ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আকিল জামান ইনু

লিওনার্ড কোহেন বিদায়-দি ডার্কার ভয়েস

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

লিওনার্ড কোহেন বিদায়-দি ডার্কার ভয়েস

আজন্ম ঘরবসতি বিষণ্ণতায়। তার এ্যালবামের শিরোনাম ভালবাসা আর ঘৃণায়। অবশেষে সব ভালবাসা, ঘৃণা আর প্রশ্নের অবসানে বিদায়। লিওনার্ড কোহেন আর নেই। ৮২ বছর বয়সে ৭ নবেম্বর তার ভাষায় ‘পরম বন্ধু’ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন তিনি। থেমে গেছে বিশ্ব সঙ্গীতের দি ডার্কার ভয়েস। কৈশোরে যার মনোজগতে শেকড় গেঁড়েছিল স্প্যানিশ কবি- গার্সিয়া লোরকা। সেই থেকে বিচরণ নিঃসঙ্গ, ছায়াচ্ছন্ন, মায়াময় পরাবাস্তবতায়। আবার সে ভূবন থেকে বেরিয়ে এসে পা রেখেছেন নির্মম বাস্তবে, অন্য সব মহৎ লেখক, শিল্পীর মতই। ছিল আত্মজিজ্ঞাসা। পথ খুঁজেছেন নিজে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে ভাবতে শিখিয়েছেন। অদ্ভুত আঁধার থেকে উঠে আসা তার গান আমাদের বিহ্বল করে, যখন তিনি নিজ রচনায় গেয়ে উঠেন, I saw a beggar leaning on his wooden crutch, he said to me, “you must not ask for so much.” And a pretty woman leaning in her darkened door, she cried to me, “Hey, why not ask for more?” তার রচনা আমাদের সামনে উন্মোচিত করে ধর্ম, রাজনীতি, নিঃসঙ্গতা, যৌনতা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভালোবাসার ভিন্ন এক জগত। জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারে। কানাডার মন্ট্রিলে। পিতা নাথান কোহেন, মা মার্শা ক্লোনিস্কি। সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা মাতৃসূত্রে পাওয়া। তার ভাষায়, ‘মা ছিলেন রাশিয়ান। গান গাইতেন সারা বাড়িজুড়ে, তার গান ও সুরের খেলা আমাকে প্রভাবিত করেছে গভীরভাবে।’ প্রাথমিক শিক্ষাজীবন রোজলিন এলিমেন্টারি স্কুলে। ১৯৪৮-এ ভর্তি হন ওয়েস্টমন্ট হাইস্কুলে সেখানে তার অধ্যয়ণের বিষয় ছিল সঙ্গীত ও কবিতা। তার আমূল বদলে যাওয়া এখান থেকেই শুরু । আসক্ত হয়ে পরেন গার্সিয়া লোরকার কবিতায়। মেটাল স্ট্রিং অ্যাকুয়াস্টিক গিটার এর স্থান দখল করে ক্লাসিকাল গিটার। গিটার শেখেন এক স্প্যানিশ ফ্ল্যামেনকো গিটার বাদকের কাছে। গঠন করেন তার প্রথম কান্ট্রি ফোক ব্র্যান্ড বাকস্কিন বয়েজ। ১৯৫১তে উচ্চ শিক্ষার্থে ম্যাকাগিল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি এবং ১৯৫৪তে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন। এ পর্যায়ে তার রচনাকে প্রভাবিত করেছে ইউলিয়াম বাটলার ইয়েটস, আরভিং লেইটন, ওয়াল্ট হুইটম্যান, গার্সিয়া লোরকা ও হেনরী মিলারের লেখণী। