ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফারজানা সুমনা

মনোমুগ্ধকর ডিস্ট্রিক্ট লেকভিউ

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

মনোমুগ্ধকর ডিস্ট্রিক্ট লেকভিউ

ইয়ান, তিয়ান, তেথেরা, মেথেরা, পিম্প; সেথেরা, লেথেরা, হোভেরা, ডোভেরা, ডিক। সুর করে এই ছড়া পড়তে গিয়ে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে তো? ঘুম পাওয়ারই কথা। রাতে ঘুম না আসলে কল্পনায় ভেড়া গুনতেই তো বলে, তাই না? এতক্ষণ আমরা ছড়ায় ছড়ায় ইংরেজীতে ভেড়া গুনলাম। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? কোথায় ইয়ান, তিয়ান, তেথেরা আর কোথায় আমাদের সবার জানা ইংরেজী কাউন্টিং ওয়ান টু থ্রি? শিল্প বিপ্লবের আগে ব্রেথনিক কেলটিক ল্যাঙ্গুয়েজেজ (যেমন কামব্রিক) থেকে আসা এমনই গণনা রীতি প্রচলিত ছিল উত্তর ইংল্যান্ডসহ ব্রিটিশ আইল বা আইল্যান্ডগুলোতে। মূলত পাহাড়ে চরানো নিজেদের ভেড়া গুনতে এই ছড়া ব্যবহার করত উত্তর ইংল্যা-ের মেষ পালকরা। এই গণনা পদ্ধতিতে এক থেকে মাত্র বিশ পর্যন্ত গোনা যেত। তাই মেষ পালকরা হাতে অনেকগুলো ছোট পাথর নিয়ে গুনতে বসত। প্রথমবার বিশ পর্যন্ত গুনে একটা ছোট পাথর পকেটে পুরত। শুরু হতো পরের বিশ গোনা, আবারও একটা পাথরের টুকরো পকেটে চালান করে দিত পরের বিশ গোনা শেষে। সেই ইয়ান, তিয়ান, তেথেরার দেশ লেইকল্যান্ড বা লেইক ডিস্ট্রিক্ট থেকে ঘুরে আসলাম কিছুদিন আগে। উত্তর পশ্চিম ইংল্যাণ্ডের কামব্রিয়াতে অবস্থিত এই লেক ডিস্ট্রিক্ট যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় ন্যাশনাল পার্ক যা ৮৮০ বর্গমাইলজুড়ে অবস্থিত। লেক ডিস্ট্রিক্ট ন্যাশনাল পার্ক কতটা বড় তা সহজেই বোঝা যাবে যদি বলি ইংরেজদের রাজধানী লন্ডনের আয়তন মাত্র ৬১১ বর্গমাইল। লেক ডিস্ট্রিক্টের সর্বোচ্চ পর্বত স্কাফেল পাইক যার উচ্চতা ৩২০৯ ফুট। এটা ইংল্যান্ডেরও সর্বোচ্চ পর্বত চূড়া। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, ইংরেজী সাহিত্য আর সাহিত্যিকদের জন্য ও লেক ডিস্ট্রিক্ট বেশ বিখ্যাত। লেক ডিস্ট্রিক্ট ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডওয়ার্থের বাড়ি, তাঁর কবিতার প্রেরণা। গ্রেসমেয়ারের কাছে কবি সস্ত্রীক চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। যাত্রার দিনে সকাল বেলা যার যার বাড়ি থেকে একটা নির্দিষ্ট আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনস্টেশনে একত্রিত হলাম। আমরা সাড়ে নয়জন, মানে নয়জন পূর্ণাঙ্গ নারী-পুরুষের সঙ্গে তিন বছরের শিশু আফসীন। ল-নের ইউস্টন ট্রেনস্টেশন থেকে ভার্জিন কোম্পানির ট্রেনে যাত্রা শুরু হলো সকাল ছয়টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে। প্রায় তিন ঘণ্টার যাত্রা শেষে যখন উইনডেরমেয়ার পৌঁছালাম সদলবলে তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ইংল্যান্ডের সর্ব দীর্ঘ জলাধার এই উইনডেরমেয়ার। সেখান থেকে এক ঘণ্টার বাস যাত্রা কেজউইক, লেক ডিস্ট্রিক্টে ওটাই ছিল আমাদের আবাসস্থল। