ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসাধীন দুই সাঁওতাল জেলহাজতে

সাঁওতালরা সরকারী ত্রাণ নিয়েছে, শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফিরেছে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

সাঁওতালরা সরকারী ত্রাণ নিয়েছে, শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফিরেছে

আবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা ॥ গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে পুলিশ-সাঁওতাল সংঘর্ষের বিষয় এবং সাঁওতালদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মঙ্গলবার ঢাকায় সাঁওতাল নেতৃবৃন্দের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে সাঁওতালদের পুনর্বাসন ও নানা অভিযোগ সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এরকম আশ্বাস পেয়েই সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার এলাকার মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামের সাঁওতালরা বুধবার জেলা প্রশাসন বরাদ্দকৃত ত্রাণ গ্রহণ করেছে। জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ এবং আদিবাসী ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির কোষাধ্যক্ষ রাফায়েল হাসদা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত ১৪ নবেম্বর জেলা প্রশাসন বরাদ্দকৃত ১৫০ প্যাকেট ত্রাণের ট্রাক নিয়ে গিয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম, সাপমারা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বর আব্দুর রউফ দিনভর অপেক্ষা করে ফিরে আসেন। সাঁওতালদের দাবি ছিল তাদের পুনর্বাসন, বাপ-দাদার জমি ফেরতসহ সুনির্দিষ্ট কতিপয় দাবি-দাওয়া বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তারা সরকারী কোন ত্রাণ গ্রহণ করবেন না। বুধবার পারস্পরিক আলোচনা ও আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামের ১৫০ পরিবার সাঁওতাল নেতা রাফায়েল হাসদার তত্ত্বাবধানে ত্রাণ গ্রহণ করে। ত্রাণ বিতরণ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ সাঁওতালদের এই জরুরী ত্রাণ সহায়তা হিসেবে ৬ মে. চাল এবং ৫০ হাজার টাকা, ৩শ’ কম্বল বরাদ্দ করেন। প্রতিটি পরিবারের জন্য ২০ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, ১ লিটার সোয়াবিন তেল, লবণ, ১ কেজি আলু ও দুটি করে কম্বল বিতরণ করা হয়। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, গৃহহীন ছিন্নমূল সাঁওতাল পরিবারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে গোবিন্দগঞ্জের কাটাবাড়ি এলাকায় ১০ একর খাস জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। যেখানে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়া হবে। তদুপরি ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল পরিবারদের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বিশেষ উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যাতে তারা আর্থিক ও সামাজিকভাবে উন্নত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এছাড়া ৬ নবেম্বর সাঁওতাল পুলিশ সংঘর্ষ এবং উচ্ছেদ অভিযানের সময় ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল পরিবারগুলোর বাড়িঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সময় শিক্ষার্থীদের বই ও অন্যান্য উপকরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তদুপরি ভয়ে এবং বই পুস্তক না থাকায় সাঁওতালদের সন্তানরা ঘটনার পরদিন থেকেই স্কুল যাওয়া থেকে বিরত থাকে। প্রশাসন, সাঁওতাল নেতা ও স্কুল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত বুধবার সাহেবগঞ্জ ইক্ষু ফার্ম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৫ শিক্ষার্থী আসে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৫ জনকেই প্রয়োজনীয় বই, খাতা ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ওই বিদ্যালয়ে সাঁওতাল পরিবারের ৬০ শিক্ষার্থী রয়েছে। পরবর্তীতে বাকি ২৫ শিক্ষার্থীও বিদ্যালয়ে যাবে বলে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যথারীতি তাদেরও বই ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ প্রদান করা হবে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের আন্তরিক উদ্যোগ এবং সাঁওতাল নেতাদের সহযোগিতায় ঘটনার ১০ দিন পর জয়পুর ও মাদারপুর এলাকায় সাঁওতালদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। জয়পুরের রুমিলা কিসকু, রবিন হাসদা, সরেন টুডুসহ কয়েক সাঁওতালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হলেই তারা এই এলাকায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে রাফায়েল হাসদা বলেন, সাঁওতালদের বাপ-দাদার জমি ফেরত দেয়ার কথা বলে ভূমি উদ্ধার কমিটির নেতা সেজে যারা তাদের কাছে চাঁদা নিয়ে প্রতারণা করেছে সেই সমস্ত চিহ্নিত দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এই এলাকার সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি ফিরে আসবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। চিকিৎসাধীন দুই সাঁওতাল কারাগারে ॥ হামলা ও সরকারী কাজে বাধা প্রদান মামলায় পুলিশের তত্ত্বাবধানে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ২ সাঁওতাল সুস্থ হওয়ার পর আদালতের নির্দেশ মোতাবেক তাদের গাইবান্ধা জেলা কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তারা হলেন দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার কুচাপাড়ার শাকিলা কিসকুর পুত্র বিমল কিসকু ও রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানীপাড়ার মৃত জঙ্গা সরেনের পুত্র চরণ সরেন। এছাড়া উচ্ছেদ অভিযানে আহত দ্বিজেন টুডু নামে অপর এক আহত সাঁওতালকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পুলিশের তত্ত্বাবধানে ঢাকার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। কুড়িয়ে পাওয়া কার্তুজ ॥ হামলার ঘটনার পর ইক্ষু খামার এলাকায় এক সাংবাদিক একটি অবিস্ফোরিত তাজা গুলি কুড়িয়ে পেয়ে গুলিটি গোবিন্দগঞ্জ থানায় জমা দেন। এ থেকে ধারণা করা হয় বহিরাগত হামলাকারীদের কেউ কেউ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েও এসেছিল। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কার্তুজটি মরিচা পড়া ছিল বলে তা বিস্ফোরিত হয়নি। তবে এ ধরনের কার্তুজ পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে না বলেও পুলিশ সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়নি ॥ মিল কর্তৃপক্ষের আবেদনক্রমে পুলিশ, র‌্যাবসহ যৌথবাহিনী কোন নীতিমালা না মেনেই বেআইনীভাবে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করেছে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সত্য নয় বলে মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনিকলের এমডি আব্দুল আউয়াল জানান। তিনি বলেন, আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাইনি। প্রকৃত পক্ষে ৬ নবেম্বর সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার থেকে আখ বীজ কাটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্যে। সুতরাং চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীরা পুলিশের সহযোগিতায় সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন লাগানোর বিষয়টিও সঠিক নয়। সাঁওতালরাই তীর-ধনুক নিয়ে বহিরাগত লোকজনদের সহযোগিতায় কর্তব্যরত চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের ওপর আকস্মিকভাবে হামলা চালায়। এই হামলা প্রতিহত করতে গিয়েই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য, গত ৬ নবেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের আখের বীজ কাটাকে কেন্দ্র করে খামারের জমি দখলকারী আদিবাসী সাঁওতালের সঙ্গে শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এ সময় সাঁওতালদের নিক্ষিপ্ত তীর-ধনুকের আঘাতে ১০ পুলিশ তীরবিদ্ধসহ ৩০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানায় ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত সাড়ে ৩শ’ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে।
×