ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ শীর্ষ ৫ নেতা অস্ত্র গোলাবারুদসহ গ্রেফতার

অভিযানের পরও থামছে না নব্য জেএমবির কার্যক্রম

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

অভিযানের পরও থামছে না নব্য জেএমবির কার্যক্রম

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ নব্য জেএমবির শীর্ষপর্যায়ের পাঁচ নেতা অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গ্রেফতার হয়েছে। একের পর এক অভিযানে জঙ্গীরা গ্রেফতার হলেও থেমে নেই নব্য জেএমবির কার্যক্রম। এর অন্যতম কারণ অর্থায়ন। নব্য জেএমবিকে আর্থিক সহায়তা করছে স্বাধীনতাবিরোধী একটি বিশেষ ইসলামী দল। ইতোমধ্যেই দলটির অন্তত পনেরোজনের সংগঠনটিকে ২৮ লাখ টাকা সহায়তা করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারে র‌্যাবের অভিযান চলছে। আর্থিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় জঙ্গী সংগঠনটি তাদের গোপন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নব্য জেএমবি নতুন করে সারা দুনিয়ায় আলোচনায় আসতে কুষ্টিয়া জেলার একটি থানার অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট করার চক্রান্ত করেছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ব্যাপক প্রভাব থাকার বিষয়টি প্রমাণ করতেই এমন ষড়যন্ত্র করে নব্য জেএমবি। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরেই থানাটির ওপর নজর রাখছিল নব্য জেএমবি জঙ্গীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে সে উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। গত ১৬ নবেম্বর র‌্যাব-২-এর একটি দল রাতে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে মাওলানা আব্দুল হাকিম ফরিদী ওরফে সুফিয়ান (৪০), পিতা- মৃত আব্দুস সাত্তার, গ্রাম-হোসেনপুর মোল্লাবাড়ি, পোস্ট- হুসাইনপুর, থানা- বাজিতপুর, জেলা- কিশোরগঞ্জ; রাজীবুল ইসলাম ওরফে রাজীব ওরফে আহমেদ (২৯), পিতা- মোঃ শফিউদ্দিন, গ্রাম- রামনগর, পোস্ট- রাউতরা, মাগুরা সদরকে গ্রেফতার করে। তাদের তথ্যমতে বৃহস্পতিবার রাজধানীর আদাবর থানার মোহাম্মদিয়া ক্যাফে থেকে গাজী কামরুস সালাম সোহান ওরফে আবু আব্দুল্লাহ (২৭), পিতা- মৃত গাজী আব্দুস সালাম, গ্রাম-আড়পাড়া, পোস্ট- ভেড়া বাজার, থানা- ভেড়া বাজার, জেলা-গোপালগঞ্জ, (রাজধানীর ২৪নং হাজী রশিদ লেন, বংশাল থানার বাসিন্দা); মোঃ সোহেল রানা ওরফে খাদেম ওরফে মোয়াজ্জিন ওরফে সোহেল ওরফে শহীদুল্লাহ (২৩), পিতা- নুরু ইসলাম ওরফে নব কাজী, গ্রাম- বড় কামার কুন্দু, পোস্ট- কালীচরণপুর, থানা- কালীচরণপুর, জেলা-ঝিনাইদহ ও শেখ মোঃ আবু সালেহ ওরফে লিটন ওরফে হুরাইয়া (৪২), পিতা- মৃত আব্দুস সোবাহান শেখ, গ্রাম- তৃলোনা, পোস্ট- ঘুপটি, থানা-ফরিদগঞ্জ, জেলা- চাঁদপুরকে (৪০ নম্বর দক্ষিণ বাড্ডা, ঢাকা) গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে একটি নাইন এমএম পিস্তল, দুটি ম্যাগজিন, ২০ রাউন্ড তাজা বুলেট, ১০টি বোমা, পাঁচটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমা তৈরির ডেটোনেটর, বোমা তৈরির কাঁচামাল এক কেজি সাদা পাউডার, ২শ’ গ্রাম বারুদ, সার্কিট বোর্ডসহ বিস্ফোরক তৈরির নানা সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারের বিএসইসি ভবনে র‌্যাবের নতুন মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীটির লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান এসব তথ্য জানান। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, গ্রেফতারকৃতরা গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী ও নব্য জেএমবির আমির র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত সারোয়ারের ঘনিষ্ঠ। তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। আর গত ৮ অক্টোবর গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার বাইপাইলের আশুলিয়ায় পৃথক তিনটি জঙ্গী আস্তানায় র‌্যাব অভিযান চালায়। অভিযানে চার জঙ্গী নিহত হয়। আহতাবস্থায় আব্দুর রহমান নামে এক জঙ্গী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। পরবর্তীতে তদন্তে জানা যায়, আব্দুর রহমানের প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান ওরফে শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। সারোয়ার নব্য জেএমবির আমির নিযুক্ত হয়েছিল। র‌্যাবের এ কর্মকর্তা আরও জানান, নব্য জেএমবি কুষ্টিয়া জেলার একটি থানাকে টার্গেট করেছিল। তারা থানাটি আক্রমণ করে অস্ত্র-গোলাবারুদ লুটের পরিকল্পনা করেছিল। এজন্য তারা দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছিল। নব্য জেএমবির গোয়েন্দা শাখা থানাটিতে কী পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ আছে, কে কখন কোথায় দায়িত্বে থাকে এসব ছাড়াও যাবতীয় খবর রাখছিল। থানা লুটের অপারেশনের সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সারোয়ার-তামিমের ঘনিষ্ঠ সোহেল রানাকে। সোহেল রানা ঝিনাইদহের একটি মসজিদের মোয়াজ্জিন। সে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে কখনও খাদেম, মোয়াজ্জিন, সোহেল ও শহীদুল্লাহ নামে পরিচয় দিত। তার বাসস্থান ও কর্মস্থল ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের নিরাপদ আস্তানা। তার তত্ত্বাবধানেই বিভিন্ন সময় তার কর্মস্থল ও বাসায় জঙ্গীদের গোপন বৈঠক হতো। তার বাসায় বসেই কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র ছাড়াও গ্রেফতারকৃত রাজীব বৈঠক করে। ওই বৈঠকে কুষ্টিয়ার একটি থানা লুটের পরিকল্পনা হয়। তা বাস্তবায়নের দায়িত্বও