ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক নাটক ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক নাটক  ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’

সাজু আহমেদ ॥ দেশের মঞ্চনাটকে আলোচিত জুটি নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক আর নির্দেশক আতাউর রহমান। এই মঞ্চ জুটির চমৎকার বোঝাপড়ায় আমাদের দেশীয় মঞ্চনাটক হয়েছে সমৃদ্ধ। তবে অতি সম্প্রতি সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণে বাংলাদেশের সংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষরা অভিভাবক এবং একজন প্রথিতযশা নাটককারকে হারিয়েছে। নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ নাটকটি মঞ্চে আনে এ বছর ১৮ মার্চ। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন মঞ্চসারথি আতাউর রহমান। বলাই বাহুল্য, সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনা ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’। নাটকটি আগে টেলিভিশনে প্রচার হয়। দর্শক গ্রহণযোগ্যতার দাবির প্রেক্ষিতে পরে নাটকটি মঞ্চে আনা হয় এবং যথারীতি মঞ্চশিল্প হিসেবে এটা সাফল্য পায়। সেটা যেমন পরীক্ষিত ব্যক্তির নির্দেশনার গুণে তেমনি শিল্পীদের অভিনয়শৈলী এবং উপস্থাপনার নান্দনিকতাতেও। শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে ১৪ নবেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় নাটকটির ১৫তম মঞ্চায়ন হয়। মঞ্চায়নটি উৎসর্গ করা হয় দলের সভাপতি প্রয়াত কলিম শরাফিকে। গত ২ নবেম্বর ছিল কলিম শরাফির মৃত্যুদিবস। তাই নাটক শেষে এ নিয়ে কথা বলার সময় অনেকটাই আবেগাপ্লুত হলেন দলের সহ-সভাপতি, ইউএসএ প্রবাসী নাট্যজন রওশন আরা হোসেন। তাঁর কথা বলার সময় দর্শকরাও আপ্লুত হলেন, যেমনটি আপ্লুত হতে দেখা গেল দলের সভাপতি জামাল উদ্দিন হোসেন, নাটকের নির্দেশক আতাউর রহমানসহ নাটকের কলাকুশলীরা। তারা কলিম শরাফির বর্ণাঢ্য শিল্পী জীবন স্মরণের পাশাপাশি মনে করিয়ে দিলেন যে কলিম শরাফিকে সবাই রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে চিনলেও শুরুর দিকে তিনি ভারতের সম্ভু মিত্রের বিখ্যাত বহুরূপী নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নতুন তথ্য পেয়ে প্রায় সবাই উচ্ছ্বসিত হলেন। পাশাপাশি দেশে না থাকা সত্ত্বে¡ও দলের প্রযোজনাগুলো নিয়মিত মঞ্চস্থ হচ্ছে জেনে দলের সদস্যদের সাধুবাদ জানালেন জামাল উদ্দিন হোসেন এবং রওশন আরা হোসেন দম্পতি। যদিও নাটক মঞ্চায়নকাল দর্শক স্বল্পতা ছিল তবুও সংশ্লিষ্টদের মোটেও হতাশ করেনি। সেটা হওয়া উচিতও নয়। তবে স্বল্পসংখ্যক দর্শকদের কাছেও নাটক বিষয়ে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। কারণ এই সময়ে এসে প্রযোজনাটির ম্যাচিউরিটি প্রত্যাশিত ছিল। সেটা যথাযথ পাওয়া যায় নি। মঞ্চনাটকেও টিভি নাটকের একটি ছাপ রয়েই গেছে। তবে নাটকের প্রায় প্রত্যেকেই অভিনয় পারঙ্গমতা দিয়ে বুঝিয়েও দিয়েছেন যে এটি তারা কয়েকবার করেছেন। এত সমৃদ্ধ একটি প্রযোজনার সেট নিয়ে নির্দেশক নতুন করে ভাবতে পারেন। কারণ নাটকে থানা বোঝাতে সাধারণ চেয়ার টেবিলের পেছনে বড় রকম কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি নাটকে কতটা প্রয়োজন সেটাও ভাবা যেতে পারে। আর নাটকের অন্যতম চরিত্র নজরুল এবং নাটকের গল্পের সময় তুলে ধরতে কবি কাজী নজরুলের ছবির সংযোজন ও ছবি সরিয়ে ফেলার আদৌ প্রয়োজন ছিল কী না ভেবে দেখা যেতে