ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবারও রোহিঙ্গা নিধন অভিযান, দলে দলে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

আবারও রোহিঙ্গা নিধন অভিযান, দলে দলে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনীর উপর্যুপরি অভিযান চলছে। এতে প্রাণ হারাচ্ছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে বাড়িঘর। ধর্ষিত হচ্ছে নারী। ফলে বাধ্য হয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা আবারও সীমান্ত অতিক্রম করে পালানোর চেষ্টা শুরু করেছে। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত একসপ্তাহে সেনা অভিযানে শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টাকালে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এ পর্যন্ত ২৮৬ জনকে আটকে দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। এরপরও সীমান্তের বিভিন্ন পথে ফাঁক ফোঁকরে কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে বলে নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের মংডুতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) এর নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা এবং অস্ত্র লুটের ঘটনার পর সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে যে অভিযান শুরু করেছে তা এক কথায় রোহিঙ্গা নিধন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে। মানবাধিকার সংগঠনসহ রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিয়ে কাজ করছে এমন বিভিন্ন সংগঠন ইতোমধ্যেই বলেছে সেখানকার অবস্থা ভয়াবহ। নতুন করে রোহিঙ্গারা অগ্নিগর্ভে নিপতিত হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত চারটি গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে। ফলে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসা বহু রোহিঙ্গা বাপ দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে যে যে পথে পারে পালাচ্ছে। পরিবার-পরিজন ফেলে পুরুষ সদস্যরা দলে দলে দেশান্তরি হচ্ছে। স্ত্রী, পুত্র ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কি অবস্থা তা অনেকের জানা নেই। বিজিবি সূত্রে জানানো হয়েছে, রাখাইন প্রদেশের বিভিন্ন স্থানের অবস্থা যে খুবই নাজুক তা তারা অবহিত হয়েছেন। এ কারণে সে দেশের রোহিঙ্গারা আবারও সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টায় ভিড় জমাচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার পুরো সীমান্ত জুড়ে বিজিবির নজরদারি অতীতের চেয়ে জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহের মধ্যে শতাধিক রোহিঙ্গা সেনা অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে। এর পাশাপাশি প্রায় তিন শ’ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের পর বিজিবি তাদের আটকে দিয়ে পুনরায় ফেরত পাঠিয়েছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার ভোর ও দুপুরে টেকনাফের উনচিপ্রাং এবং খারাং সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে ৮৬ জনকে আটক করা হয়। বিজিবির টেকনাফ ২নং ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক মোঃ আবুজার আল জাহিদ জনকণ্ঠকে জানান, মঙ্গলবার ভোরে উনচিপ্রাং ভিওপি চৌকির নায়েক সুবেদার এনায়েত আলীর নেতৃত্বে জোয়ানদের একটি দল উনচিপ্রাং নাফ নদীর সীমান্ত দিয়ে নৌকাযোগে অনুপ্রবেশকালে ৯ রোহিঙ্গাকে আটক করে। এরপর দুপুরে খারাংখালি ভিওপি চৌকির নায়েক সুবেদার লালমিয়ার নেতৃত্বে জোয়ানরা হোয়াইক্ষ্যং খারাংখালি সীমান্তে দিয়ে নৌকাযোগে অনুপ্রবেশকালে ৭৭ রোহিঙ্গাদের অপর একটি দলকে আটক করতে সক্ষম হয়। বিকেলের আগেই ৮৬ জনকে বিজিবি মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে ২১ পুরুষ, ৪০ নারী ও ২৫ শিশু। আটকের পর এরা বিজিবির কাছে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের উপর সেনা অভিযানের নামে বর্বরতার করুণ বর্ণনা দিয়েছে। গত মঙ্গলবারও ৫ রোহিঙ্গাকে সে দেশের সেনা সদস্যরা বর্বর কায়দায় হত্যা করেছে। সীমান্তের এপার এবং ওপারের ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ অক্টোবর থেকে সেনা অভিযান কঠোর অবস্থানে চলে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। যে কারণে উখিয়ার পালংখালি, রহমতের বিল, দরগাবিল, আমতলি, বালুখালি, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তমব্রু, টেকনাফের নয়াপাড়া, নাইটংপাড়াঘাট, উনচিপ্রাং, লম্বাবিল, উলু বনিয়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, শাহপরীরদ্বীপ, মিস্ত্রিপাড়াঘাট ও ঘোলাপাড়া ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা ব্যাপক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটছেও। ওসব এলাকায় দালাল সিন্ডিকেট সক্রিয়। এর আগে মাসব্যাপী উত্তেজনাকর পরিস্থিতি থাকার পর মিয়ানমারের মংডু অঞ্চল কিছুটা শান্ত হয়ে আসছিল। কিন্তু গত ১০ অক্টোবর থেকে সে দেশের সীমান্ত চৌকিতে অস্ত্র লুটপাট ঘটনার পর চিরুনি অভিযান শুরু করেছে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে। এর ফলেই মৃত্যু, জ্বালাও পোড়াও, ধর্ষণ ও দেশান্তরি হওয়ার ঘটনার জন্ম হলো আবারও। সে দেশের প্রশাসন ধরপাকড় ব্যাপকতর করার নির্দেশ দেয়ার পর সেনা সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিজিপি চৌকিতে হামলা পরবর্র্র্তী রোহিঙ্গা-বিজিপি সংঘর্ষে গত অক্টোবরে নিহত হয় ৩৯ জন। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১০ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য একসপ্তাহ বন্ধ থাকে। ১৬ অক্টোবর থেকে আবার শুরু হয়। কিন্তু ট্রানজিট সুবিধায় দু’দেশের নাগরিকদের চলাচলের উপর যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে, ব্যাঙ্কক থেকে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের পক্ষে কাজ করছে এমন কয়েকটি সংস্থা থেকে জানানো হয়েছে, সেনা সদস্যরা এ পর্যন্ত এক শ’ও বেশি রোিহঙ্গা নারী-পুরুষকে হত্যা করেছে। কো কো লিন নামের আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের এক নেতা বার্তা সংস্থা এপিকে জানিয়েছেন, সেনা অভিযানে গণহত্যা চলছে। এর পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারও জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১৭ সেনা সদস্য রয়েছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার পুলিশ সে দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যুবকদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ঘটনাটি অবশ্যই রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কাজে লাগানো হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
×