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে মিনিট দশেক ওপরে উঠলে দেখা মিলল চমৎকার পাথুরে হলিডে কটেজটার। আগেভাগেই বুকিং দেয়া ছিল আমাদের। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের হলিডে কটেজ আছে। যারা বেশ কিছু দিনের জন্য কোন হলিডে ডেসটিনেশনে থাকতে চান এবং হোটেলে বাক্সবন্দী হয়ে না থেকে বাড়ির আমেজে ছুটি কাটাতে চান তাদের জন্য এই হলিডে কটেজ। কেজউইকে আমাদের ছুটি কাটানোর পুরো বাড়িটা পাঁচটা শোবারঘর, রান্না-খাওয়া আর বসারঘর নিয়ে। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু জিড়িয়ে নিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম কাছের পাহাড় দেখতে। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে চলা রাস্তা ধরে পাহাড়ে উঠতে উঠতেই সূর্য ডুবল সেদিন। বাড়ি ফিরে ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে হই-হুল্লোড় করে রাতের খাবার তৈরি করলাম। দফায় দফায় চলল গল্প। পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নাকেমুখে কিছু খেয়েই বেরোলাম লেক ডিস্ট্রিক্টের আসল আকর্ষণ লেক ক্রজিংয়ে। সেদিন ভাগ্য আমাদের সহায় হলো, সূর্য ঝলমল করে হেসে উঠল। দূরে বরফ আচ্ছাদিত পর্বতকে রেখে ইঞ্জিনচালিত নৌকা আমাদের ভাসিয়ে নিল স্বচ্ছ কাকচক্ষু জলে। লেক ডিস্ট্রিক্ট ন্যাশনাল পার্ক অনেক বড় জায়গা ঘিরে তাই নৌকা থামার অনেকগুলো ঘাট। যে যেখান থেকে খুশি নৌকায় উঠছে-নামছে। তবে এই নৌবিহার মূলত বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য। স্থানীয়রা বাসে করেই যাতায়াত করে। ঘাটে-ঘাটে তরী ভেড়ে আর আমরা নেমে পড়ি সেখানে। আশপাশে ঘুরে ফিরে নির্দিষ্ট সময়ের আগে আবারও ঘাটে এসে অপেক্ষা করি পরের নৌকার জন্য। চমকপ্রদ বিষয় হলো, আমাদের ইঞ্জিন-নৌকার সাহায্যকারী ছিল এক মেয়ে, কোন এক ঘাটের কাছে আসলেই সে নৌকা থেকে নেমে শক্ত দড়ি দিয়ে নৌকা ঘাটে বাঁধছে, যাত্রীদের টিকেট যাচাই করছে, ওঠা-নামায় সাহায্য করছে নিপুণ হাতে। লেক ভ্রমণ শেষে সেদিন বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যায়। রাতের খাওয়া শেষে লুডু খেলায় মেতে উঠল আমাদের কয়েকজন। গুটি চুরি করা, এর গুটি ও খেয়ে ফেলা- সবমিলে এক দারুণ উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হলো সে রাতে। পরদিন খুব সকালে দলের ছয়জন সদস্য সেথওয়েথ চলে গেলাম পর্বতারোহণে। সেথওয়েথ ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল