিদ্রের হাহাকারের বর্ণনা আছে। কবি মুকুন্দরাম ফুল্লরার মধ্য দিয়ে শীতকালকে তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ। যগজনে করে শীত-নিবারণ বাস নিযুক্ত করিল বিধি সভার কাপড়। অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের ছড়’ অগ্রজ কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত শীতকালকে দেখেছেন ‘সর্বনাশী’ হিসেবে। তাঁর মতে, বিশ্বের বুকে শবাসন পেতে বসে থাকা শীত ঋতু হচ্ছে ‘প্রলয়’ সাধনকারী রুদ্র সন্ন্যাসী। মানুষের জরা, জীর্ণতা, বৃক্ষের পাতা ঝরার দিনে শীত যেন মায়ামন্ত্রে মরণের আবাহন করে। তাঁর ভাষায় : ‘বর্ণ-গন্ধ-গীত-বিচিত্রিত জগতের নিত্য প্রাণস্পন্দ,/ কি স্বতন্ত্র মায়ামন্ত্র বলে পলে পলে হয়ে আসে বন্ধ।/মরণের আবাহন তরে কেন এই তীব্র আরাধন- চেষ্টা/সর্বনাশী/বর্ষপরে বিশ্বজুড়ে বসিলে আবার, হে রুদ্র সন্ন্যাসী।/ তোমার বিশাল বক্ষে উঠিছে পড়িছে/পূরকে রেচকে দীর্ঘশ্বাসে/ওগো যোগীশ্বর!/তব প্রতি পূরক নিঃশ্বাস আকষিছে দুর্নিবার টানে/ মৃত্যুভয়ভীতি সর্বজনে তব বক্ষ গহ্বর পানে।/...শীত ভয়ংকর!’ ‘শীত’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক গান ও কবিতা লিখেছেন। শীত নিয়ে তাঁর লেখা গানের সংখ্যা বারোটি। স্বভাবতই কবিগুরু শীতের নিসর্গ ও পীড়ন দুটোই তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতা, গানে, গদ্যে। ‘শীত’ কবিতায় দেখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখি তিনি বলছেন : ‘শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এলো/গানের বেলা শেষ না হতে হতে?/মনের কথা ছড়িয়ে এলোমেলো/ভাসিয়ে দিল শুকনো পাতার ¯্রােতে।’ রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটিতে যে গল্পধর্মী উপস্থাপন তার শুরু করা হয়েছে ‘বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস/স্বচ্ছসলিলা বরুণা’ বলে। আবার ‘শীতের রোদ্দুর’ কবিতায় লিখেছেন : ‘শীতের রোদ্দুর। সোনা-মেশা সবুজের ঢেউ স্তম্ভিত হয়ে আছে সেগুন বনে। ... কাজ ভোলা এই দিন উধাও বলাকার মতো লীন হয়ে চলেছে নিঃসীম সীমানায়।’ সুকান্ত ভট্টাচার্য শ্রেণী সংগ্রামের কবি। তাঁর ভাবনায় নিসর্গের চেয়ে জনজীবন প্রাধান্য পাবে এমনটাই স্বাভাবিক। সুকান্ত শীতে দরিদ্রের কষ্ট। দেখেছেন পথের ছেলেগুলোর জন্য শীত কতটা যাতনাময়। শীত যেন বিভীষিকা। গরিবদের শীত নিবারণের জন্য সূর্যই হয়ে দাঁড়ায় উষ্ণতার অবলম্বন। ‘কৃষকের চঞ্চল চোখ ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলোর জন্য’ যেমন প্রতীক্ষা করে, তেমনি দরিদ্ররা ‘হিমশীতল রাতের পর উত্তাপ বিলানো সূর্য ওঠার জন্য’ প্রতীক্ষায় থাকে। শীত নিবারণের জন্য শীতার্তদের কাছে ‘সকালের এক টুকরো রোদ্দুর’ এক টুকরো সোনার চেয়েও দামী মনে হয়। সেই সূর্যের প্রতি ‘প্রার্থী’ কবিতায় সুকান্তের আহ্বান: ‘হে সূর্য! তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে উত্তাপ আর আলো দিও আর উত্তাপ দিও রাস্তার ধারের ওই উলঙ্গ ছেলেটাকে।’ শীতে দরিদ্রদের কষ্টের কথা চিন্তা করেছিলেন সুকান্ত। নবারুণ ভট্টাচার্যও শীতকে দেখেছেন পীড়িতের, বঞ্চিতদের চোখ দিয়ে। পাশাপাশি তার কবিতায় উচ্চকিত হয়েছে মানবতা। শোষকদের প্রতি তার কবিতায় আছে প্রবল কটাক্ষবাণ ও অজস্র ধিক্কারধ্বনি। ‘শীতে জমে মরে যাওয়া বুড়ো ভিখিরির গান’ কবিতাটি এ রকম চিন্তারই ফসল। এ কবিতায় নবারুণ ভট্টাচার্যের তীব্র তীরÑ ‘এনজিওরা কি জানে যে আমার আর দরকার নেই সহৃদয় কম্বল বা সাহেবদের বাতিল জামার সবারই কি শীত করছে এমন না শুধুই আমার গাছেদের কি শীত করছে এমন কুকুদেরও কি শীত করছে এমন রাস্তা, সিনেমা হল, টিপকল, রেস্তরাঁ, বিউটি পার্লার সকলেরই কি শীত করছে এমন মথ, পাখি-মেঘ, মদ, গ্রহ সবারই কি শীত করছে এমন- জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শীত এসেছে মৃত্যুর গন্ধ নিয়ে। আবার তার কবিতায় শীত এসেছে স্বভাবসুলভ প্রকৃতির মুগ্ধতায়। কবির কাছে ‘ধান কাটা হয়ে গেছে’ কবিতায় শীত এসে ধরা দিয়েছে ‘সাপের খোলস নীড় শীত’ হিসেবে। আবার ‘শীত রাত’ কবিতায় তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, ‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;/বাইরে হয়ত শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,/কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।’ এমন আরও কিছু কবিতার কথা এ প্রসঙ্গে বলা যাবেÑ যে কবিতাগুলোতে শীতে কবির নৈরাশ্যবাদ, নিঃসঙ্গতা ও হাহাকার প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এতো কিছু সত্ত্বেও কবি জানতেন শীতের পরেই বসন্ত আসবে। এসবের বাইরে তাঁর ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটির কথা উপস্থাপন করতে চাই। কবিতার নাম ‘মৃত্যুর আগে’ হলেও এ কবিতায় জীবনানন্দীয় ঘোরলাগা চোখে আমরা আবিষ্কার করি অন্যরকম এক শীত রাত্রিকে। প্রকৃতি, চিন্তা ও দর্শন যেন হানা দেয় এ কবিতার পরতে পরতে- ‘আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো, খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার : পুরনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারাল! বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক; আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক...।’ আমরা দেখি বুদ্ধদেব বসুও শীতরাতকে বোদলেয়ারীয় দৃষ্টিতে দেখেছেন। এ বিষয়ে জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর মধ্যে সাযুজ্য উল্লেখ করার মতো। বুদ্ধদেব বসু এই শীতে মরে যেতে চান হঠাৎ। মৃত্যুর গন্ধ তাঁর দুয়ারে এসেও হানা দেয়। তাঁকে ‘এই শীতে’ কবিতায় বলতে শুনি- ‘আমি যদি ম’রে যেতে পারতুম/এই শীতে,/গাছ যেমন ম’রে যায়,/সাপ যেমন ম’রে থাকে/সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে।’ আবার ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘এসো শান্ত হও; এই হিমরাতে, যখন বাইরে-ভিতরে/কোথাও আলো নেই/ তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য/ প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও।’ শীত পাতাশূন্য ঋতু হলেও প্রাণহীন ঋতু নয়। শীতে ক্ষেতে ক্ষেতে থাকে শর্ষে ফুল। হলুদ শর্ষের মুখগুলো প্রকৃতিতে বাড়ায় নতুন শোভা। শীতের সকালে ঘাসের ওপর জমে থাকে শিশির। শীতের রোদ যেন মধু মাখা। ঘরে ঘরে পিঠা পায়েস তৈরি হয়। খেজুর রসের পায়েস, মোয়া, মুড়ি ও ভাঁপাপিঠা রঙিন করে তোলে শীতকালকে। অনেক কবিই শীতের এমন উজ্জ্বল রূপ তুলে ধরেছেন কবিতায়। এ দলে যেমন রবীন্দ্রনাথ আছেন, সুফিয়া কামাল আছেন তেমনি আছেন সমকালীন অনেক কবিও। নজরুলকে দেখি ‘পউষ এলো গো’ বলে শীত নিয়ে উচ্ছ্বাসিত হতে। শীতের প্রকৃতি নিয়ে তিনি বলছেন, ‘ওই যে এল গো/কুজ্বটিকার ঘোমটা-পরা দিগন্ত দাঁড়ায়ে।’ ‘পল্লী স্মৃতি’ কবিতায় সুফিয়া কামাল শৈশবের নানা প্রসঙ্গ ও আনন্দের বিষয়গুলোর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন শীতের কথা। তাঁর শীতের পিঠাপুলি খাওয়ার স্মৃতি : ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে,/আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’ জসীমউদ্দীন পল্লী কবি। তাঁর কবিতাগুলোতে শীত বর্ণিল হয়েছে। কবি শীতের সকালে দেখেন, ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে/সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।’ আবুল হাসান স্বল্পায়ু কিন্তু প্রসারিত জীবন পাওয়া কবি। তাঁর কবিতায় শীত এসেছে প্রেমিকের চোখে। শীতে প্রেম যেন আরও প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। কবি এমন শীতে স্বপ্ন দেখেন, তার প্রেয়সীর চুলে তিনি শিশির ভরে রাখবেন, ঠা-ায় প্রিয়ার মাথা ধরে গেলে তিনি এক চুমুতে সেই মাথা ধরাও সারিয়ে দিবেন! আবুল হাসানের ‘শীতে ভালবাসা পদ্ধতি’ এমন : ‘কনক তুমি শীতে এবার কার্ডিগানটা পরো কেমন? আমাকে তুমি শিখিয়ে দিও লালঝুটো সেই পাখির নামটি? কনক আমরা এবার শীতে নদীর তীরে হো হো হাসবো, সন্ধ্যেবেলা তোমার চুলে শিশির ভরে রাখবো লক্ষ্মী তোমার অনামিকায় কামড় দিয়ে আমি হঠাৎ আবার ‘যাহ-কী-দুষ্টু’ ওষ্ঠে তোমার ওষ্ঠ ছোঁবো সকাল বেলায় সূর্যোদয়ের কাছে কেবল শান্তি চাইবো, বুঝলে কনক তোমার মাথাধরাও আমি এক চুমোতে সারিয়ে দেবো!’ শীতের বিবিধ প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায়। তবে এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘শীত এলে’ কবিতার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে চাই। কবির চোখে ধরা পড়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে আসছে শীতে, এই বাংলাদেশে। সদূর সাইবেরিয়া থেকে অতিথি হয়ে ওরা আসে। ওদের কল-কাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সমগ্র শীতকাল। কবির চোখে এমন সৌন্দর্য যেন ঘোরলাগা, আবিষ্ট : ‘শীত এলে পাখিগুলি আসে হিমেল সমুদ্র ভেঙে আকাশে আকাশে ডানার কাঁপনে লাগে চঞ্চলিত বহতা সবুজ পাখিদের বুক যেন রাঙা তরমুজ পাখির বুকের কাছে আঁকাবাঁকা নদীগুলি হাসে...’ হাসান হাফিজুর রহমানের বিখ্যাত গল্প ‘আরো দুটি মৃত্যু’তেও শীতের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করি। শীত এখানে আতঙ্কের সমার্থক হয়ে এসেছে। মৃত্যু ও হিমশীত যেন সমার্থক। হাসান হাফিজুর রহমান গল্পের শুরু করেছেন এভাবে : ‘অন্ধকার রাত, কিছুই চোখে পড়ছে না। স্টেশন ঘরটার জানালা ও দরজায় যে আলোর আভাস ছিল, চোখের ওপর অকস্মাত ঝাপটা দিয়ে চলে গেছে ট্রেন থামতে না থামতেই। কামরাগুলোর আলোকিত গহ্বরকে চারদিক থেকে মুড়ে দিয়েছে কালো রাত। বাইরে হাতটি মেলে ধরলেও চিহ্নিত করা যাবে না। ভীষণ শীত পড়েছে; যাত্রী কেউ উঠবে, কি উঠবে না কে দেখে! ভেতরে সব গুটিগুটি মেরে বসে আছি নিলিপ্ত হয়ে।’ একটু পরই দেখি গল্পকার বলছেন, ‘জরুরী কাজ ছিল বটে, বাড়ি ফিরতে পারিনি। মাঘ-শেষের পড়ন্ত শীতের দিন, অথচ এমনি হিম বাতাস জাপটা দিচ্ছিল যে আমার মনে হয়েছিল অন্তত আমার জীবনের এতগুলো বছরের সজাগ অভিজ্ঞতায় এমনটি আর কখনও দেখিনি। আকাশে প্রান্তরে ছিল শীত আর আতঙ্ক, মানুষেব মুখে মুখে ছিল স্তব্ধতা আর আতঙ্ক। শান্তিকামী কলোনির সারা ঠাঁই জুড়ে সে কি! প্রতিরোধ, দাঙ্গাকে রুখতে প্রাণান্ত হয়েছিল।’ গল্পকার দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিষয়কে উপস্থাপনের জন্য ‘শীত’কে ঋতু হিসেবে বেছে নিয়ে তা যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। ফলে গল্পটি হয়ে উঠেছে সৃষ্টি সফল ও কালজয়ী। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য গল্পকার। তার কয়েকটি গল্পে অন্যান্য ঋতুর মতো শীতকালের সরব উপস্থিতি রয়েছে। ‘ভারতবর্ষ’ গল্পে সেই শীতের উপস্থিতিই হঠাৎ যেন প্রকট হয়ে ওঠে। তাঁর ভাষায় : ‘...সময়টা ছিল শীতের। বাজারে উত্তরে বিশাল মাঠ থেকে কনকনে বাতাস বয়ে আসছিল সারাক্ষণ। তারপর আকাশ ধূসর হল মেঘে। হাল্কা বৃষ্টি শুরু হলো। রাঢ়বাংলার শীত এমনিতেই খুব জাঁকালো। বৃষ্টিতে তা হলো ধারালো। ভদ্রলোকে বলে ‘পউষে বাদলা’। ছোটলোকে বলে ‘ডাওর’। ... তখনও দূরের মাঠে ধান কাটা হয়নি। এই অকাল-দুর্যোগে ধানের ক্ষতি হবে প্রচ-।’ হাসান আজিজুল হককেও দেখি তিনি শীতের রং ও বিবর্ণতাকে স্পর্শ করেছেন তাঁর গল্পে। শীতের হীম ঠা-া, ঝরা পাতার শব্দ, কনকনে হু হু বাতাস, শুকনো খাল বিল ডোবা, সাদা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চরাচরÑ এমন সব বর্ণনা বিশেষভাবে পাওয়া যায় হাসানের ‘পরবাসী’ গল্পে। গল্পটার শুরুই হয়েছে শীতের সরব উপস্থিতির মধ্য দিয়ে, এভাবে : ‘কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল সে। কিছু একটা শব্দ। