ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

উপদ্রুত অঞ্চলে হবে পথনাটক

নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ালে শিল্পী বড় হয়, মহিমান্বিত হয় শিল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ালে শিল্পী বড় হয়, মহিমান্বিত হয় শিল্প

মোরসালিন মিজান ॥ পথনাটক নাটকের একটি স্বতন্ত্র ধারা। প্রসেনিয়াম আর্চের বাইরে এসে নাটক করা। অপেক্ষাকৃত সরল উপস্থাপনা সাধারণের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে যায়। পথনাটকের এটি বলা চলে দারুণ এক শক্তি। সারা বছরই কম বেশি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তবে এখন ভরা মৌসুম। বুধবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এবারের মৌসুমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলো। একই দিন ছিল পথনাটক অভিনয় মৌসুমের ২৫ বছর পূর্তির আনুষ্ঠানিকতা। যতদূর তথ্য, পথনাটককে সাধারণ মানুষের আরও কাছে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯২ সালে মহাকাল, ঢাকা নাট্যম ও দেশ নাটক সমন্বিতভাবে পথনাটকের প্রদর্শনী শুরু করে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথে ‘বাংলাদেশের পথনাট্য চর্চারত নাট্যদলসমূহ’ শিরোনামে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রতি শুক্রবার বিকেলে চলে পথনাটকের প্রদর্শনী। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আত্মপ্রকাশ করে পথনাটক পরিষদ। এরপর থেকে প্রতিবছর শীতকালে অনুষ্ঠিত হতে থাকে বিশেষ পথনাটক প্রদর্শনী। এবার রজতজয়ন্তী উৎসব। বলার অপেক্ষা রাখে না, পথনাটক সমাজের অসঙ্গতি অন্যায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলে। সেই কবে কোন্ কাল থেকে বলে আসছে। অথচ এখনও কাটেনি আঁধার। অশুভ অপশক্তি বিগত দিনের অর্জনগুলোও গ্রাস করতে চাইছে। হামলা হচ্ছে মন্দিরে। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ভাংচুর করা হচ্ছে। এমনকি সাঁওতালদের শেষ আশ্রয় পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে পুলিশের উপস্থিতিতে। আদরের বোনটি, শিশুকন্যাটি ধর্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থায় পথনাট্যের উৎসব প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে যেন। আয়োজক পরিষদের সেøাগানÑ জঙ্গীবাদ, নারী ও শিশু নির্যাতন/রুখবে এবার জনগণ। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বেলুন উড়িয়ে পথনাটক মৌসুমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আলোচনা করেন পথনাটক পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম মাহমুদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ। পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরার সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক আহাম্মেদ গিয়াস। বক্তারা বলেন, পথনাটক আজকের নাটক। পথনাটক ভবিষ্যতের কথা বলে না। খুব গভীর দর্শন সেখানে প্রচার করা হয় না, যা ঘটছে সেটাই তাৎক্ষণিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। শিল্পচর্চায় পথনাটক একটি আঙ্গিক হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। পথনাটক মানে পথের মানুষের নাটক। পথের বিষয়। পথের পরিবেশ। আবহটা তৈরি করে প্রকৃতি। মানুষ প্রকৃতির অংশ হিসেবে সেখানে তার কথাটি বলার চেষ্টা করে। পরে জীবনের সঙ্গেই নাটকটি সংযুক্ত হয়ে যায়। বক্তারা বলেন, জীবনের সবচেয়ে বড় মঞ্চ হচ্ছে পথ। পথেই সূর্যসেনের জন্ম; বিধু সাঁওতাল, নূর হোসেনদের পাওয়া। আলোচনায় ঘুরে ফিরেই আসে সাম্প্রতিক সময়ের বেদনাদায়ক ঘটনাবলী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর আক্রমণের কথা তুলে ধরে বক্তারা বলেন, এসব ঘটনায় স্বজনের কাছে আমাদেরই নতজানু হতে হয়। পরাজিত হতে হয়। বারবার। কখনও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে ছোট হতে হচ্ছে। কখনও বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে নত হচ্ছি। আদিবাসীদের কাছে পরাজিত হতে হচ্ছে। নারী ও শিশুর ওপর বর্বর আক্রমণ ও ধর্ষণের কথা তুলে ধরেন নাট্যকর্মীরা। চলমান অবস্থাকে ‘ছ্যাড়াবেরা’ উল্লেখ করে বক্তারা প্রতিকার দাবি করেন। বক্তারা বলেন, নাটক নিয়ে উপদ্রুত জনপদে যাওয়া জরুরী। নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ালে শিল্প মহিমান্বিত হয়। শিল্পী বড় হয়। মন্ত্রীও অবস্থা স্বীকার করে নেন। দুঃখ করে বলেন, পথনাটক ২৫ বছর ধরে যে সমস্যার বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছে আজ এত বছর পরও একই বিষয়ে কথা বলতে হচ্ছে। সমাজের মানবিক সমস্যা, মূল্যবোধের সমস্যা এখনও আছে। আমরা যে মুক্তিযুদ্ধ যে বাঙালী জাতীয়তাবাদের কথা বলি, সেখানে বেশি অগ্রসর হওয়া যায়নি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে শুরু হয় মূল আয়োজন। প্রথমেই চমৎকার একটি প্রতিবাদী পরিবেশনা নিয়ে আসে প্রাচ্যনাট। সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদ করেন শিল্পীরা। প্রতিবাদ যেমন ছিল তেমনি ছিল শিল্প সুন্দর। বেশ উপভোগ করেন দর্শকরা। পরে পরিবেশিত হয় হত্যা-ধর্ষণবিরোধী পথনাটক ‘শিকারী’। বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের নিজস্ব প্রযোজনা। রচনা করেছেন মান্নান হীরা। নির্দেশক নাসিরউদ্দীন ইউসুফ। এরই মাঝে নাটকটি বিশেষ আলোচিত হয়েছে। ধর্ষণবিরোধী নাট্যায়োজন খুব সহজেই অধিকার করে নেয় দর্শক হৃদয়। বেদনায় ডুবায় যেমন, তেমনি আত্মচেতনাকে জাগিয়ে দেয়। প্রতি শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হবে পথনাটকের প্রদর্শনী। চলবে ১ মে ২০১৭ পর্যন্ত।
×