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লেট আস কম্পেয়ার মাইথোলজিস’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ তে। ম্যাকগিল ল স্কুলে কিছুদিন আইন অধ্যয়ন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৫৭ তে নিউইয়র্ক ছেড়ে ফিরে যান মন্ট্রিলে। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ১৯৬১তে- ’দি আইস বক্স অফ আর্থ।’ আর্থিক সাফল্য না এলেও গ্রন্থটি তাকে সাহায্য করে কানাডার মূল ধারার সাহিত্যে জায়গা করে নিতে। ১৯৬৪তে প্রকাশ পায় ‘ফ্লাওয়ার্স ফর হিটলার।’ এরপর ক্রমাগত লিখে গেছেন গান ও কবিতা। সর্বশেষ প্রকাশনা ২০১১তে অমনিবাস- পয়েমস এন্ড সংস। উপন্যাস বচনা করেছেন দুটি ১৯৬৩তে প্রকাশিত ‘দি ফেভারেট গেম’ এবং ১৯৬৬তে ‘বিউটিফুল লুসারস।’ দ্বিতীয় উপন্যাসটি পরবর্তীতে সারাবিশ্বে তিন মিলিয়নের বেশি বিক্রি হলেও প্রাথমিক আর্থিক সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। তিনি সঙ্গীত রচনায় ভাগ্য পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন অতঃপর নিউইয়র্ক গমন। ৩৩ বছর বয়সে কোহেন পুনরায় পা রাখেন নিউইয়র্কে সঙ্গীত রচনার ক্যারিয়ার সামনে রেখে। যা তাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে পরবর্তী পাঁচ দশক। কারণ তার গান মূলত প্রথমে কবিতা তারপর সঙ্গীত। কবিতাকে গানে রূপ দেয়ার স্বার্থে তাকে আপোষ করতে হয়েছে বাণী, সুর, শব্দ আর ছন্দের সঙ্গে। গানের স্বার্থে করা প্রতিটি শব্দ পরিবর্তন ছিল, তার ভাষায় নিজ সৃষ্টিকে হত্যা তথা নিজেকে হত্যা করার সামিল। আবার এও সত্য হাজারো পরিবর্তন তার রচনার কাব্যিক সৌন্দর্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি বিন্দুমাত্র। তিনি অনেক বেশি স্পষ্ট এবং সরাসরি তার সঙ্গীতে যখন তিনি উচ্চারণ করেন। `I’ve seen the future, brother, it is murder.’ তার রচিত বিখ্যাত গান ‘সুজানে’ প্রথম রেকর্ড হিসেবে প্রকাশ পায় ১৯৬৬তে জুডি কলিন্সের এ্যালবাম-‘ইন মাই লাইফ’ এ। ততদিনে তিনি নজর কেড়েছেন কলম্বিয়া রেকর্ড’স এর কর্তা হ্যামন্ড এর। উল্লেখ্য, এই হ্যামন্ডের হাত ধরেই আত্মপ্রকাশ বব ডিলন, ব্রুস স্প্রিংটন এর মত শিল্পীদের। যদিও হ্যামন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার এ্যালবাম প্রযোজনার দায়িত্ব নেন জন সিমন। ‘সংস অফ লিওলার্ড কোহেন’ নামে এ্যালবামটি প্রথম প্রকাশ পায় ২৭ ডিসেম্বর ১৯৬৭ এ। তার গানের বাণী নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানুয়ারি ১৯৬৮তে মত প্রকাশ করে, স্কোপেনহাওয়ার ও বব ডিলান এ দুজনের নৈরাশ্যের মাঝামাঝি। তার প্রথম টিভিতে আত্মপ্রকাশ ১৯৬৮ তে বিবিসির জন্য জুলি ফেলিক্স এর সঙ্গে ডুয়েট গেয়ে। তার প্রকাশিত স্টুডিও এ্যালবাম ১৪টি। লাইভ এ্যালবাম ৮, সংগৃহীত এ্যালবাম সংখ্যা ৫। একক প্রকাশিত গান ৪৪। তার সমগ্র সৃষ্টি কর্ম পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট নৈরাজ্য, যুদ্ধ, ধ্বংস, মৃত্যু, ব্যক্তিগত ক্ষত, অন্তর্গত বেদনা তিনি অতিক্রম করে গেছেন একটি আলো স্পর্শ করবেন বলে-সে আলোর নাম ভালোবাসা। তাই তো তিনি গেয়ে উঠেন। I’ve seen the nation rise and fall But love’s the only engine of survival. অন্তরে বাউল এই মানুষটি ভালবাসার টানে অন্তর বাজিয়েছেন বারবার। প্রথম প্রেম মারিয়ানে ইলেন যাকে নিয়ে তার অমর সৃষ্টি-সো লং মারিয়ানে। জুলাই ২০১৬তে মারিয়ানের ফিউনারেল এ তার লেখা যে বার্তাটি পরা হয় তা এমন, ‘আমাদের শরীর ভেঙে পরছে। ধারণা করি খুব শীঘ্রই আমিও তোমাকে অনুসরণ করতে যাচ্ছি। তুমি জান আমি তোমার কত কাছে, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে আমায়।’ নিজের মৃত্যুর চার মাস আগে লিখা এ বার্তা! সত্তর এর দশকে সম্পর্কে জড়ান লস এঞ্জেলস-এর শিল্পী সুজানা ইর্লড-এর সঙ্গে। যিনি তাকে দুটি সন্তান উপহার দেন। মেয়ের নাম রাখেন প্রিয় কবির নামে লোরকা। সবার ধারণা তার বিখ্যাত গান ‘সুজানে’ রচনা সুজানে ইর্লডকে কেন্দ্র করে। সেটি ভুল, গানটি তিনি রচনা করেন তার বন্ধুর সাবেক স্ত্রী সুজানে ডার্ডেল কে সামনে রেখে, ইর্লড-এর সঙ্গে পরিচয়ের বহু পূর্বে। ইলর্ডের পর তিনি সম্পর্কে জড়ান ফরাসী চিত্রগ্রাহক ডমিনিক ইসারম্যান, ফরাসী অভিনেত্রী রেবেকা ডি মরনির সঙ্গে। এর বাইরেও ভালবাসার তরী ভিড়িয়েছেন অসংখ্য বন্দরে, কিন্তু বিয়ে নামক নোঙর ফেলা হয়নি কোথাও। ছিলেন চিরকুমার। তার ধর্ম পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও তা সত্য নয়। আমৃত্যু ছিলেন ইহুদি ধর্মের অনুসারী। মাঝে ‘নীরবতা’ নাম নিয়ে ৫ বছর কাটিয়েছেন বৌদ্ধ ধর্মের সেবায়। ব্যাপক চর্চা করেছেন বাইবেল। কিন্তু এর সবই ছিল ধর্মের কাছে আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজা। ধর্মের আত্মার সন্ধান। কোহেনের সঙ্গীত জীবনের লক্ষ্যণীয় দিক হল তিনি সমসাময়িক শিল্পীদের চেয়ে একটু বেশি বয়সে ক্যারিয়ার শুরু করেন। আর সঙ্গীত চার্ট তাকে সেভাবে প্রতিফলিত করেনি কখনই। তার গান প্রথমে জনপ্রিয়তা পেয়েছে অন্যদের কণ্ঠে যেমন ‘সুজানে’, ‘হ্যালেলুইজা’ যা তারপর উঠে এসেছে তার কণ্ঠে। তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ধীরে, সেই সঙ্গে নিজের আসন শক্ত করেছেন সঙ্গীত ভুবনে। নিউইয়র্ক টাইমস এর মতে, বব ডিলানের পরে সঙ্গীত ভূবনকে তার মত আর কেউ প্রভাবিত করেনি। তার রচিত গান গায়নি এমন কোন বিখ্যাত গায়ক বা ব্যান্ড নেই। নির্ভানা ১৯৯৩ এ রিলিজকৃত এ্যালবামের পেনি রয়ালটি গানে উল্লেখ করেছেন কোহেন কে। কার্ট কোবাইন লিখেন দএরাব সব `Give me a leonard cohen afterworld/so I can sigh eternally.