ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

ত্রিশালে একদিন...

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

ত্রিশালে একদিন...

ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। এরপর একজন খ্রীস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কস্টের মাঝেই তার বাল্যজীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা কাজী রফিজ উল্লাহর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে যে সব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই তাঁকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন বন্ধুরা এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কার কথা বলছি আমি বলছি আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কথা। অনেক দিন ধরে প্ল্যান করছি আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি ধন্য ত্রিশাল এ ঘুরে আসব কিন্তু বেটে বলে না হওয়ার ফলে যাওয়া হচ্ছিল না। আর আমার ছোট ভাই পিকু আসল নাম স্বপ্ন দীপ মজুমদার অনেকদিন ধরে বলছিল ওর এখানে যেতে, ময়মনসিংহে নটরডেম কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র পিকুও বলেছিল ত্রিশালের কবির স্মৃতি-বিজরিত স্মৃতি জাদুঘর শুক্র, শনিবার বন্ধ থাকে তাই অফিস থেকে একদিন এর ছুটি নিলাম ৭ আগস্ট। এদিকে মনে মনে সঙ্গী খুঁজছিলাম ছিলাম কাকে নেয়া যায় সঙ্গে কাউকেই পাচ্ছিলাম না হঠাৎ ৬ আগস্ট বিকেলে পিকু আমাকে ফোন দেয় ও ঢাকায় এসেছিল কাজে ওকে যেন নিয়ে ময়মনসিংহ কাল যাই আর আমার কাছে সাপেবরের মতোই কারণ একা একা ট্রেন জার্নি ভাল লাগে না। সকাল ৭টা ২০ বাজে আমি কমলাপুরে রেলস্টেশনে পৌঁছে পিকুর জন্য অপেক্ষা করছি গন্তব্য তিস্তা এক্সপ্রেস করে ময়মনসিংহ। ৭টা ২৫ বাজে পিকুর দেখা নেই মোবাইলে কল দিচ্ছি বার বার কিন্তু কল রিসিভ করছে না। আমি মনে মনে ভাবছি আজ বোধহয় আমাকে একাই যেতে হবে। ময়মনসিংহে শেষ পর্যন্ত পিকুর দেখা মিলল ও দৌড় দিয়ে আসছে আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। আমাদের ধারণা ছিল আমাদের বাংলাদেশ রেলওয়ে সেই আগের মতো সময়ের থেকে আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা দেরি করে ছাড়ে কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো আমাদের ট্রেন ঠিক ৭টা ৩০ মিনিটে আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাত্রা শুরু“করল। ট্রেন তার কু ঝিক ঝিক ছন্দে এগিয়ে চলছে এয়ার পোর্ট স্টেশন পেড়িয়ে এগিয়ে চলছে। অল্প কিছুক্ষণের পরে ঝিরি ঝিরি বৃস্টি শুরু হলো ট্রেনে বসে আমরা বৃস্টিকে উপভোগ করছি। গফরগাঁও স্টেশনে এসে আমাদের ট্রেন দ্বিতীয়বারের মতো থামল। এদিকে আমাদের পেটে রাম-রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়েছে অগত্যা গফরগাঁও স্টেশনে গরম গরম সিঙ্গারা খেলাম এতটাই গরম যে জিভ পোড়ার যোগার। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছলাম ময়মনসিংহ স্টেশনে আমাদের কে ট্রেন নামিয়ে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলল তার পরবর্তী গন্তব্য দেওয়ানগঞ্জের দিকে। আমরা ট্রেন থেকে নেমে রিক্সা ঠিক করলাম ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডে যাবার জন্য। আমাদের ব্যাটারিচালিত রিক্সা তুফানের গতিতে এগিয়ে চলছে আর আমি উপভোগ করছি ময়মনসিংহ শহরকে বেশ ঘিঞ্জি শহর অফিস খোলার দিন থাকায় রাস্তায় বেশ জ্যাম। গাঙ্গিনার পাড়, সি কে ঘোষ রোড, সেহড়া ঢাকা রোড দিয়ে এগিয়ে চলছি। ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে আমরা পদ্মা গেট লক সার্ভিসের বাসে উঠলাম প্রায় বিশ মিনিট পর বাস আমাদের বইলর নামক স্থানে নামিয়ে দিল। এরপর বাস থেকে নেমে আমরা ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় করে পৌঁছে গেলাম আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি ধন্য দারোগা বাড়িতে। গেট পেড়িয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করে দেখি নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে তালা ঝুলছে সঙ্গে সঙ্গে হাতের ঘড়ি দেখি তখন মাত্র বারোটা বাজে আর কোন বন্ধ বার না যে বন্ধ থাকবে মনটা খুব খারাপ লাগছিল অগত্যা আমরা আশপাশে ঘুরে দেখছিলাম। আর মনে মনে কোন লোক পাওয়া যায় কিনা দেখছিলাম শেষ পর্যন্ত পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখা মিলল এক মানবের। উনি বললেন এই স্মৃতি কেন্দ্রের কেয়ার টেকার দিনের বেশিরভাগ সময়ই তালা মেরে ঘুমিয়ে থাকেন বুঝি আল আমিন বলে ডাক দেন উনি আসবেন আমরা চিৎকার করে ডাকা শুরু করলাম কোন সারা শব্দ নেই আমরা ও নাছোড়বান্দা শেষ পর্যন্ত ওই ভদ্র লোক একজনের মোবাইল নাম্বার দিলেন বললেন উনার সঙ্গে কথা বলেনÑ ফোন দেয়ার পর মোবাইলের ওপর পাশের