ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন- কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ১২২ কোটি ৭৭ লাখ

সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক নির্মাণ শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক নির্মাণ শুরু

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশে সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিক শুরু হয়েছে। সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ মহাসড়কের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৬ হাজার ২৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অনুমোদনের এক মাসের মধ্যেই আরও ৫০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে ১২২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী প্রকল্পের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এ পর্যন্ত যত জাতীয় মহাসড়ক প্রকল্প নির্মাণ হয়েছে বা চলছে তার মধ্যে এই প্রকল্পের ব্যয় কিলোমিটারপ্রতি কয়েকগুণ বেশি। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রকল্পটি হওয়ার কারণে জমির দাম অনেক বেশি। হুইল এক্সক্যাভেটর চালিয়ে ট্রাকে বালু তুলে কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ওবায়দুল কাদের। ঢাকা-মাওয়া সড়কের কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেতুমন্ত্রী বলেন, এটা হবে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। পদ্মাসেতুর এপার-ওপার যোগ করে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিকমানের সড়ক (এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণ কাজ শুরু হলো আজ। মন্ত্রী বলেন, চার লেনের এ এক্সপ্রেসওয়ে সড়কপথের মাঝামাঝি থাকবে ‘মিডিয়ান’। যেখানে ভবিষ্যতে মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। ৫৫ কিলোমিটারের মধ্যে থাকবে ৪ ফ্লাইওভার, ৪ রেলওয়ে ওভারপাস, ২১ আন্ডারপাস এবং ৩ ইন্টারচেঞ্জ। ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মাসেতুর সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেয়া হবে বলেও জানান মন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন নির্মাণে গত বছর অক্টোবরে ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ২৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ বিষয়ে প্রকল্পটির বিভিন্ন খাতের ব্যয় অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ১২টি খাতের বিভিন্ন ব্যয় নিয়ে আপত্তি করে কিন্তু তারপরও তা না কমে উল্টো ৯৩২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। এতে প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৬২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। গত মার্চে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) বৈঠক হয়। এতেও প্রকল্পটির অত্যধিক ব্যয়ের বিষয়ে আপত্তি ওঠে। তার পরও ব্যয় উল্টো ২৮৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। এতে একনেকে অনুমোদনকালে ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার ২৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৬ হাজার ৭৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। যা দেশে চলমান ও প্রস্তাবিত অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে বেশি। এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এ ব্যয় কয়েকগুণ বেশি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণে খরচ বৃদ্ধির যুক্তিতে বাড়ানো হচ্ছে এ ব্যয়। প্রকল্পটির আওতায় দুই প্যাকেজে ঢাকার বাবুবাজার লিংক রোড থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও মাদারীপুরের পাচ্চর হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার চার লেন করা হবে। এজন্য জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে ২৪ দশমিক ৮৮ হেক্টর। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় রয়েছে ১৯ দশমিক ৩৭ ও মুন্সীগঞ্জে ৫ দশমিক ৫১ হেক্টর। প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে যথাক্রমে ১০০ ও ৫০ কোটি টাকা। ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় জমির প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি বলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় জানানো হয়। জমির প্রকৃত মূল্য বিবেচনায় তা সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয় সভায়। একনেকের কার্যবিবরণীতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ২৪ দশমিক ৮৮হেক্টর জমি অধিগ্রহণের ব্যয় প্রাক্কলন করতে হবে। এর ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে হবে ডিপিপি। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে জমির দাম বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে মৌজা অনুযায়ী ঢাকা জেলায় ১৯ দশমিক ৩৭ হেক্টর জমির দাম পড়বে ৪৩৫ কোটি টাকা। আর মুন্সীগঞ্জের ৫ দশমিক ৫১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হবে ২১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ জমি অধিগ্রহণে মোট ব্যয় হবে ৬৫০ কোটি টাকা। ফলে এ খাতে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে। সম্প্রতি এ বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান সাংবাদিকদের বলেন, প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিটি জেলার মৌজা অনুযায়ী সরকার ঘোষিত জমির ন্যূনতম মূল্য ধরা হয়। এক্ষেত্রেও তা করা হয়েছিল। তবে ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জে জমির দাম অনেক বেশি। এজন্য ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। তবে ব্যয় কতটা বাড়বে, তা জমি অধিগ্রহণের পর জানা যাবে। উল্লেখ্য, গত জানুয়ারিতে চলমান ও নতুন বিভিন্ন চার লেন প্রকল্পের কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় জানতে চায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এজন্য সংসদীয় কমিটিতে জমা দেয়া সওজের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রস্তাবিত এলেঙ্গা-রংপুর চার লেন প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর সম্প্রতি শুরু হওয়া জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইল হয়ে এলেঙ্গা চার লেনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ৪৮ কোটি ৬ লাখ টাকা। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনে কিলোমিটারপ্রতি গড় ব্যয় ১৯ কোটি ৮৫ লাখ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পে ২০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এতে বলা হয়, ইউরোপে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ২৮ কোটি টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ ব্যয় ১০ কোটি টাকা। আর চীনে তা গড়ে ১৩ কোটি টাকা। গত বছর জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইউএন-ইসিইর (ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ) এক সেমিনারেও এ ধরনের তথ্য তুলে ধরেন গ্রিসের ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের অধ্যাপক দিমিত্রিয়স স্যামবুলাস। ‘এস্টিমেটিং এ্যান্ড বেঞ্চমার্কিং ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার কস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহাসড়ক নির্মাণের তুলনামূলক ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
×