ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি

আমাদের এই সমাজে সৌন্দর্য বিচারে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় গায়ের রং। দীর্ঘ কালো চুল, নির্মল হৃদয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সুন্দর কণ্ঠ এসব কিছুর উর্ধে থাকে একটাই প্রশ্ন, ‘মেয়ের গায়ের রং ফর্সা তো? আমাদের সমাজে এমন অনেক মেয়ে দেখা যাবে তার বহু গুণ থাকা সত্ত্বেও শুধু গায়ের রং কালো হওয়ায় বিয়েতে সমস্যা হচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন প্রাইভেট চাররিগুলোতেও যেমন ফ্রন্ট ডেস্ক কিংবা রিসেপশনে, নাটকে, সিনেমায়, অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়, সংবাদ পাঠের মতো জায়গায় ফর্সা মেয়েদের প্রাধান্য। রং ফর্সা নয়, অথচ খুব যোগ্য। এমন কেউ কেউ কালেভদ্রে সুযোগ পেয়েছেন বৈকি। তাদের বাবা-মায়েরাও এ নিয়ে চিন্তিত। এটা দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এ যুগেও আমাদের কাছে সৌন্দর্য বিচারের মাপকাঠি হচ্ছে গায়ের রং। আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি কালো মেয়ে। প্রথমত, তিনি পুঁজিবাদী সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার, পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার এবং শেষ পর্যন্ত বর্ণবৈষম্যের শিকার। নারীর বেলায় ফর্সা রংই যোগ্যতা। কিন্তু পুরুষের যোগ্যতা তার গায়ের রং বা চেহারায় নয়। দেশ যতই প্রগতিশীল হোক না কেন, ফর্সা-কালোর ভেদাভেদ গুপ্তরোগের মতোই থেকে গিয়েছে দেশবাসীর মননে। আর সে বিভেদের সব থেকে বেশি শিকার হয়েছেন নারীরা। তাই তো প্রায়ই শোনা যায়Ñ ‘ইশ, আপনার গায়ের রংটা যদি আরেকটু ফর্সা হতো,’ ‘আহ, একটু সুন্দর চেহারা থাকলে না জানি কি করত’, ‘আপনি সুন্দর, কিন্তু গায়ের রংটা আরেকটু উজ্জ্বল হলে মানাত বেশি’। এমনকি কালো মেয়ে হয়েছে শুনলে পাড়া-পড়শির মাথা ধরে যায়, এই কালো মেয়ের বিয়ে দেবে কোথায়? কিংবা বিয়ে দিতে হলে যে মোটা অঙ্কের টাকা লাগবে তা দেয়ার সামর্থ্য বাবা-মায়ের আছে কিনা ইত্যাদি। সাধারণ অর্থে বাংলাদেশে বর্ণবাদ নেই। গায়ের রং দিয়ে সমাজে বিভেদরেখা টানার সুযোগ নেই, সেই বর্ণবাদ থাকবে কী করে! তবু ‘বর্ণবাদ’ আছে। আছে পরিবারে, সমাজে। সেই বর্ণবাদের শিকার ‘কালো মেয়ে’। এমনকি সাহিত্যেও কালো মেয়ের প্রশস্তির আদর্শ উদাহরণ খুঁজতে গেলেই সবার আগে উঠে আসে রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’। ‘কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলুুক অন্য লোক।’ কিংবা মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামাসঙ্গীত, আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়, দেখে যা আলোর নাচন।’ শামসুর রাহমানের ‘কালো মেয়ের জন্য পঙ্ক্তিমালা’-র পর যে মেয়েদের গায়ের রং ফর্সা নয়, তারা বাংলা কবিতায় খুব একটা এসেছেন কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কারেরী গায়েন তাঁর এক গবেষণায় কালো মেয়েদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরেন। সেখানে তিনি দেশের চারটি প্রধান দৈনিকে প্রকাশিত ৪৪৬টি পাত্র চাই, পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে পরিষ্কার দেখেছেন, সমাজে কালো মেয়েরা ভয়ানক অবজ্ঞার শিকার। বিয়ের জন্য ফর্সা মেয়েই পরম আকাক্সিক্ষত। বিষয়টির আরও গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে তিনি দেখেন যে ফর্সা না হওয়ায় শহরে- গ্রামে অসংখ্য নারী গঞ্জনা, নির্যাতন সয়ে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচে কিংবা আত্মঘাতী হয়। এই সমস্যা যে শুধু আমাদের দেশে তাই নয় পৃথিবীজুড়েই। এই সুযোগ পুঁজিবাদ দুনিয়াও হাতছাড়া করেনি। পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে পণ্য বানাতে বানাতে কালো মানুষের রংকে ফ্রাস্টেইশন বানিয়ে একের পর এক রং ফর্সাকারী ক্রিমের বাণিজ্যিকীকরণ ঘটিয়ে যুগ যুগ ধরে রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে। আর মেয়েরাও মানুষের চোখে নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য এসব প্রসাধনীর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। যেন ফর্সা বা সুন্দর না হতে পারাটা জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। তবে ব্যতিক্রমও আছে যেমন আমেরিকান প্রখ্যাত গায়িকা-নায়িকা বিয়ন্স প্রসাধনহীন হয়ে বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করে মিডিয়াতে ঝড় তোলেন। তিনি নারীদের প্রসাধনহীন হয়ে বিয়ে করতে অনুপ্রেরণা দেন। আসলে মানুষের মনের রূপই আসল রূপ বাইরেরটা নয়। গায়ের রং কখনোই মাপকাঠি হতে পারে না। তাই তো গায়ের রংকে তোয়াক্কা না করে সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছেছেন অনেক নারী। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেনÑ অপরাহ ইউনফ্রে, ভেনাস উইলিয়ামস, সেরেনা উইলিয়ামস, বিপাশা বসু, বেবী নাজনীন, বিবি রাসেল ও তারামন বিবিসহ আরও অনেকে। তারপরেও কালো বা শ্যামবর্ণের মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সেই তিমিরেই।
×