ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানি হচ্ছে অন্তত ৫০ দেশে;###;বছরে রফতানি আয় ৬৫০ কোটি টাকা;###;বর্তমানে উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়, চীন ও ভারতের পরে

সবজি বিপ্লব ॥ উৎপাদনে নতুন রেকর্ডের পথে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

সবজি বিপ্লব ॥ উৎপাদনে নতুন রেকর্ডের পথে বাংলাদেশ

এম শাহজাহান ॥ শাকসবজি উৎপাদনে নতুন রেকর্ড অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত বছরের চেয়ে বাড়িয়ে এবার রবি মৌসুমে ৫ দশমিক ২৮ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে এবার দেশে সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদন হবে। সবজির বড় আমদানিকারক ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি পর্যবেক্ষক দল শীতকালীন সবজি উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ স্বচক্ষে দেখতে এখন বাংলাদেশ সফর করছে। ইতোমধ্যে সবজি উৎপাদনকারী জেলাগুলো পরিদর্শন করেছে তারা। প্রতিনিধি দলটি দেশের সবজি উৎপাদন এবং গুণগতমান নিয়ে ‘যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছে। দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিবছর উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে ৪০ ভাগ সবজি নষ্ট হচ্ছে। তাই সবজি রক্ষা এবং রফতানি বাড়ানোর বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ ও পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাতটি নিয়ন্ত্রিত ফসলÑ ধান, গম, আখ, আলু, পাট, মেস্তা এবং কেনাফের পাশাপাশি নন-নোটিফাইড বা অনিয়ন্ত্রিত ফসল উৎপাদন দেশে গত কয়েক বছরে বেড়েছে। ধান উৎপাদন বাড়ায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। অনিয়ন্ত্রিত ফসলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে শাকসবজি। হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়। গত কয়েক বছরে রীতিমতো দেশে সবজি বিপ্লব ঘটেছে। বৃহৎ রাষ্ট্র চীন এবং ভারতের পরই সবজি উৎপাদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) মতে, গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশে সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। রবি মৌসুম বিশেষ করে নবেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সবজি উৎপাদন হচ্ছে। নগরবাসী উচ্চমূল্য দিয়ে কিনলেও কৃষক পর্যায়ে পানির দরে বিক্রি হচ্ছে এসব সবজি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মোঃ মোশারফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে দেশে সবজি উৎপাদন বেড়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে কৃষকের মনোযোগ সবজি উৎপাদনে বেশি। কৃষিজমির পরিমাণ না বাড়লেও গত এক দশকে বাংলাদেশে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, উৎপাদনে প্রথম হওয়া নয় বরং সবজির চাহিদা এবং যোগানের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো সবচেয়ে বেশি জরুরী। অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা গেলে কৃষক পর্যায়ে ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা সম্ভব। পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সবজি বিপ্লব ঘটবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। চাহিদা এবং রফতানির বিষয়টি মাথায় রেখে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের রবি মৌসুমে ৫ দশমিক ২৮ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদন করা হবে। গত ১৫ নবেম্বর পর্যন্ত ২ দশমিক ৩৫ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। বাকি জমিগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে। গত বছরের এ সময়ে ৫ দশমিক ১০ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছিল। ভাল স্বাদের সবজির জন্য আগে শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের নতুন জাত উদ্ভাবনের কারণে টমেটো, লাউ, কপি বা নানান পদের শাক সারাবছর পাওয়া যাচ্ছে। এখন প্রায় সারাবছরই ২০ থেকে ২৫ জাতের সবজি খেতে পারছে দেশের মানুষ। কৃষকরা সারাবছরই নানান ধরনের সবজির চাষ করছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোঃ আশরাফুল হক পিএইচডি জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণার কারণে দেশে নতুন নতুন জাতের সবজি উৎপাদন হচ্ছে। চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে দেশের শাকসবজি। দেশে সবজির উৎপাদন যেমন বেড়েছে, ভোগও তেমনি বেড়েছে। গত এক যুগে দেশে মাথাপিছু সবজির ভোগ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি সবজি রফতানি করেও মিলছে বৈদেশিক মুদ্রা। গত এক বছরে শুধু সবজি রফতানি আয়ই বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। তিনি বলেন, বিটি বেগুন উৎপাদনে একটি বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। জানা গেছে, চার ধরনের বিটি বেগুন দেশে অবমুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ বারি বিটি বেগুন-১ উত্তরা, বারি বিটি বেগুন-২ কাজলা, বারি বিটি বেগুন-৩ নয়নতারা এবং বারি বিটি