ছিল সোহেলের ওপর। সোহেল ২০১৩ সালে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে ২০১৫ সালে সারোয়ার-তামিম গ্রুপে যোগ দেয়। গ্রেফতারকৃত আবু আব্দুল্লাহ একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তার জন্ম যশোরে। সে ২০০৭ সালে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। ২০০৮-১১ শিক্ষাবর্ষে গাজীপুরের ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগ থেকে বিএসসি সম্পন্ন করে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তার কলেজ বন্ধু সিফাতের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। সিফাতের সঙ্গে সে ধানম-ির হাতিমবাগ মসজিদে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীর কাছে যাতায়াত শুরু করে। এরপর থেকেই সে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। আর সিফাত আত্-তামকিন জঙ্গী সাইটের এ্যাডমিন। তার প্রকৃত নাম মোস্তাফিজুর রহমান সিফাত। সিফাত গত ৯ আগস্ট র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। সিফাতের মাধ্যমে সোহানের পরিচয় সারোয়ার জাহানের সঙ্গে। এরপর সোহান চট্টগ্রামে ক্ষুদ্রাস্ত্র ও বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ নেয়। তবে তার মূল কাজ ছিল বিভিন্ন হামলা ও নাশকতার জন্য কারিগরি সহায়তা প্রদান করা। র‌্যাব কর্মকর্তা আরও জানান, যারা জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত সোহান। সোহান নিজেও অর্থ দিত। সে প্রকৌশলী হিসেবে এনার্জিপ্যাক ও সর্বশেষ ডেসকোতে কর্মরত ছিল। সোহানের যোগাযোগের প্রেক্ষিতেই নব্য জেএমবিকে ২৮ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যারা এসব অর্থ দিয়েছে তারা দেশ ও স্বাধীনতাবিরোধী। অর্থদাতাদের মধ্যে শামীম, সাইদ, রেজওয়ান, আমিন বেগ, সাইফ, শেলী, জাকির, সাইফুল্লাহর আত্মীয়সহ আরও কিছু ব্যক্তি রয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থদাতাদের সংখ্যা অন্তত পনেরোজন ছাড়িয়ে যাবে। তিনি আরও জানান, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মাওলানা আব্দুল হাকিম ফরিদী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা। তিনি সেখানেই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৯৭ সালে খিলগাঁওয়ের মাখাবাপুর উলুম মাদ্রাসায় দাওরা হাদিস (মাস্টার্স সমমান) সম্পন্ন করেন। তিনি ভাল বক্তা ও প্রশিক্ষক। তিনিও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কারাবন্দী নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীর মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েন। তিনি রাহমানীর সঙ্গে বহু ওয়াজ মাহফিল করেছেন। পরবর্তীতে তিনি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেন। রাহমানী গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি এবিটির দায়িত্ব নেন। তার কাজই ছিল জঙ্গীদের মগজধোলাই ও আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া। তাদের সঙ্গে হাবিবুর রহমান শেখের পরিচয় হয়। হাবিবুর রহমান মূূলত অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী। সে নাশকতার কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র ও বুলেটের যোগানের ব্যবস্থা করত। গ্রেফতারকৃত হুরাইরা জেএমবির কারাতের প্রশিক্ষক। ২০০২ সাল থেকে মামুন নামে একজনের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট হয়। ২০০৩ সালে কলাবাগান কিউকুশান কারাতে ক্লাবে ভর্তি হয়। ২০০৯ সালে ব্লাক বেল্ট পায়। তার সঙ্গে নব্য জেএমবির অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ২০০৬ সালে মাওলানা হাকিম তাকে নব্য জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের কারাতে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। গ্রেফতারকৃত রাজীব নব্য জেএমবির স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালানার প্রশিক্ষক ছিল। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কারাবন্দী রাহমানীর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিল। সেও ২০১৫ সালে মাওলানা হাকিমের মাধ্যমে সারোয়ার-তামিম গ্রুপে যোগ দেয়। সে সিলেটে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। ঢাকা কলেজ থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেছে। সর্বশেষ ফাইভ স্টার সিমেন্ট কোম্পানির সেলস্ রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে কর্মরত ছিল। তিনি আরও জানান, গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার পর র‌্যাবের অভিযানে ৬ জঙ্গী নিহত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে ৩৩ জঙ্গী। সারাদেশে যুগপৎ নাশকতা চালানোর শক্তি না থাকলেও জঙ্গীদের তৎপরতা রয়েছে। তারা গোপনে তৎপরতা চালাচ্ছে। জঙ্গী দমনে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। জঙ্গীদের আত্মসমর্পণের ঘটনায় জঙ্গী সংগঠনগুলোতে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জঙ্গী তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলেছে বলে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। নব্য জেএমবির পলাতক সদস্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে এবং নতুন করে সারা দুনিয়ায় আলোচনায় আসতেই কুষ্টিয়ার একটি থানার অস্ত্র-গোলাবারুদ লুটের পরিকল্পনা করেছিল তারা, যাতে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে বলে প্রচার প্রোপাগান্ডা চালানো যায়। এসব ষড়যন্ত্রের শেকড় অনেক গভীরে বলেও এ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
×