লোককে বললাম আমরা ঢাকা থেকে এসেছি উনিই বললেন, আপনারা কিছু সময় অপেক্ষা করেন আমি লোক পাঠাচ্ছি আমাদেরও দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভাল লাগছিল না পরে সামনের চা স্টলে গিয়ে চা খেলাম দেখা হলো ওই অঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তি রহিম সাহেবের সঙ্গে উনি বলছিলেন অনেক বছর পার হলেও ভবনটিতে প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকার কারণে ভবনের সার্বিক কাজে অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় আধা ঘণ্টার পর দেখা মিলল একজন আপা আসছেন তিনি-ই জিজ্ঞেস করলেন আপনারা কি ঢাকা থেকে এসেছেন আমরা হ্যাঁ বললাম উনি পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, ওনার নাম ইন্নি, তিনি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ডিপ্লোমাতে শেষ বর্ষের ছাত্রী, উনিই আমাদের পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখালেন। উনি বলছিলেন ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালীর স্বাধীন ঐত্যিহাসিক সত্তার রূপকার। ১৯২৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা এ্যালবার্ট হলে বাঙালী জাতির পক্ষ থেকে দেয়া জাতীয় সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত মানপত্রের জবাবে নজরুল বলেছিলেন, সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা আমার ধর্ম। যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি। নজরুলের এ ধরনের বলিষ্ঠ উচ্চারণ নিয়ে গবেষণার সহযোগী ক্ষেত্র এখন এই পাঠাগার। এখানে কবি নজরুল যে ঘরটিতে থাকতেন সেটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। কবি তার কবিতা গানে যে সকল গাছের নাম উল্লেখ করেছেন সেই গাছগুলো দিয়ে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ বাগান তৈরি করা হয়েছে। এখানে কবি যে পুকুরে গোসল করতেন সেটিও সংরক্ষণ করা আছে। বিলের পাড়ে একটি বট গাছের নিচে কবি নজরুল আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলতেন। এটি এখন নজরুল বটবৃক্ষ। দুই বাংলার নজরুল ভক্তদের কাছে এটি তীর্থ স্থানের মর্যাদা পেয়েছে। বটের নিচে প্রায়ই বসে কবিদের আসর। আজ কবি নেই কিন্তু এই বটগাছটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে কবির অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। এখানকার মনোরম পরিবেশ পর্যটকদের মোহিত করবে। নিচ তালায় মযয়মনসিংহ ত্রিশালে অবস্থানকালে যে খাটে ঘুমাতেন কবি সে খাটটি রয়েছে সঙ্গে রয়েছে মিলনায়তন, দ্বিতীয় তলায় উঠে আমরা দেখা পেলাম কবির বিভিন্ন ধরনের ছবি যা যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। সঙ্গে লাইব্রেরি দেখা পেলাম প্রায় কয়েক হাজার বই আছে এই লাইব্রেরিতে এখানে যতœসহকারে রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের সহস্তে লিখিত বই, নজরুল জীবন নিয়ে লেখা বই, নজরুলকে নিয়ে সমালোচনা করাসহ বিভিন্ন গানের রেকর্ড। কবি ওপর বই ছাড়া ও সমসাময়িক লেখকদের বইও আছে এখানে। এরপর আমরা গেলাম ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডের পাশেই নজরুল একাডেমি। কবির স্মৃতিবিজড়িত দরিরামপুর হাই স্কুলই বর্তমানে নজরুল একাডেমি। এই স্কুলে কবি ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করেছেন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার খাতায় নজরুল লিখেছিলেন আমি এক পাড়া গাঁয়ে স্কুল-পালানো ছেলে, তার উপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও ‘ক’ অক্ষর খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই আজও জল তেষ্টা পেয়ে যায়। কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতে কবির সেই ক্লাসরুম ও দেয়ালে এই কবিতার লাইন খোদাই করে সংরক্ষণ করা আছে। স্কুল মাঠের পাশেই রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নজরুল মঞ্চ ও শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত আধুনিক রেস্ট হাউস। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায়ের সময় চলে এলো আমরা আবার ৫টা ২০ মিনিটের তিস্তা এক্সপ্রেসে ফিরে গেলাম সেই চিরচেনা শহর পানে। কীভাবে আসবেন : ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোর ৫টা থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর ময়মনসিংহের উদ্দেশে সৌখিন, এনা, নিরাপদ বাস ছেড়ে আসে। টিকেটের মূল্য ২২০ টাকা। সময় লাগবে ২ ঘণ্টা অথবা সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের তিস্তা এক্সপ্রেস করে ময়মনসিংহে ঘুরে আবার ৫টা ২০ মিনিটের ট্রেনে ফিরে যেতে পারেন ঢাকাতে। ট্রেনের ভাড়া ১২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। ংঁসধহঃধংৎঁঃর@ুধযড়ড়.পড়স
×