ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

খসড়ায় মালিক শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা!

সড়ক পরিবহন আইন ’১৬ চূড়ান্ত হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

সড়ক পরিবহন আইন ’১৬ চূড়ান্ত হচ্ছে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ চালকের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে সর্বোচ্চ সাজা তিন বছর। অপরাধ জামিনযোগ্য ও আপোসযোগ্য। হতাহত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পাবেন কিনা- এ নিয়েও সন্দেহ আছে। এভাবেই সড়ক পরিবহন আইনের চূড়ান্ত খসড়া করতে যাচ্ছে সরকার। সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে গোটা পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সপ্তম। এমন বাস্তবতায় নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে দাবি ওঠেছিল সড়ক পরিবহন আইনে চালকের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার। দাবির সঙ্গে একমত ছিলেন খোদ সড়ক পরিবহনমন্ত্রী নিজেও। যার মাধ্যমে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন তারা। কিন্তু পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করেই শেষ পর্যন্ত আইন করতে যাচ্ছে সরকার। যেখানে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সুপারিশগুলোও উপেক্ষিত রয়েছে। সর্বশেষ খসড়া চূড়ান্ত করার আগে বুধবার পর্যন্ত সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মতামত পড়েছে মাত্র তিনটি। এর মধ্যে একটি বেসরকারী সংস্থার পক্ষেই একাধিক মতামত দেয়া রয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, খসড়া আইনে সকলের মতামতের জন্য ফের সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। মেয়াদ শেষে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে তা উপস্থাপন করা হবে। সেখানে আইন চূড়ান্ত করে তোলা হবে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী যারা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও সড়ক পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন। মূলত তাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেই আইনটি চূড়ান্ত করতে হচ্ছে। তা না হলে আইনে সর্বসাধারণের দাবি এখনও যুক্ত না হওয়ার কারণ ছিল না। প্রায় ৫৬ বছর পর আইনটি নতুন করে করার উদ্যোগ নেয়া হলেও চালকের সাজা থাকছে আগের মতোই। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাত্রী অধিকার সংরক্ষণে নিয়োজিত একাধিক সংগঠন ও বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালকদের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে আমাদের দেশে দোষী কারও শাস্তি নিশ্চিত করতে সমস্যা কোথায়? সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ খসড়া আগের চেয়ে আকারে যেমন ছোট হয়েছে, তেমনি কমেছে সাজা। সড়কে প্রাণহানির বিচার বিদ্যমান আইনের মতোই ১৮৬০ সালের দ-বিধি অনুযায়ী করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ চালকের কারণে মৃত্যু হলেও তিন বছরের বেশি সাজা খাটতে হবে না। চলতি বছরের ১৮ অক্টোবর সড়ক পরিবহন আইন-২০১৬ এর খসড়া মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে দেয় সড়ক পরিবহন বিভাগ। এ বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেন, এটিই চূড়ান্ত খসড়া; তারপরও মতামত নিচ্ছি। যদি কারও কাছ থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মতামত আসে, তবে তাদের সঙ্গে বসা হবে। এছাড়া খসড়াটি আর পরিবর্তন করা হবে না। অনুমোদনের জন্য তা মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। এ খসড়ায় গত ৮ নবেম্বর পর্যন্ত মতামত দেয়ার সুযোগ ছিল, যা আবারও ১৩ দিন বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়। এরপর গত এপ্রিলে কর্মশালায় এর ওপর সবপক্ষের মতামত নেয়া হয়। পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে মতামত তুলে ধরেন। পাশাপাশি ওয়েবসাইটেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সরাসরি দাবি ছিল, আইনে যেন কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। এ বিষয়টির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল আয়োজিত বৈঠকে। মূলত নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ নেয়ার জন্য বৈঠকের আয়োজন ছিল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তবে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি ছিল সড়কে অপরাধের মামলা যেন জামিনযোগ্য ও আপোসযোগ্য করা হয়। বিআরটিএ খসড়ার বিভিন্ন ধারা সংযোজন ও বিয়োজনের জন্য ১১৭ সুপারিশ করে। সচিব জানান, এর ভিত্তিতেই খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। নাগরিক সমাজ কঠোর সাজার দাবি জানালেও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে সড়কে প্রাণহানি ঘটালে বা কাউকে গুরুতর আহত করলে এর বিচার ১৮৬০ সালের দ-বিধির ৩০৪(খ) ধারায় করার বিধান রাখা হয়েছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের জেল ও অর্থদ-ের কথা আছে। এ প্রসঙ্গে এমএএন ছিদ্দিক বলেন, স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকেই এ প্রস্তাব এসেছে। মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে মাত্র। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, দ-বিধি মূল আইন। তাই সড়ক আইনে এর পরিপন্থী কিছু রাখা হয়নি। তারপরও মন্ত্রিসভা কিংবা সংসদের যদি মনে হয় সাজা কমছে, তবে তারা বাড়াতে পারবে। এর আগেও তিন দফা সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়। তবে তার কোনটিই আইনে পরিণত হয়নি। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বারবার কঠোর সাজার দাবি তোলা হলেও খসড়াগুলোয় ক্রমান্বয়ে কমানো হয়েছে সাজার প্রস্তাব। মন্ত্রণালয়ের ভাষায়, চূড়ান্ত খসড়ায় ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে প্রণীত খসড়া থেকে গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু ধারা বাদ দেয়া হয়েছে। এমনকি বাদ পড়েছে ২০১৩ সালে মন্ত্রণালয়ের গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির বিভিন্ন সুপারিশ। খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও একাধিকবার বলেছেন, তিনিও চান কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন হোক, যাতে চালকরা সাজার ভয়ে আইন অমান্য না করেন। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ২০১১ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন ও ট্রাফিক আইনের খসড়ায় বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সাজা ১০ বছর কারাদ- করার সুপারিশ করা হয়। পরে ওই খসড়া পর্যালোচনায় ২০১৩ সালে গঠিত কমিটির সুপারিশেও আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়। তবে সাজা কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কঠোর সাজার দাবি জানানো হলে এর বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে আন্দোলনে নামে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। আশির দশকে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনে সড়কে মৃত্যুর সাজা ১৪ বছর থেকে তিন দফায় কমিয়ে তিন বছর করা হয়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব চন্দন কুমার দে জনকণ্ঠকে বলেন, খসড়া আইনে মতামত দেয়ার জন্য সময় বাড়িয়ে ২১ নবেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। সকলের মতামত দেয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে সময় বাড়ানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মতামত দেয়া শেষে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আলোচনা শেষে তা চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের দাবি সময় নিয়ে আইনটি চূড়ান্ত করা। আমরাও তাই চিন্তা করছি। সবার সঙ্গে কথা বলে আইনটি জনবান্ধব করার চেষ্টা হচ্ছে। আইনের খসড়ার ৫৩(১) ধারার অধীনে প্রণীত তফসিলের ৫৪(১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘বিপজ্জনকভাবে অথবা বেপরোয়াভাবে মোটরযান চালানোর কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি ঘটলে বা গুরুতর আহত হলে এ সংক্রান্ত অপরাধসমূহ দ-বিধি ১৮৬০ অনুযায়ী অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।’ দায়ী চালকের লাইসেন্সের ২০ পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়। ১৮৬০ সালের দ-বিধি ৩০৪(খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সহিত জনপথে যান বা অশ্ব চালাইয়া নরহত্যা নহে এমন মৃত্যু ঘটায়, সেই ব্যক্তি কারাদ-ে যাহার মেয়াদ তিন বছরের পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদ-ে বা উভয় দ-ে দ-িত হইবে। এছাড়াও সড়কের ডিজাইন বা নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনার দায় সড়ক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও তদারককারী সংস্থার ওপর বর্তাবে।’ তিন বছরের সাজার বিধানে হতাশা প্রকাশ করেন জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলেই চালকের ১৪ বছরের জেল চাই না। সড়কের কারণে কিংবা পথচারীর ভুলেও দুর্ঘটনা হতে পারে। আমাদের দাবি ছিল, চালক দায়ী হলে সে ক্ষেত্রে কঠোর সাজার বিধান রাখা, যাতে চালকরা শাস্তির ভয়ে হলেও যেন সতর্কভাবে গাড়ি চালান। মন্ত্রীও একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।’ তিনি অভিযোগ করেন, খসড়াটি আইনে পরিণত হলে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের স্বার্থরক্ষা ছাড়া আর কিছুই হবে না। খসড়ায় সড়ক সংক্রান্ত অপরাধকে জামিনযোগ্য ও আপোসযোগ্য করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা পুলিশের অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট সমমর্যাদার কর্মকর্তা দুইপক্ষের মধ্যে মীমাংসা করে দিতে পারবেন। বড় অপরাধে (তিন মাসের কারাদ-ের উর্ধে) বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবে পুলিশ। ২০১১ সালে ‘সড়ক পরিবহন ও ট্রাফিক আইন’ নামে খসড়ায় ২২ অধ্যায় ও ৩৭২ ধারা ছিল। ২০১৩ সালে গঠিত কমিটি তা কমিয়ে ১৫ অধ্যায় ও ২৪২ ধারার খসড়া প্রণয়ন করে। সর্বশেষ খসড়ায় আইনটি ১৩টি অধ্যায় ও ৭৩ ধারায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আগের খসড়ায় পেশাদার চালকের সর্বোচ্চ বয়স ৬০ নির্ধারণ করা হয়েছিল। চূড়ান্ত খসড়ায় বয়সের বাধা বাতিল করা হয়েছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম যে কেউ লাইসেন্স পাবে। ভুয়া লাইসেন্স কিংবা সমিতির দেয়া ‘লাইসেন্স’ ব্যবহার করে গাড়ি চালানোর শাস্তি এক বছরের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদ-ের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে চূড়ান্ত খসড়ায়। গাড়ির আকার পরিবর্তন, যেমন- আসনসংখ্যা বৃদ্ধি, এ্যাঙ্গেল, হুক সংযোজনের জন্য এক বছরের জেল অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে তিন মাসের কারাদ- ও ১৫ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর সাজা এক বছরের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। চালকের পাশাপাশি কন্ডাক্টরদের লাইসেন্স নেয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। চালক ও কন্ডাক্টরের নিয়োগপত্র দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চালকদের লাইসেন্সের বিপরীতে ১০০ পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। আইন ভঙ্গ করলে শাস্তির পাশাপাশি পয়েন্ট কাটা হবে। এভাবে পুরো পয়েন্ট কাটা হয়ে গেলে লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হবে। লাইসেন্স বাতিল হলে এক বছর পর আবারও লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন চালক। তবে দু’বার লাইসেন্স বাতিল হলে আর কখনই লাইসেন্স পাবেন না ওই চালক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আইনে সাধারণ মানুষের দাবি উপেক্ষিত হলে তা খুব একটা কার্যকর হবে না। তাই আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই দেশের মানুষের প্রত্যাশা যেন প্রতিফলিত হয়- এ দাবি জানান তিনি। অনলাইনে মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। সংস্থাটির মতামত ও সুপারিশে বলা হয়- ‘কেস প্রজেক্টের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রস্তুতকৃত সড়ক পরিবহন সংক্রান্ত খসড়া আইনের অধিকাংশ মৌলিক বিষয়ই বর্তমান ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৬’ এর খসড়া আইনটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া খসড়া আইনটিতে মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩ আইনের অনেকাংশে পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়েছে, যা দ্বারা নতুন অবস্থা ও পরিস্থিতিকে বিবেচনা ও মোকাবেলা সম্ভব হবে না। আইনটিতে মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ এর প্রধান সীমাবদ্ধতাসমূহকে চিহ্নিত করে তা দূর করার জন্য বা মোকাবেলার জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এছাড়া আইনে সড়ক বা মহাসড়কে মোটরযান নির্ধারিত গতিতে চলবে, কিন্তু তা পর্যবেক্ষণের বা মনিটরিংয়ের বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। সুপারিশ-গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিংয়ের বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, বা কে মনিটরিং করবে, তা আইনে উল্লেখ করতে হবে। ধারা-৪২ অনুযায়ী, অনুমোদিত শব্দমাত্রার কথা বলা আছে কিন্তু তা পর্যবেক্ষণের বা মনিটরিংয়ের বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। ধারা-৪৭ নম্বরে মোটরযান ও উহাতে যাতায়াতকারী সকল যাত্রীর এবং তৃতীয় পক্ষের জীবন ও সম্পদের বীমা করার কথা বলা আছে। কিন্তু দুর্ঘটনাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির উল্লেখ নেই। ধারা ৫৩(১)-এ শুধুমাত্র এই আইনের অধীন অপরাধের দ-ের বিষয়ে বলা আছে। কিন্তু এ আইনের অধীন অপরাধের শিকার বা দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আলোচিত হয়নি। দ-বিধি ১৮৬০ তে বর্ণিত উল্লেখিত সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহ এ আইনে সংযুক্ত না থাকায় দ- প্রদানে অনেক জটিলতা দেখা দেয়। মোটরযান চালনায় নিয়ম না মানার কারণে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আইনের খসরা চূড়ান্ত করতে অনেক সময় নেয়া প্রয়োজন। তিনি আইনের অসঙ্গতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, বিআরটিএ বলছে সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত যানবাহনের সংখ্যা ২৭ লাখ। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে চালকের সংখ্যা ৬০ লাখ। বৈধ চালকের সংখ্যা ৬০ লাখ। যানবাহনের অনুপাতে চালকের সংখ্যা পূরণে আইনে সঠিক কোন দিক-নির্দেশনা নেই। অথচ উন্নত দেশগুলোতে চালক তৈরিতে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আইনে প্রতি ধাপে ধাপে চালকের সাজা কমানো হয়েছে। বাস্তবতা হলো আইনে চালকের বিরুদ্ধে কঠোর সাজা নিশ্চিত করার কথা বহুবার বলেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। কিন্তু খসড়া প্রস্তাবে মন্ত্রীর ইচ্ছা বা প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। আইনে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, পরিবহন মালিক শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য ও আধিপত্যের কারণে আইনে চালকের শাস্তির বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। সরকারের মধ্যে পরিবহন সেক্টরের যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেনÑ চালকদের কঠোর শাস্তি যেন না হয় এ ব্যাপারে তাদেরও হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে আমরা মনে করি। সব মিলিয়ে খসড়া আইনটি মোটেও জনবান্ধব হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
×