ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

বর্ণাঢ্য লোকসঙ্গীত উৎসব

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

বর্ণাঢ্য লোকসঙ্গীত উৎসব

শোনিত ধারায় বহমান যে সুর, তার আবেদন চিরকালের। সে সুরের অমোঘ আকর্ষণ এড়ানো যায়নি কোন কালেই। তৃষিত প্রাণে তাই শিকড়ের সুরের আকুতি। সেই সুরের সঙ্গে মিশে থাকা কথার ইন্দ্রজাল কাঁদায়-হাসায়-ভাবায়, প্রশ্ন রেখে যায়, যাপিত জীবনের অর্থ আর সৃষ্টি রহস্য নিয়ে। এটি একটি জীবন দর্শন। এই সঙ্গীতের অপূর্ব সুর এবং কথায় আত্মা হয় পরিশুদ্ধ। হৃদয়ের গহীন স্পর্শ করা লোকসঙ্গীত শুধু বাংলার মানুষের জীবনধারা নয় বরং বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনায় দারুণভাবে জড়িয়ে আছে। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি আর বাউল গানের সুরে দেহ-মনে আসে পরম তৃপ্তি। হাজার বছর ধরে বাংলার শেকড়ে ছড়িয়ে থাকা গানগুলো আলোড়িত করে যাচ্ছে শ্রোতাদের প্রাণ। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এর মুগ্ধতার ছোঁয়া। গত ১০ নবেম্বর ২০১৬ বৃহস্পতিবার ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সন্ধ্যায় শুরু হয় তিন দিনের ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট, আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব।’ সুরের কাছে সমর্পিত সঙ্গীতপ্রেমীদের আগমনে গতবারের মতো এবারও উৎসবটির সফল আয়োজন বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতকে আরও এক ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তিন দিনের এই উৎসবটির পরিবেশনাগুলো সরাসরি প্রচার করে মাছরাঙা টেলিভিশন। ইউনেস্কো ২০০৫ সালে বাউল গানকে ইনট্যানজিবল হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও নতুন প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই লোকসঙ্গীতের ব্যাপারে আগ্রহের অভাব দেখা যায়। সঠিক পরিকল্পনা, চর্চা এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই এ অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বেশ কিছু তরুণ-প্রবীণ শিল্পী উদ্যোগ নিয়েছেন নতুনভাবে বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার জন্য। এতেই প্রমাণ হয় যে, এটাই আমাদের প্রাণের গান, মনের গান এবং অন্তরের গান। এই বাস্তবতা ও অনুপ্রেরণা থেকেই স্কয়ার, মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টসের এই আয়োজন। জমকালো এই আয়োজনে অংশ নেন এ দেশের লোকজ গানের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী মমতাজ, বারী সিদ্দিকী, ইসলাম উদ্দিন কিস্সাকার, আবদুর রহমান বাউল, সুনীল কর্মকার, বাউল শফি মণ্ডল, লতিফ সরকার, টুনটুন বাউল, ফরিদা ইয়াসমিন, খ্যাতিমান বাঁশিশিল্পী জালাল। বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই শিল্পীদের পাশাপাশি উৎসবে নিজ দেশের লোকসঙ্গীত পরিবেশন করবেন ভারতের কৈলাস খের, নুরান সিস্টার্স, ব্যান্ড ব্লু ওশেন, ফরাসী প্রবাসী ভারতের শিকড়ের গানের শিল্পী পবন দাস বাউল, পাকিস্তানের বংশধর এবং ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের ওস্তাদ জাভেদ বশির। তাদের পাশাপাশি ছিল স্পেনের গানের দল কারেন লুগো এ্যান্ড রিকার্ডো মোরো, ইংল্যান্ডের সুফি ঘরানার আলোচিত ব্যান্ড সুশীলা রামান এ্যান্ড স্যাম মিলস। ছিল সাইমন টেকার, প্রসাদ, রাজু বাউলসহ আরও বেশ কয়েক শিল্পীর পরিবেশনা। এতে গান শোনান বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানের শিল্পীবৃন্দ। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে লোকজ গানে সাজানো এ সঙ্গীতাসর। উৎসবের শুরু হয় লোকগানের সুরে লোকনৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে। ‘হেইয়া রে হেইয়া জোরে মারো টান’, ‘বকুল ফুল বকুল ফুল/ সোনা দিয়ে হাত কেন হাত কেন বান্ধাইলি’সহ কয়েকটি গানের আশ্রয়ে নাচ করে পল্লবী ড্যান্স গ্রুপ। আন্তর্জাতিক এ লোকগীতির আসরে প্রথম গান শোনান সুনামগঞ্জের শাহ আবদুুল করিমের শিষ্য আবদুর রহমান বয়াতি। তিনি শুরুতেই গেয়ে শোনান ‘আমি তোমার হইতে পারলাম না।’ এরপর গেয়ে শোনান বাউল সাধক শাহ আবদুল করিমের গান ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম।’ রাজু দাস বাউল গেয়ে শোনান ‘পার করো আমারে’, ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো/আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে’, ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ গানগুলো। মঞ্চে আসেন পাকিস্তানের শিল্পী জাভেদ বশির। হিন্দুস্তানী ক্লাসিক্যাল ঘরানার এ শিল্পী বাংলাদেশে বিশেষ পরিচিতি পান বলিউডের ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাই দোবারা’ চলচ্চিত্রের ‘ইয়ে তুনে ক্যায়া কিয়া’ গানের মধ্য দিয়ে। তিনি শুরুতেই শাস্ত্রীয় সুরে মুগ্ধ করেন দর্শক-শ্রোতাদের। এর পর গেয়ে শোনান ‘নিসা’, ‘তেরা নাম যাব ভি লিয়া’, ‘দামাদাম মাস্ত কালান্দার’সহ আরও কয়েকটি গান। টুনটুন বাউলের পরিবেশনা শেষে মঞ্চে আসেন স্কটল্যান্ডের সাইমন থ্যাকার্স সাভারা কান্তি। তাদের সঙ্গে জোট বাঁধেন ভারতের রাজু দাস বাউল ও বাংলাদেশের ফরিদা ইয়াসমিন। প্রথম দিনের মূল আকর্ষণ ছিল ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম। গানের মঞ্চ থেকে রাজনীতির মাঠ সবখানে সফল এ শিল্পীর নাম ঘোষণা হতেই হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ে পুরো আর্মি স্টেডিয়াম। প্রায় এক ঘণ্টার পরিবেশনায় তিনি গেয়ে শোনান জনপ্রিয় সব লোকগান। শ্রোতারাও কণ্ঠ মেলান প্রতিটি গানে। পরিবেশনার শুরুতেই মমতাজ গেয়ে শোনান ফকির কালু শাহের ‘ভুইলো না মন তাহারে।’ এরপর তিনি একে একে ‘মন মিনারায় পড়েছে আজান’সহ বিভিন্ন বাউল সাধক ও নিজের গান গেয়ে শোনান। দ্বিতীয় দিনের মূল আকর্ষণ ছিল ফ্লামেঙ্গো নাচের যূথবদ্ধ পরিবেশনা। এ ছাড়া সঙ্গীত পরিবেশন করেন ভারতের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কৈলাস খের। বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে সঙ্গীত পরিবেশন করেন জালাল ও লতিফ সরকার। তাছাড়া ছিল বাউল শফি মণ্ডল আর লাবিক কামাল গৌরবের যুগলবন্দি। নিজেদের গান নিয়ে আসে ভারতের লোকব্যান্ডদল ইন্ডিয়ান ওশেন। ফ্লামেঙ্গো বাংলাদেশে এখনও তারা তেমন পরিচিত নন, কিন্তু দুনিয়াজোড়া সঙ্গীত-রসিকদের কাছে তারা খ্যাতিমান। ব্রিটেনের রানি গান শুনতে তাদের কয়েকবার ডেকেছেন রয়্যাল এ্যালবার্ট হলে। সেই মাঙ্গানিয়ারদের গান এবার প্রথম শোনেন ঢাকার শ্রোতারা। ভারতের রাজস্থানের দক্ষিণাঞ্চলের এই দলের বেশিরভাগ সদস্য এসেছেন পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী জয়সলমীর, যোধপুর, বাড়মের অঞ্চল থেকে। দলটির মাঙ্গানিয়ার সদস্যরা হলেন আনোয়ার খান মাঙ্গানিয়ার, কাচরা খান মাঙ্গানিয়ার, ঘেঁওয়র খান মাঙ্গানিয়ার, ফিরোজ খান মাঙ্গানিয়ার ও খেতে খান মাঙ্গানিয়ার। এই দলে আরও আছেন হাবিব খান লাঙ্গা এবং কালবেলিয়া জাতির শুভা দেবী ও মালকা। রাজস্থানের মাঙ্গানিয়াররা জাতিতে মুসলমান। লাঙ্গারাও একই অঞ্চলে বসবাসরত আরেকটি মুসলমান জাতি। অন্যদিকে হিন্দু কালবেলিয়ারা পেশায় ছিলেন সাপুড়ে। তারা নেচে নেচে সাপের খেলা দেখাতেন। এই নাচই পরে লোকনৃত্যের মর্যাদা পায়। অবাক করা কথা হলো, দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেয়েও তারা সবাই এখনও থাকেন রাজস্থানের নিভৃত মরু গ্রামে। লোকসঙ্গীত উৎসবের শেষ দিনে মঞ্চে এসে শিল্পী বারী সিদ্দিকী কণ্ঠ ছাড়লেন, ‘পুবালি বাতাসে...’ শেষ সন্ধ্যার আয়োজনের সূত্রপাত নেত্রকোনার কেন্দুয়ার বাউল সুনীল কর্মকারের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। চোখে দৃষ্টি না থাকলেও অন্তরের আলোকছটা দিয়ে জয় করে নিয়েছেন হাজারো শ্রোতার মন। সুনীল কর্মকারের সঙ্গে ছিলেন শিশুশিল্পী শফিকুল ইসলাম। সবশেষে মঞ্চে ভারতের পবন দাস বাউল, সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সুশীলা রামান ও স্যাম মিলস। ইংল্যান্ডের এ দলটি ভারত ও পাকিস্তানের ভক্তিমূলক ও সুফিবাদী ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলছে। তাদের কণ্ঠে শোনা যায় দারুণ কিছু গান। এ পরিবেশনা শেষ হতেই পর্দা নামে ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় আসরের। তবে এই উৎসবে সাফল্যের সঙ্গে কিছু ত্রুটি ও চোখে ধরা পড়ে অনেকের মতে এখানে দেশীও সঙ্গীতের থেকে বিদেশী সঙ্গীতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলার সঙ্গে ইংরেজীর মিশ্রণ অনেক ক্ষেত্রে বিরক্তির উদ্রেক হয়েছে ...
×