ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আয়তি নাহার

বিপ্লবী চেতনায় নির্ভীক এক নারী

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

বিপ্লবী চেতনায় নির্ভীক এক নারী

নাচোলের কৃষক আন্দোলনের নারী সৈনিক ইলা সেনের জন্ম ১৯২৫ সালে কলকাতায়। পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের বাগুচিয়া গ্রামে হলেও বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বাংলার একাউন্ট্যান্ট জেনারেল ছিলেন। কর্মসূত্রে তাকে সব সময়ই থাকতে হয়েছে কলকাতায়। ফলে ইলা সেনের শৈশব, কৈশোর অতিক্রান্ত হয় কলকাতায়। সেই সূত্রে শিক্ষা জীবনও। বেথুন স্কুল ও কলেজছাত্রী ইলা সেন তার শিক্ষা জীবনের বিএ পাঠ সমাপ্ত করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। পড়াশোনার সঙ্গে খেলাধুলায়ও তার অসামান্য কৃতিত্বের ছাপ পড়ে। সাঁতার বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায় পারদর্শী ইলা সেন ছিলেন তৎকালীন (১৯৩৫-৩৮) রাজ্য জুনিয়র এ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়ন। অবিভক্ত বাংলায় তিনি প্রথম বাঙালী নারী যিনি ১৯৪০ সালে অলিম্পিক খেলায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মত্ততায় সেই অলিম্পিক বাতিল ঘোষণা করা হয়। সম-সাময়িককালে কৃতী খেলোয়াড় হিসেবে ইলা সেন বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। ইতোমধ্যে তিনি সারা বাংলা তথা ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে যান। সদস্য লাভ থেকে শুরু করে দলের নানান সংগ্রামী কর্মসূচীর সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নেন। আমরা জানি তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অবিভক্ত ভারত উত্তাল। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিপ্লবের জোয়ার। সময়ই ইলা মিত্রকে সাহসী পথিক হিসেবে দুর্জয় অভিযাত্রায় সামিল করে নেয়। ১৯৪৫ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ইলা মিত্রের বিয়ে হয় রামচন্দ্রপুর হাটের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার তনয় রমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে। বিয়ের পর ইলা সেন হয়ে যান ইলা মিত্র। রমেন্দ্রমিত্রও ছিলেন রাজনৈতিক চেতনায় একজন সিদ্ধ পুরুষ। পারিবারিক সম্পত্তি আর ঐতিহ্যিক পরিম-লকে পেছনে ফেলে তিনি তার এলাকার কৃষকদের দাবি দাওয়ার সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করলেন। ফলে সুশিক্ষিতা, কৃতী খেলোয়ার, রাজনৈতিক কর্মী ইলা মিত্রের সঙ্গে তার জীবনগাথাটা ছিল এক অবিশ্বাস্য দুর্লভ ব্যাপার। আধুনিক কলকাতা শহর এবং নাচোলের অজপাড়াগাঁ সম্পূর্ণ আলাদা দুই সামাজিক আবহ। মুক্ত কলকাতার জীবন আর জমিদার পরিবারের বধূমাতা ইলা মিত্রের ঘরের চৌকাঠে আটকে পড়া জীবন কোনভাবেই এক ছিল না, যা তার স্মৃতি কথায় স্পষ্ট হয়। ‘রাজশাহী জেলার অধীন একটি অজ অখ্যাত পাড়াগাঁয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি। যদিও কলেজে পড়া, বিএ পাস করা এবং খেলাধুলায় লাফঝাঁপে ও তুখর বলে আমি পরিচিতা ছিলাম, তবু বিয়ের পর আমার করুণ বন্দীদশা কাউকে বোঝানো যাবে না, সাত মহল্লা জমিদার বাড়িতে আমার অতীত জীবন কবরে চাপা পড়ে গেল।’ সেখান থেকে নতুন জীবনের সন্ধান পেতে তাঁকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। বাড়ির কাছে মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এক বিদ্যালয়ে জমিদার ঘরের বধূমাতাকে শিক্ষয়িত্রীর দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন গ্রামেরই সাধারণ হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠী। সেই জমিদার বাড়ির আঙ্গিনা থেকে বৃহত্তর সমাজ অঙ্গনে ভীরু ভীরু পায়ে এগিয়ে চলা। তারপরে আর পেছনদিকে তাকানে হয়নি। স্কুলছাত্রী তৈরি করার পাশাপাশি দায়িত্ব নিলেন অগণিত কৃষক প্রজাদের সংগ্রামী আন্দোলনের নেত্রীরূপেও। ঘর থেকে বাইরে পা দিয়েই প্রত্যক্ষ করলেন ভূমিহীন, হতদরিদ্র কৃষককুলের দৈন্যদশা, প্রতিদিনের জীবনের হরেক রকমের সঙ্কট। স্বামী রমেন্দ্র মিত্রও কৃষক আন্দোলনের একজন সহযোদ্ধা। ফলে পারিবারিক কোন সঙ্কীর্ণতা ইলা মিত্রের পথরোধ করতে পারেনি। ১৯৪৬ থেকে ৫০ সাল পর্যন্ত কৃষক সংগঠিত তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ইলা মিত্র। ১৯৪৮ সালে জন্ম হয় পুত্র রণেন মিত্রের। সদ্যজাত শিশুপুত্রকে শাশুড়ির জিম্মায় রেখে পুনরায় ইলা মিত্র মিলিত হন অসহায়, বঞ্চিত, কৃষক প্রজাদের সঙ্গে ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তিত হলো, ব্রিটিশ রাজশক্তির হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলো পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর হাতে। কিন্তু হতদরিদ্র প্রজ্ঞা কিংবা বাংলার ভূমি ব্যবস্থার সামান্য রদবদলও হলো না। তার ওপর নতুন উপসর্গ এসে থাবা বসাল সাম্প্রদায়িক সঙ্কট। দেশ বিভাগের পর রমেন্দ্র মিত্রের মা রাজশাহীর নাচোল অঞ্চল ছেড়ে অনত্র যেতে কখনই রাজি হননি। যে হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এতদিন নিজের মতো করে বাস করে এসেছেন সেই মানুষগুলোকে ফেলে যেতে ইচ্ছে করেনি ইলা মিত্রের শাশুড়ি মায়ের। কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ইলা মিত্র ভূমিহীন, বাস্তুহারা সাধারণ চাষাভূষাদের পাশাপাশি নিজেকে সামিল করলেন। সন্তান, পরিবার কোনকিছুরই মায়া তাকে কর্তব্য থেকে কখনও চ্যুত করতে পারেনি। নাচোলের সাঁওতাল উপজাতিদের নিয়ে ইলা মিত্রের কৃষক আন্দোলনের যে তেভাগা সংগ্রাম কারাবন্দী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি তার সহযোদ্ধাদের ফেলে কোথাও যাননি। অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কলকাতায় গিয়ে নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতেও চাননি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে যখন রাজি হলেন কলকাতায় যেতে তখনই পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে বন্দী হন। জেলহাজতে ইলা মিত্রের উপর পুলিশি নির্যাতন স্মরণকালের লোমহর্ষক ঘটনা। এই নির্মম অত্যাচারেও তার মুখ দিয়ে সতীর্থদের সম্পর্কে কোন কথা বের করা সম্ভব হয়নি। সেই অত্যাচার, অবিচারের নিষ্ঠুর ঘটনা পরম্পরা ইলা মিত্রের জবানবন্দিতেই মূর্ত হয়ে আছে। অত্যাচারে, নিপীড়নে, পাশবিক নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত ইলা মিত্রকে এক জেল থেকে অন্য জেলে, এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে টানা হেঁচড়ার যে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হয় তা আজও ইতিহাসের এক মর্মস্পর্শী, বেদনাবিধুর কাহিনী। এই অবাঞ্ছিত ঘটনার রেশ চলতে থাকে ১৯৫৪ সালে মুক্তফ্রন্টের ক্ষমতা আসা পর্যন্ত। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নির্দেশে ইলা মিত্রকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। তার সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগলেও এক সময়ে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। শুরু হয় জীবনের নতুন আরেক অধ্যায়। শিক্ষকতা, সাহিত্যচর্চাসহ অনুবাদ সাহিত্যে ও নিজের অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। বিয়ের পরও যে ঘর, সংসার, স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখে বাস করা সম্ভব হয়নি, সংগ্রামী অভিযাত্রার সব সময়ই নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন সেই পারিবারক আবহ একদিন অমৃতের মতো তাঁর সর্বাঙ্গে পরশ বুলিয়ে দিল। স্বামী, পুত্র, পুত্রবধূ, পৌত্রকে নিয়ে তিনি আমৃত্যু সুখে শান্তিতে থাকতে পেরেছিলেন। তিনি আমাদের বাংলাদেশকে কখনও ভুলে যাননি। আমাদের মুক্তি সংগ্রামে আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। ’৭১-এর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে তিনি আমাদের মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের জন্য সাধ্যমতো যা করার সবই করেছেন। শুধু তাই নয় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতও করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু ইলা মিত্রকে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দিতে চেয়েছিলেন। ’৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- ইলা মিত্রকে বিমর্ষ এবং হতবাক করে দেয়। তিনি ভাবতে পারেননি স্বাধীন দেশের স্থপতিকে এভাবে তাঁর সমগোত্রীয়রা খুন করতে পারে। ২০০২ সালে এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান হয়।
×