ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

সবার ওপরে সাব্বির

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

সবার ওপরে সাব্বির

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর পর থেকেই একটা তকমা লেগে গিয়েছিল সাব্বির রহমানের নামের সঙ্গে। তিনি টি২০ স্পেশালিস্ট। এর কারণ ব্যাট হাতে তার আগ্রাসী মনোভাব আর মারদাঙ্গা আগুনে মেজাজ। বোলারদের পিটিয়ে তুলোধুনো করার মন্ত্রটা জপতে জপতেই যেন ব্যাট চালান। অথচ সেই ব্যাটসম্যানের টি২০ ক্রিকেটের ক্যারিয়ারে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার না থাকলে চলে? ২০১০ সাল থেকে টি২০ ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেছেন। তবে আন্তর্জাতিক টি২০ শুরুর মাত্র দুই বছর পেরিয়েছে। ২৬টি আন্তর্জাতিক আর ৮৬টি ঘরোয়া টি২০ খেলেছেন। অবশেষে সেঞ্চুরির দেখা পেলেন। এবার বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের (বিপিএল টি২০) চতুর্থ আসরে তিনি বরিশাল বুলসের বিরুদ্ধে ৬১ বলে ১২২ রানের এক টর্নেডো ইনিংস উপহার দিলেন। আর এটি ছিল বিপিএল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। দিনটা ছিল সাব্বিরের। কিন্তু প্রথমে মুশফিকুর রহীম ঝড়ো ব্যাটিং করেই যেন ২৪ বছর বয়সী সাব্বিরের মেজাজটাকে উসকে দিলেন। এরপর ব্যাট হাতে নেমে মুশফিককেই শুধু নয়, ছাড়িয়ে গেলেন সাব্বির আরও অনেককেই। মুশফিক ৫২ বলে ৮১ রানের অপরাজিত একটি ইনিংস খেলেন বরিশাল বুলসের হয়ে। তার মোক্ষম জবাব আরও বিধ্বংসী হয়েই দিলেন রাজশাহী কিংসের সাব্বির। চলতি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল টি২০) আসরের প্রথম সেঞ্চুরিটা আসলো তার ব্যাট থেকে। মাত্র ৫৩ বলেই সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর ১২২ রান করে ফিরে গেয়েছেন সাজঘরে। এটি ছিল বিপিএল ইতিহাসের নবম শতক। তবে বিপিএলের চতুর্থ দ্রুততম শতক এটি। আর বাংলাদেশের পক্ষে বিপিএলে তৃতীয় সেঞ্চুরি। এর আগে বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের মধ্যে শুধু শাহরিয়ার নাফীস ও মোহাম্মদ আশরাফুলই হাঁকিয়েছিলেন সেঞ্চুরি। তবে সাব্বিরের ১২২ বিপিএলের রেকর্ডে সেরা। কারণ এটিই এখন পর্যন্ত বিপিএল ইতিহাসে কোন ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। আর নাফীস ও আশরাফুলের চেয়ে দ্রুতগতির সেঞ্চুরি। এবার বিপিএলের চতুর্থ আসরের শুরু থেকেই লো স্কোরিং ম্যাচ হয়েছে। টি২০ ক্রিকেটের সঙ্গে মানানসই কোন বিধ্বংসী ইনিংস দেখা যায়নি। তাই যেন চার-ছক্কা দেখার জন্য দর্শকদের মাঝে যে উন্মাদনা, সেটাই যেন কমে যাচ্ছিল। দর্শক উপস্থিতিও হ্রাস পাচ্ছিল ক্রমেই। তবে ক্রিকেটাররা বারবার দাবি করছিলেন উইকেটের কোন সমস্যা নেই। স্পোর্টিং উইকেট গড়া হয়েছে বিপিএলের জন্য, যেখান থেকে ব্যাটসম্যান এবং বোলার উভয়ে সমান সুযোগ তুলে নিতে পারে। তবে সেটার বাস্তব কোন দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। ব্যাটসম্যানরাই ব্যর্থ হয়েছেন এবং উইকেটের আচরণে মনে হয়েছে রান করা অনেক কঠিন এখানে। তবে বিপিএলের ষষ্ঠ দিনে সবকিছুই যেন পাল্টে দিলেন মুশফিক। ব্যতিক্রম দেখা গেল। প্রথম ব্যাট করে রাজশাহী তুললো ৪ উইকেটে ১৯২ রানের বিশাল সংগ্রহ। সেটা বড় হলো মূলত মুশফিকুর রহীমের দুর্ধর্ষ একটি ইনিংসের কল্যাণেই। বিপিএল শুরুর আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, টি২০ ক্রিকেটে যে মেজাজে খেলেন তিনি সেই স্বরূপে ফিরতে চান। প্রথম থেকেই কথার সঙ্গে কাজের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। প্রথম ম্যাচে অর্ধশতক (৩৬ বলে ৫০*), পরের ম্যাচে ২৩ বলে ৩৩ রান করার পর এবার আরও তা-ব চালালেন। ৪০ বলে ফিফটি হাঁকানোর পর বিধ্বংসী হয়ে গেলেন। বাকি ১২ বলে আরও ৩১ রান করেন। সবমিলিয়ে ৫২ বলে ৫ চার ও ৪ ছক্কায় অপরাজিত ৮১ রান মুশফিকের। চলতি আসরের সেরা ব্যক্তিগত ইনিংসটার সুবাদে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ ৪ উইকেটে ১৯২ রানও ওঠে বরিশাল বুলসের। রাজশাহী ব্যাটিংয়ে নামার পর ম্লান হয়ে গেলেন মুশফিক। রাজশাহীর শুরুটা প্রথম ওভারেই রকিবুল হাসানকে হারিয়ে শুরু হয়েছিল। তবে সেদিকে তেমন গুরুত্বই দিলেন না স্বভাবজাত হিসেবে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান সাব্বির। আগের দুই ম্যাচে