ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মায়ের দীর্ঘশ্বাস ভরা উক্তি, শেষ আবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে

বুশরা কি কখনও ছিল? ॥ ১৬ বছর আদালত পাড়া ঘুরে এখন প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

বুশরা কি কখনও ছিল? ॥ ১৬ বছর আদালত পাড়া ঘুরে এখন প্রশ্ন

আরাফাত মুন্না ॥ ১৬ বছর আগে বুশরাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, পরে খুনও। এটাই স্বীকৃত। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ধর্ষণের পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সিটি কলেজ ছাত্রী বুশরাকে। নিম্ন আদালত তিন আসামির মৃত্যুদ- ও এক আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছিল। হাইকোর্টও এক আসামির মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবন কারাদ- বহাল রাখে। তবে মঙ্গলবার সুপ্রীমকোর্ট এই মামলার সব আসামিকেই খালাস দিয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের এই রায়ের পর জনমনে কয়েকটি প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটেছে। আসলেই কি খুন করা হয়েছিল বুশরাকে, নাকি চরিত্রটিই কাল্পনিক। ২০০০ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর ৩ নম্বর পশ্চিম হাজীপাড়ার বাসায় আসলে কি ঘটেছিল? খুন যদি হয়েও থাকে তাহলে বুশরার খুনী কারা? এসব প্রশ্নই ঘুরে ফিরে সামনে আসছে বারবার। বুশরার মায়ের শেষ আবেদন এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। কেউ কেউ আবার বলছেন, বুশরাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। তাহলে এই মামলায় যে দুই আসামিকে হাইকোর্টে সাজা দেয়া হয়েছিল তারাতো স্বামী-স্ত্রী। আর স্বামী-স্ত্রী মিলে কি করে ধর্ষণ করে হত্যা করে? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতির ফলে মামলাটির এই অবস্থা। এখন সুপ্রীমকোর্ট যদি নতুন করে মামলাটির তদন্ত করতেও বলে তবে দীর্ঘ ১৬ বছর পর এই ঘটনার কোন আলামতই হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঘটনার মূল আসামিরাই হয়তো নিজেদের এই ঘৃণ অপরাধের কথা ভুলে গেছে। বুশরা হত্যার বিচার হয়ত আর মিলবে না। আইনজ্ঞরা জানালেন, এই মামলার ভবিষ্যত কি, তা সুপ্রীমকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পরই বোঝা যাবে। সুপ্রীমকোর্ট কি নির্দেশনা দেন তার ওপরই এখন সব কিছু নির্ভর করছে। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে রিভিউর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলেই গণমাধ্যমকর্মীদের জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল খোন্দকার দিলীরুজ্জামান বলেন, বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে শাস্তি দিয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত সেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণযোগ্য মনে করেনি। তিনি বলেন, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে রিভিউর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মঙ্গলবার রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এখানে পয়েন্ট অব ল’ ছিল। বাদীপক্ষের মামলা হলো কোন দুর্বৃত্ত তার মেয়েকে গভীর রাতে ধর্ষণ করে খুন করেছে। এর কোন চাক্ষুষ সাক্ষী নেই। একজন বলেছে, এদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল বাড়ি নিয়ে। এ কারণে এরা তার মেয়েকে হত্যা করেছে, এটি সন্দেহ। এটি পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য। পারিপার্শ্বিক সাক্ষের ওপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট তাদের সাজা বহাল রেখেছিল। আপীল বিভাগ বলেছে, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে যে ধরনের সাক্ষ্য আইনগতভাবে দরকার, সে সাক্ষ্য এখানে নেই।’ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এখন রায়ের অনুলিপি পাওয়া সাপেক্ষে ৩০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ করার সুযোগ আছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে কি না, তা পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে বোঝা যাবে। আপীল বিভাগের রায়ের পর এই মামলায় পুনর্বিচার ও পুনঃতদন্তের কোন সুযোগ নেই। রাষ্ট্র যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করিয়েছে, তারা কেউ দোষী সাব্যস্ত হলো না। কিন্তু এটি স্বীকৃত যে বুশরা খুন হয়েছে। এখন পূর্ণাঙ্গ রায়ই সব প্রশ্নে উত্তর দেবে। বুশরা হত্যার ঘটনা এবং বিচার ॥ সিটি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের সম্মান শ্রেণীর ছাত্রী রুশদানিয়া ইসলাম বুশরা ২০০০ সালের ১ জুলাই রাতে ৩ নম্বর পশ্চিম হাজীপাড়ার বাসায় খুন হন। ওই ঘটনায় বুশরার মা লায়লা ইসলাম পরদিন রমনা থানায় মামলা করেন। পরে ওই বছরই আরেকটি সম্পূরক অভিযোগ দাখিল করেন বুশরার মা। এতে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক এম এ কাদের (বুশরার খালুর সৎভাই), কাদেরের স্ত্রী রুনু কাদের এবং কাদেরের শ্যালক মোঃ শওকত আহমেদ ও কবির আহমেদকে আসামি করা হয়। মামলায় ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এতে কাদেরের শ্যালিকা কানিজ ফাতেমা ও কাজের মেয়ে সুফিয়ার নাম আসে। মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ২০০৩ সালের ৩০ জুন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রায় দেন। রায়ে কাদের, শওকত ও কবিরকে মৃত্যুদ- এবং রুনু কাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের করা আপীল এবং আসামিদের ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদ- অনুমোদনের আবেদন) ওপর হাইকোর্টে শুনানি হয়। ২০০৭ সালের ২৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে এম এ কাদের ও তার স্ত্রী রুনু কাদেরের সাজা বহাল রাখা হয়। অপর দুজন (শওকত ও কবির) খালাস পান। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ এবং দ-িত ব্যক্তিরা পৃথক আপীল করেন। এসব আবেদনের ওপর শুনানি শেষে মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করেন সর্বোচ্চ আদালত। বুশরা কি কখনও ছিল মায়ের প্রশ্ন ॥ মঙ্গলবার সুপ্রীমকোর্টের রায় শোনার পর বুশরার মা ও মামলার বাদী লায়লা ইসলাম বললেন, আমার মেয়েটা খুন হয়ে ঘরে পড়ে রইল, মামলা হলো। আমি ১৬ বছর ধরে আদালতে ঘুরলাম। জজকোর্ট, হাইকোর্ট সাজা দিল। আজ জানলাম, সর্বোচ্চ আদালতে তারা খালাস পেয়েছে। তাহলে বুশরাকে খুন করল কে? আমি কী বলব? বুশরা কি কখনও ছিল? আমার তো মনে হয়, বুশরা নামে কখনও কেউ ছিলই না। লায়লা ইসলাম জানালেন, বুশরার বাবা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলেন। মেয়ে মারা যাওয়ার পর সেই শোকে আর কথা বলতেন না। ২০০৩ সালে হঠাৎ একদিন বুকে ব্যথা, এরপর মারা গেলেন তিনি। তখন থেকেই একা লড়ে যাচ্ছি। ঘটনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সবকিছুই পাঁচ কাঠা জমির ওপর একটি বাড়ি কেন্দ্র করে। বাড়িটির মালিক তার বড় বোনের প্রয়াত ম্যাজিস্ট্রেট স্বামী আবদুস সামাদ। আর মামলার প্রধান আসামি এম এ কাদের হলেন এম এ সামাদের সৎভাই। ১৯৯৬ সালে নগর আওয়ামী লীগের নেতা এম এ কাদের হঠাৎ করেই মহানগর জরিপে এ সম্পত্তিটি নিজের নামে লিখে নেন। সেই থেকে সম্পত্তি নিয়ে ১৭টি মামলা হয়েছে। যার ১৬টির রায় হয়েছে এম এ সামাদের পক্ষে। সবাইকে এ বাড়ি থেকে তাড়াতেই বুশরাকে খুন করা হয় বলে তিনি মনে করেন। লায়লা ইসলাম বলেন, এখন আমার কিছু বলার নাই, আমি শুধু বিচার চাই। দেশের মানুষকে বলি তারা যেন আমার পাশে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী সেই সময়ে (২০০০ সালে) আমাকে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি আপার (প্রধানমন্ত্রীর) কাছে করজোড়ে মিনতি করি, তিনি যেন আমার মেয়ে হত্যার ন্যায়বিচারের জন্য কিছু করেন।
×