বেগুন-৪ নামের চারটি জাত চাষী পর্যায়ে চাষের জন্য অবমুক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বিটি বেগুনের এসব জাত উদ্ভাবন করে। প্রথমদিকে এটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এসব বেগুনে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। জানা গেছে, গত এক যুগে দেশের কৃষিজমির পরিমাণ না বাড়লেও সবজির জমির পরিমাণ বাড়াচ্ছেন কৃষকরা। দেশে বর্তমানে এক কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। এই কৃষক পরিবারগুলোর প্রায় সবাই কমবেশি সবজি চাষ করে। জমির পাশের উঁচু স্থান, আইল, বাড়ির উঠান, এমনকি টিনের চালাতেও এ দেশের কৃষকরা সবজির চাষ করছেন। এমনও দেখা গেছে, ফলবাগান ও বাড়ির রাস্তার পাশের উঁচু গাছের মধ্যেও মাচা করে সবজির চাষ করছেন অনেক কৃষক। ফলে মোট কৃষিজমির পরিমাণ কমলেও সবজি চাষের এলাকা বেড়েছে। এছাড়া নদী ও জলাশয়ে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজির উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এক সময় দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরে কেবল সবজির চাষ হতো। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারাবছরই কমবেশি সবজির চাষ হচ্ছে। দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়া বেসরকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এসিআই, সুপ্রীম এবং লাল তীর সবজির বীজ আমদানি করছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে এক কোটি ৩৮ লাখ টন সবজি উৎপাদিত হয়েছে। আর আলু উৎপাদনের পরিমাণ ৯৬ লাখ টন। গত তিন বছরে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা গ্রীষ্মকালীন টমেটো, লাউ, করলাসহ বেশ কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। বেসরকারী বেশ কয়েকটি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে। কৃষি মন্ত্রণায়ের বীজ উইংয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বছরে বীজের চাহিদা সাড়ে চার হাজার টন, যার ৭০ শতাংশই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারজাত করে। এই বীজের ৬০ শতাংশ হাইব্রিড জাতের এবং বাকি ৪০ শতাংশ বারির বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আধুনিক ও দেশী জাতের। বিষমুক্ত সবজি চাষ করা হচ্ছে ॥ পদ্ধতিটা খুব একটা কঠিন কিংবা ব্যয়সাধ্য নয়। বিষমুক্ত সবজি চাষ করতে কৃষি বিভাগের বিষমুক্ত থেরাপির পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা ব্যবহার করছেন তাদের নিজস্ব পদ্ধতি। আর এতেই বাজিমাত। কৃষকের কীটনাশক ক্রয় করার টাকা যেমন বেঁচে যাচ্ছে, তেমনি ভোক্তারাও পাচ্ছেন বিষমুক্ত সবজি। প্রথমদিকে কীটনাশকের অপপ্রয়োগ সম্পর্কে উত্তরের কৃষক এতটা সচেতন না হলেও এখন এর ক্ষতিকারক দিক জেনে গেছেন তারা। এ কারণে তারা বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে আগ্রহী। এক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমন পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সবজি রফতানি হচ্ছে ৫০ দেশে ॥ বিশ্বের প্রায় পঞ্চাশটি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রফতানি হচ্ছে। আর এ রফতানি থেকে বছরে আয় হচ্ছে ৬৫০ কোটি টাকা। বিদেশে বাংলাদেশের শাকসবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চাহিদার মাত্র ২ থেকে ৫ শতাংশ রফতানি করতে পারছেন উদ্যোক্তারা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, গত অর্থবছরে ৬৫০ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার টাকার সবজি রফতানি হয়েছে। রফতানির পরিমাণ প্রতিবছর বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৫০ দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রফতানি হয়। তবে যেসব দেশে বাংলাভাষীরা বসবাস করছে, সেসব দেশে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা বেশি। দেশের রফতানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যায়। এসব সবজির মধ্যেÑ করলা, কাঁকরোল, টমেটো, পেঁপে, বেগুন, ঢেঁড়স, লাউ, কচুর লতি, কচুরমুখি, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, কাঁঠাল, শসা, চিচিঙ্গা, লালশাক, পুঁইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচামরিচ, পটল ও ঝিঙা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রক্রিয়াজাত সবজির মধ্যে ডাঁটা, কচুরলতি, শিমের বিচি, কাঁচকলা, কলার ফুল, কচুশাক ও কাঁঠাল বিচি রফতানি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস এ্যান্ড এলাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, সবজি রফতানি বাড়ছে। তবে ‘পানপাতা’ দিতে না পারলে শাকসবজির অর্ডার পাওয়া যায় না। এটাই বাস্তবতা। তাই পানের বাজার উন্মুক্ত হতেই হবে। দীর্ঘ গবেষণা করে পান থেকে স্যালমোনেলা ব্যাকটিরিয়া দূর করার ওষুধ আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। কিন্তু পান যে ব্যাকটিরিয়ামুক্ত তা সরকারকে বলতে হবে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করাসহ লন্ডন, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস এ ব্যাপারে কাজ করতে পারে।
×