নিজের খেলা ইনিংস নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এদিন সেটা পুষিয়ে দিলেন। যদিও ব্যক্তিগত ১৪ রানেই সহজ একটি ক্যাচ দিয়েছিলেন, সেটা হাতছাড়া করেন আল আমিন হোসেন। এরপর আরও চড়াও হয়ে ওঠেন সাব্বির। একের পর এক চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়ে চলতি বিপিএলের সবচেয়ে জমজমাট ম্যাচ করে তোলেন এটিকে। ক্যাচ মিস মানেই ম্যাচ মিস। সাব্বিরকে প্রাণ দেয়ার খেসারত দিতে হয়েছে। কারণ অনেক আগেই ঘোষণা হয়েছিল যে সাব্বির টি২০ স্পেশালিস্ট। সেটার স্বাক্ষর তিনি ইতোমধ্যেই দেখিয়েছেন আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচেও। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এ বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি টি২০ এশিয়া কাপে সেটার জলজ্যান্ত নজির দেখিয়েছিলেন। ওই ম্যাচে ৫৪ বলে ১০ চার ও ৩ ছক্কায় ৮০ রানের একটি বিস্ফোরক ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন। সেটাই এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক টি২০ ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস তার। সেই সাব্বির আউট হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া মানেই প্রতিপক্ষের জন্য চরম বিপদ। সেটাই হলোÑ শেষ পর্যন্ত মাত্র ২৬ বলেই ফিফটি পেয়ে যান তিনি। পরে হয়ে ওঠেন আরও দুরন্ত। সেঞ্চুরি হাঁকাতে সবমিলিয়ে ৫৩ বল লেগেছে তার। এটি বিপিএলের হওয়া নবম সেঞ্চুরি। তবে দ্রুতগতির দিক থেকে চার নম্বরে। আহমেদ শেহজাদ ৪০ বলে, ক্রিস গেইল ৪৪, ৪৬ ও ৫৩ বলে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। তবে কোন বাংলাদেশীর পক্ষে টি২০ ক্রিকেটে দ্রুতগতির সেঞ্চুরিটা সাব্বিরেরই। নাফীস ৬৭ ও আশরাফুল ৫৬ বল খেলে শতক হাঁকিয়েছিলেন। এমন ইনিংস নিয়ে সাব্বির নিজেও দারুণ উচ্ছ্বাসিত। তিনি বলেন, ‘টি২০ সবসময় আমারই ম্যাচ, আমার খেলা। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, এটা আমারই ফরমেট। তাই আমি বিশ্বাস করি, আজ না হলে কাল, কাল না হলে একদিন আমি বড় স্কোর গড়বোই।’ সাব্বিরের বিশ্বাসটা সত্য হয়েছে। তিনি ৬১ বলে ৯ চার ও ৯ ছক্কায় ১২২ রানে ফিরে যান। ২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আসরে ক্রিস গেইল বরিশাল বুলসের হয়ে খেলেছিলেন ১১৬ রানের ইনিংস। সেটাই ছিল বিপিএলের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড। নতুন রেকর্ড গড়লেন এবার সাব্বির। নিজের খেলার ধরন নিয়ে এ বিধ্বংসী ডানহাতি ব্যাটসম্যান বলেন, ‘আমি নির্দিষ্ট কোন বোলারকে লক্ষ্য করি না। টি২০তে যখন লক্ষ্য তাড়া করি, আমি স্কোরবোর্ডে তাকাই। রানরেট কত তা সবসময় খেয়াল করি। তখন ঠিক করি কখন রান রেট ৫ থেকে ৬-এ নেব। এভাবেই নিজের ইনিংস এগিয়ে নেই আমি।’ বিপিএলে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড এখন সাব্বিরের। এই ইনিংস খেলার পথে ৫৩ বলে তিন অঙ্ক ছুঁয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান হিসেবে টি২০তে দ্রুততম শতকের রেকর্ডও গড়েন তিনি। এরপরও মুখ ভার তার, কারণ দল যে হেরে গেছে ৪ রানে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় দলের জন্য খেলি। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনা করেই খেলার চেষ্টা করি। ১ রান করে ম্যাচ জেতা আর ১০০ রান করে জেতা একই কথা। ম্যাচ জেতার ওপর আসলে সব নির্ভর করে। আমি ১ রান করার পরও দল জিতলে খুব ভাল লাগে। আবার ১০০ রান করার পর হারলে খুব খারাপ লাগে।’ অবশ্য দেশের মাটিতে টি২০ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসে সাব্বিরের ওপরে তামিম। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত বিজয় দিবস টি২০ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় ইউসিবি-বিসিবি একাদশের পক্ষে এ বাঁহাতি মারকুটে ওপেনার করেছিলেন ১৩০ রান। সবমিলিয়ে ৬৪ বলের ইনিংসে তিনি ১৬ চার ও ৪ ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন। ২৯ ডিসেম্বর হওয়া মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে তামিম মাত্র ৫২ বলেই শতক হাঁকিয়েছিলেন। তাই যে কোন পর্যায়ে দেশের মাটিতে প্রতিযোগিতামূলক টি২০ আসরের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডেও তামিমের পেছনেই আছেন সাব্বির।
×