‘ তার রচিত সঙ্গীতের তালিকাটি বিশাল- সুজানে, হ্যালেলুইজা, ডেমোক্র্যাসি, টাওয়ার অফ সংস, এভরিবডি নো’স, এঞ্জেলস আইস, লাভার লাভার লাভার, ফেমাস ব্লু রেইনকোট, আই এ্যাম ইয়োর ম্যান এমন অসংখ্য অমর গানের রচয়িতা ও গায়ক তিনি। হ্যালেলুইজা গানটি সম্পূর্ণ করতে তিনি সময় নিয়েছেন ৫ বছর। নিউইয়র্ক টাইমস এ জেনেট ম্যাসলিন এই গানটি নিয়ে লিখেন, ‘এটি সম্ভবত মার্কিন সঙ্গীত ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গীত গান।’ একই সঙ্গে সঙ্গীত সংশ্লিষ্ট মহলকে প্রভাবিত করায় নিউইয়র্ক টাইমস তাকে ঠাঁই দিয়েছে বব ডিলনের উপরে। সর্বশেষ ১৪তম এ্যালবামটি রিলিজ পায় গত ২১ অক্টোবর। অদ্ভুত আঁধার থেকে উঠে আসা বিষণ্ন ভারী কণ্ঠে রানিংবেস আর সিøয়ার্সের সমন্বয়ে তিনি গেয়ে উঠেন ‘ইউ ওয়ান্ট ইট ডার্কার’ যা তার এ্যালবামের শিরোনামও। বিষণ্নতার পাশাপাশি সমাজ সচেতন কোহেন আমাদের শুনিয়েছেন। The poor stay poor , the rich get rich That `s how it goes, every body knows. নিজের লিখা নিয়ে কোহেন বলেন, ‘আমার প্রতিটি রচনার পেছনে ছিল গিটার। এমনকি তা উপন্যাসের বেলাতেও।’ আর্থিক প্রতারণার শিকার হন ঘনিষ্ট বন্ধু ও দীর্ঘ দিনের ম্যানেজার কেলী লিনচ কর্তৃক। ২০০৫ এ মামলা করেন। আদালত তার পক্ষে ৯ মিলিয়ন ডলার প্রদানের আদেশ দিলেও তা কখনই আদায় হয়নি। আর্থিক দৈন্য কাটিয়ে উঠতে ২০০৮এ শুরু করেন সঙ্গীত ট্যুর। বিলবোর্ড ম্যাগাজিনের তথ্য মোতাবেক কেবল ২০০৯ এ আয় করেন ১০ মিলিযন ডলার। অর্জনের তালিকাটিও বিশাল।বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিগ্রীর পাশাপাশি পেয়েছেন অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কার। অর্জন করেছেন কানাডার সর্বোচ্চ নাগরিক খেতাব। ঠাঁই করে নিয়েছেন কানাডার গায়ক ও সঙ্গীত রচয়িতার হল অফ ফেম এ। ২০০৮ এ রক এন্ড রোল হল অফ ফেমে তার অন্তর্ভুক্তির সময় লো রিড আমাদের হয়ে বলেন, we are so lucky to be alive at the same time leonard cohen is. লাইভ টাইম গ্রামি এচিভমেন্ট প্রদানের সময় তাকে নিয়ে বলা হয়, ‘তিনি সেই কণ্ঠ যে সময়ের সীমানা পেরিয়ে বয়ে চলেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।’ লিওনার্ড কোহেন থেমে গেছেন। ছিলেন ক্যান্সারে আক্রান্ত । তার সম্বন্ধে হল অফ ফেমে বলা হয়েছে , ‘One of the few artist in the realm of popular music who can truly be called poets.’ আর তার ভাষায়, ‘আই অ্যাম জাস্ট পেয়িং মাই রেন্ট এভরিডে/ইন দি টাওয়ার অফ সং।’ তিনি জানতেন তাকে থেমে যেতে হবে। নীরবতা জড়িয়ে নেবে তার কণ্ঠ। কিন্তু কার কাছে এই সমর্পণ? আজীবন খুঁজে ফেরা না পাওয়া ভালবাসা অথবা তার কল্পিত ঈশ্বর? উত্তর আমাদের জানা নেই। কেবল ভেসে আসে অদ্ভূত আঁধার থেকে উঠে আসা তার কণ্ঠ If it be your will, That i speak no more. And my voice be still As it was before, I will speak no more. লিওনার্ড কোহেন নীরবতা বেছে নিয়েছেন ।
×