স্থান, প্রায় ১৪০ ইঞ্চি বৃষ্টি হয় বছরে। ১৯ শতকের শেষভাগে লেক ডিস্ট্রিক্টে পর্বতারোহণ যখন জনপ্রিয় হতে থাকে, তখন থেকে এই ইংরেজ হ্যামলেট বা ছোট্ট গ্রাম আশপাশের পর্বতারোহণের শুরুর স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পর্বতের শিখর থেকে গড়িয়ে পাথরের গায়ে ছুটে চলা হিমশীতল ঝর্ণার পাশ দিয়ে ওপরের পথ বেয়ে চললাম আমরা। প্রায় দুই ঘণ্টার পর্বতারোহণের পর যখন চূড়ায় পৌঁছলাম তখনও পাশের পর্বতগুলোর শিখর বরফাবৃত, ঝর্ণার উৎপত্তিস্থলে পাথর আর পানির হুটোপুটির তুমুল গর্জন। কিছুক্ষণ বসে থেকে আর ছবি তুলে শুরু হলো পাহাড় বেয়ে নামার পালা। নামতে নামতেই দেখা হলো আরও অনেক শৌখিন পর্বতারোহীর সঙ্গে। একে অন্যের সঙ্গে কুশল বিনিময় করা শেষে সবারই প্রশ্ন পর্বত চূড়ায় সাদা বরফের চাদর এখনও আছে কি-না। ঘেমে নেয়ে পরিশ্রান্ত আমরা যখন বাড়ি পৌঁছলাম সূর্য তখন মধ্য আকাশে। সেদিন সন্ধ্যায় ফিরতে হবে লন্ডন। খাবার দোকানের পাশেই এক স্যুভেনীয়র শপ, সবার জন্য টুকিটাকি উপহারফিরতি। ট্রেন ধরার আগে সবাই মিলে শেষবারের মতো একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে আবারও চললাম লেকের ধারের এক ফিস এ্যান্ড চিপস কিনতেই বন্ধুকে নিয়ে সেই দোকানে ঢু মারলাম। শামুক, ঝিনুক, পাথর, বাঁশ-কাঠ, শ্লেটে তৈরি সেসব উপহার দেখতে কী ভীষণ সুন্দর! দামও ছিল হাতের নাগালে। উপহারের দোকানে পরিচয় হলো দোকানদার-যুগলের সঙ্গে। বেশ হাসিখুশি আর অতিথিপরায়ণ মাঝ বয়েসী দম্পতি নিজেরাই দোকান চালায়। কথায় কথায় সময় চলে যায়, ওদিকে বাকিরা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কেনাকাটা শেষে সেই দম্পতিকে জিজ্ঞেস করলাম একটা ছবি নিতে পারব কি না তাদের সঙ্গে। সহাস্যে রাজি হয়ে গেল তারা, আমাদের জিজ্ঞেস করল কোথায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চাই আমরা। বন্ধু বলল, দোকানের যে স্থানটি তোমার সবচেয়ে পছন্দের সেখানে গিয়ে দাঁড়াও। একদমই সময় ক্ষেপণ না করে ভদ্রলোক তার পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীকে দেখিয়ে বলল, ‘শি ইজ মাই ফেবারিট প্লেস’ (সে-ই আমার প্রিয় স্থান)। সেই এক মুহূর্তে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেলাম। ওই এক কথাতেই সাধারণ দুজন মানুষ হয়ে গেলেন অসাধারণ, আমি আমার হৃদয় ফেলে আসলাম ওই অখ্যাত দোকানের ছোট্ট পরিসরে। আসলেই তো, বেলাশেষে ভালবাসার মানুষটিই হয়ে ওঠে মানুষের পরম নির্ভরতার আশ্রয়স্থল; সেই শরণ তিলে তিলে গড়ে ওঠে আশ্বাসে-আশায়, ভাষায়-ভালবাসায়। যে জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের মানুষের সঙ্গে তার হয় নাকো দেখা। ভধৎুধহধ.ংযঁসড়হধ@ুধযড়ড়.পড়.ঁশ
×