পারে। কোন দৃশ্যে ঠিক কোন সময়ে ছবিটি ব্যবহার করলে গল্পকে অর্থবহ করে তুলবে সেটা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তবে সব কিছুর ওপরে নাটকের অন্যতম প্রাণ নাটকের গল্প এবং শিল্পীদের শক্তি সামন্ত অভিনয়। ১৫তম মঞ্চায়নেও অবশ্য দু-একটি জায়গায় অভিনেতাদের সংলাপ প্রক্ষেপণ একটু নড়বড়ে হয়েছে। তবে তাদের প্রাঞ্জল অভিনয় দর্শকদের শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছে। দৃশ্যান্তর বা দৃশ্য সংযোজনে চমৎকারিত্ব রয়েছে তবে এক্ষেত্রে সময় অপচয় কম হওয়াই ভাল। নাটকের দৃশ্যায়নে নজরুলের গান ও কবিতা নাটককে সমৃদ্ধ করেছে। তবে এবং কোরিওগ্রাফি সংলাপের মতোই আরও গতি দাবি করে। মিউজিক এবং আলোর ব্যবহারে সঞ্চালকের আরও সচেতনতা প্রয়োজন। কারণ প্রযোজনাটি নির্দেশনা গুণ এবং অভিনয়ে এতটাই সমৃদ্ধ যে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিও প্রযোজনার গতিকে ব্যাহত করে। তবে মার্জনীয় ত্রুটি সত্ত্বে¡ও নাটকটি আমাদের দেশীয় মঞ্চ নাট্যাঙ্গনে অন্যতম সমৃদ্ধ প্রযোজনা তা বলাই যেতে যারে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের খ-িত অথচ বাস্তব একটি ইতিহাসকে নতুন করে দর্শকদের সামনে তুলে আনার সাহস দেখাবার জন্য নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বলের কর্মীরা সাধুবাদ পেতেই পারেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নের পটভূমিতে রচিত এ নাটকে দেখানো হয়েছে তৎকালীন একদিকে চলছিল গণহত্যা, অন্যদিকে চলছিল মুক্তিযুদ্ধ। দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে এ দেশের মানুষকে। গ্রেফতার করতে থাকে দেশপ্রেম সন্দেহ করে অনেককেই। এমনি গ্রেফতারকৃত একজনকে নিয়ে এ নাটক। নাটকের গল্পে তুলে ধরা হয়েছে সাধারণ একজন মানুষ নজরুলকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভেবে পাকিস্তানীরা তার ওপর যে অকথ্য অত্যাচার করে, তা ধারণাতীত। অথচ মানুষটি মোটেও যুদ্ধ কিংবা অস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত নয়। সে স্ত্রী, সস্তান আর নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বলেই ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভয়ে তাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সুযোগ বুঝে সেও সেখানেই যাচ্ছিল। আর তখনই পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাকে পাকিস্তানীরা চিহ্নিত করে বিদ্রোহী কবি নজরুল হিসেবে। কিন্তু নজরুল জানে, সে কবি কাজী নজরুল নয়। কোথাও বিরাট ভুল হয়ে গেছে সেনাবাহিনীর। সে তো কবিতা লিখতেই জানেন না! কীভাবে সে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার লেখকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে? নজরুল যে যুদ্ধ করছে, এ যুদ্ধ প্রত্যেক বাঙালীর। যার ভাবনায় এত দিন সংসার, সন্তান, একান্ত ব্যক্তিগত জগতের বাইরে কিছুই ছিল না, সেও বুক চিতিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সামনে বজ্রকণ্ঠে বলে ওঠে ‘জয় বাংলা’। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, অনিশ্চয়তা। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মানুষের গল্পও উঠে আসে কাহিনীতে। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রায়নে সংযুক্ত থেকেছেন চঞ্চল সৈকত, আবদুল্লাহ আল মামুন, জুয়েইরিয়াহ মৌ, সাইদুর রাহমান, শেফালী পারভীন, আবদুল আজিজ, তাজুল ইসলাম রুবেল, মানব সরকার ও আনিসুর রহমান শাহীন।
×