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না। বাতাস কিংবা পাতা ঝরার শব্দ ... কোন কিছুই তার কানে এলো না। এই এতটুকু সময়ের মধ্যেই মাটি বরফের মতো ঠা-া হয়ে এসেছে। নিঃশব্দ শিশিরের হিমে স্নান করে বিবর্ণ পাতাগুলো ভিজে। শীতের শেষ বলে সারাদিন ধরে উত্তর দিক থেকে ঝড়ের বেগে বাতাস দিয়েছে... খোলা মাঠ পেয়ে বাতাস হু হু করে দৌড়ুতে দৌড়ুতে শরীরের সমস্ত উত্তাপ শুষে নিয়ে চলে গেছে। তারপর নতুন করে আবার জাপটা এসেছে। কিন্তু সন্ধ্যার সূচনাতেই বাতাস দু’-একবার ডানা জাপটা দিয়ে শুকনো পাতা ঝরিয়ে একেবারে এ দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে এসেছে বড় বড় মাঠ, ছিলে ছিলে পানি-জমা ডোবা এবং খাল, আধ শুকনো হলদেটে অপরিচিত লতাপাতা কাঁটা-গুল্মের স্তূপাকার জঙ্গল। ওর চারপাশের কয়েক হাত জায়গা বাদ দিয়ে নিউমোনিয়া রোগীর শ্লেষ্মার মতো জমে বসেছে কুয়াশা। সারাদিনের ঝড়ো বাতাসের জায়গায় এসেছে কুয়াশা। সেই কুয়াশা এবং ম্লান রঙের আকাশ ও বাসি মড়ার মতো জলো অন্ধকারের নিচে তার চারপাশের পৃথিবীটা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করল। কিছু একটা শব্দ। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না। বাতাস কিংবা ঝরা পাতার শব্দ, নিদেনপক্ষে শুকনো পাতার ওপর শিশির পড়ার টপ টপ শব্দ অথবা কোন ছোট বন্যপ্রাণীর চকিত পদধ্বনি।’ শীতকে গল্পের মোড়কে উপস্থাপনের জন্য হাসান আজিজুল হক যে শব্দ চয়ন ও দৃশ্যকল্প সৃষ্টিতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেনÑ তা বলাই বাহুল্য। উপন্যাসেও শীত বিষয়ক অসংখ্য বর্ণনা আছে। তবে স্থান সীমাবদ্ধতার জন্য এ নিবন্ধে সৈয়দ ওয়ালীউল্লার দুটি উপন্যাস নিয়ে কথা বলব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাসের কথা প্রথমে বলছি। কারণ, এটি বাংলা সাহিত্যেরও বিশেষ বৈশিষ্ট্যম-িত উপন্যাস। লালসালুতে দেখি ওয়ালীউল্লাহ ধান সিদ্ধ করার বর্ণনা দিয়েছেন পরিচিত ঢংয়ে। বাঙালীর দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য শীতের মাঝরাত থেকে বা ভোররাত থেকে ধান সিদ্ধ করা। নারীরা সকাল পর্যন্ত ধান সিদ্ধ করে সে ধান ভোরে রোদে শুকাতে দেয়। ওয়ালীউল্লাহ তাঁর বিখ্যাত চরিত্র মজিদের চোখে সেই ধান সিদ্ধ করাকে উপস্থাপন করেছেন এভাবে : ‘পৌষের রাত। প্রান্তর থেকে ঠা-া হাওয়া এসে হাড় কাঁপায়। গভীর রাতে রহিমা আর হাসুনির মা ধান সিদ্ধ করে। খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে, আলোকিত হয়ে উঠেছে সারা উঠানটা। ওপরে আকাশ অন্ধকার। গনগনে আগুনের শিখা যেন সে কালো আকাশ গিয়ে ছোঁয়। ওধারে ধোঁয়া হয়, শব্দ হয় ভাপের। যেন শত সহস্র্র সাপ শিস দেয়।’ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসেও শীতের বর্ণনা পাই। ‘শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নারাত, তখনও কুয়াশা নামে নাই। বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়। সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। অবশ্য কথাটা বুঝতে তার একটু দেরি লেগেছে, কারণ তা ঝট্ করে বোঝা সহজ নয়। পায়ের ওপর এক ঝলক চাঁদের আলো। শুয়েও শুয়ে নাই। তারপর কোথায় তীব্রভাবে বাঁশি বাজতে শুরু করে। যুবতী নারীর হাত-পা নড়ে না।’ উপন্যাসের শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎ¯œা রাতে এভাবেই এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন লেখক। শীতের জ্যোৎ¯œা রাত তখন আর ধবল থাকে না, অস্বস্তিকর সময়ের মধ্যে এসে দাঁড়ায়। সৈয়দ শামসুল হক শীতকালকে পছন্দ করতেন। তার লেখা কবিতা, গল্পে, উপন্যাসে শীতের কথা রয়েছে। অনেক সময় শীতকালকে নিয়ে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন। এক সাক্ষাতকারে তাকে স্মৃতিচারণ করতে শুনি, ‘শীতের মাস। এই শীতের ভেতরে কুড়িগ্রামের কথা মনে পড়ে। ঘন কুয়াশা, কী শীত কী শীত! হিমালয় তো খুব কাছে। আর বরফ পড়ে না বটে কিন্তু ভোরবেলাতে ঘাসের ওপর শিশির জমে কাচের মতো প্রায় স্বচ্ছ হয়ে যায় এবং সেই শিশির বোধ হয় কাচের মতো নিরেট কাঠিন্য থাকে। হাঁটলে পায়ের নিচে মর্মর মর্মর করে সেই জমাট শিশির ভেঙ্গে যায়।’ শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, নির্মলেন্দু গুণ থেকে শুরু করে প্রায়ই সব কবির কবিতাতেই শীতের প্রসঙ্গ এসেছে। আমাদের ঔপন্যাসিক ও গল্পকাররা শীতকে নিয়ে এসেছেন নানা বর্ণনায়, নানা উপাদান ও উপকরণে। নাট্যসাহিত্যে ও মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোতে বারমাইস্যা বর্ণনায় শীতের সরব উপস্থিতি রয়েছে। প্রতিনিয়ত আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। ঋতু চক্রে ঘটছে পরিবর্তন। ফলে বাংলা ঋতুগুলোর বৈশিষ্ট্যেও এসেছে গতিশীলতা ও স্থবিরতাÑ উভয় ভাবই। পৌষ মাঘ শীতকাল হলেও ঋতুর পরিবর্তনে কার্তিকের শেষ দিকেই এখন শীত পড়তে শুরু করেছে। প্রচলন আছে ‘মাঘের শীতে বাঘও কাঁপে’। গত কয়েক বছর দেখা যায় মাঘ মাসের শেষ না হতেই শীতের শীতলতা কমতে শুরু থাকে। শুধু জলবায়ুর পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন এসেছে শীতকালীন সংস্কৃতিতেও। আগে শীত মানেই পিঠা-পুলি, বিশেষত ভাঁপা পিঠার উৎসব হতো। ঘরে ঘরে তৈরি হতো খেঁজুর রসের পায়েস। মোয়া-মুড়ির ছড়াছড়ি থাকত হাতে হাতে। এখন খেজুর গাছের সংখ্যা কমেছে, কমেছে খেজুর রসের পায়েস। আবার ভাঁপা পিঠার আবেদনও কমেছে। যন্ত্রের যুগে ধানসিদ্ধ ও রোদে ধান শুকানোর দিনও প্রায় বিগত হচ্ছে। ফলে শীতের পূর্বের রূপ ও ঐতিহ্যের মধ্যে বর্তমানে কিছুটা ফাঁরাক রয়েছে। তবে সে যাই হোকÑশীত এলে বাঙালীরা যে একে অপরের পাশে থেকে সর্ষে ফুলের হাসি, শিশিরবিন্দু, কুয়াশার চাদর, খেজুর রসের আমেজে মুগ্ধ হয় এবং আগামীতেও হবে এমন কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। সঙ্গে সঙ্গে প্রাত্যহিক চেতনা থেকে সাহিত্যিক ও শিল্পীদের শীতকালীন মুগ্ধতা, বিপন্নতা, নিঃসঙ্গতা ও প্রেমকাতরতা নিয়ে লিখনী অব্যাহত থাকবেÑ এমন প্রত্যাশা থাকল।
×