ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২০ নবেম্বর খুলে দেয়া হবে

কঠোর নিরাপত্তায় হলি আর্টিজানে মেরামত চলছে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

কঠোর নিরাপত্তায় হলি আর্টিজানে মেরামত চলছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই চলছে গুলশানের বহুল আলোচিত হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারির মেরামত কাজ। আগামী ২০ নবেম্বর রেস্তরাঁ ও ক্লিনিকটি খুলে দেয়ার নোটিস দেয়া হয়েছে বাইরে। বিধ্বস্ত হলি আর্টিজানের মেরামত কাজের সঙ্গে জড়িতদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। যাদের পরিচয়পত্র নেই, তাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে হলি আর্টিজান কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে। অন্যথায় সেখানে যাওয়ার আর কোন পথ নেই। মূল ফটকে সর্বক্ষণিক পাঁচজন পুলিশ সদস্য ভারি অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। আর যেসব রাস্তা দিয়ে হলি আর্টিজানে যাওয়া যেত, সেসব রাস্তা অনেক আগেই স্টিলের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। অন্তত এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্টিলের বেড়া দেয়া হয়েছে। হলি আর্টিজান লাগোয়া লেক পাড়ের প্রাতঃভ্রমণের রাস্তায় সব ধরনের মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে হলি আর্টিজানের পরিবেশ আগের চেয়ে আরও বেশি নীরব আর শুনশান হয়ে পড়েছে। অনেকটা ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে সেখানে। এদিকে আর্টিজানের জঙ্গী হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ। মামলার তদন্তে সন্দেহভাজন আসামি তাহমিদ হাসিব খানকে ঘটনার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অপর সন্দেহভাজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম কারাগারে রয়েছেন। তার বিষয়টি এখনও পরিষ্কার হয়নি। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর হামলার অন্যতম কারিগর নুরুল ইসলাম মারজানকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। মারজানকে পাওয়া গেলে গুলশান হামলার সবকিছুই দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে কবে নাগাদ এ মামলায় চার্জশীট দাখিল করা হবে তা এখনও স্পষ্ট করেনি তদন্তকারী সংস্থা। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে দিয়ে দেখা গেছে, আশপাশের এলাকাজুড়ে এখনও শুনশান নীরবতা। আর্টিজানের অন্তত দশ হাত আগেই কাঁটাতারের স্টিলের বেরিকেড ফেলানো। সেখানে ভারি অস্ত্র নিয়ে সতর্ক অবস্থায় দেখা গেল পাঁচ পুলিশ সদস্যকে। একটু সামনে গেলেই চোখে পড়বে একটি সাইনবোর্ড। কালো রঙের বড় সেই সাইনবোর্ডে আগামী ২০ নবেম্বর হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারি আবার খুলে দেয়া হচ্ছে বলে লেখা রয়েছে। এজন্য পুরোদমে মেরামতের কাজ চলছে বলেও সেই নোটিসে জানানো হয়েছে। লেক ভিউ কর্তৃপক্ষ এমন নোটিস দিয়েছে। লেক ভিউ এবং হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর মালিক একই। ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানান, উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা ভেতরে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করেছেন। শুধুমাত্র ভেতরে যারা মেরামতসহ অন্যান্য কাজে জড়িত তাদেরই প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। কবে নাগাদ প্রবেশ করতে দেয়া হবে তা নিশ্চিত নয়। তবে নোটিস মোতাবেক আগামী ২০ নবেম্বরের আগে সবার প্রবেশ সম্ভব নয়। রেস্তরাঁ লাগোয়া পাশের বাড়ির ভেতরে ঢুকে সিঁড়িতে দাঁড়াতেই ভেতরের দৃশ্য চোখে পড়ল। সে দৃশ্য এখনও পিলে চমকানোর মতো। এখনও অনেকটাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত ময়দানের মতো। এখানে সেখানে ইট পলেস্তারা, দেয়াল, গাছের ভাঙ্গা ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঝে মধ্যেই বাতাসে পচা রক্তের দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল। রেস্তরাঁটির ডানদিকে থাকা লেকভিউ ক্লিনিকটির সাইনবোর্ড এখনও টিকে আছে। দূর থেকে সাইনবোর্ডটি চোখে পড়ে। রেস্তরাঁয় ঢুকতে ডান দিকে একটি প্রাইভেটকার, কয়েকটি বাইসাইকেল ধুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। ভেঙ্গে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা চেয়ার টেবিলগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঢুকতেই বাম দিকে হলি আর্টিজানে প্রবেশের মূল প্রবেশ গেট। সেখানে গোলাকৃতির একটি শৌখিন ছোট স্টিল ফ্রেমের তৈরি ঘর রয়েছে। ঘরের শুধু স্টিলের কয়েকটি ফ্রেম আর চারটি সিমেন্টের থাম টিকে আছে। এছাড়া আর কিছুই নেই। কমান্ডো অভিযানের সময় এবং জঙ্গীদের গুলিতে সব ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ভেতরে ৩০ থেকে ৩৫ জনকে কাজ করতে দেখা গেছে। বিভিন্ন জনকে নানা দলে ভাগ করে কাজ করতে দেখা গেল। একটি দল মাঠের ঘাস কাটছে। আরেকটি দল ঢুকতেই বাম দিকে হলি আর্টিজানের যে প্রবেশ ঘরটি রয়েছে তা মেরামত করছে। সেখানেই ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে ঝালাইয়ের কাজ চলছে। অন্যদিকে দোতলা বাড়িটির বিভিন্ন জায়গায় ভেঙ্গে পড়া দেয়াল মেরামত, খসে পড়া পলেস্তারা লাগানো ও রং করা চলছে পুরোদমে। আর্টিজান মেরামত করে আবার চালু করার খবরে অনেক পুরনো কর্মকর্তা কর্মচারী সেখানে যোগাযোগ করছেন বলে সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন। গত ১ জুলাই রেস্তরাঁটিতে জঙ্গী হামলায় বনানী থানার ওসি সালাহ উদ্দিন খান ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ছাড়াও ১৭ বিদেশী ও তিন বাংলাদেশী নিহত হন। সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গীর মৃত্যু হয়। কমান্ডোরা জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন তিন বিদেশীসহ ১৩ জিম্মিকে। ঘটনার পর থেকেই পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার রয়েছে। হলি আর্টিজানের আশপাশের সব রাস্তায় সর্বক্ষণিক অতিরিক্ত পুলিশ এখনও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। এদিকে আলোচিত এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ বলছে। তদন্তকারী সংস্থার দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সামান্য কিছু তথ্যের দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের কাজ বাকি রয়েছে। ঘটনার মাসখানেক পরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম ও তাহমিদ হাসিব খান আটক হয়। তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সর্বশেষ তাহমিদ হাসিব খানকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তবে তদন্তে এখনও হাসনাত রেজা করিম নির্দোষ প্রমাণিত হননি। আর্টিজানের ঘটনা সংঘটিত করা থেকে শুরু করে অর্থায়ন পর্যন্ত অনেক কিছু সম্পর্কেই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। হামলার মাস্টারমাইন্ড নব্য জেএমবির প্রধান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। হলি আর্টিজানের ঘটনার আরেক নেপথ্য কারিগর জঙ্গী নুরুল ইসলাম মারজান। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই হলি আর্টিজানের তদন্ত প্রক্রিয়া প্রায় শতভাগ দালিলিকভাবেই শেষ হয়ে যাবে। জঙ্গী হামলার ঘটনাটির আদ্যোপান্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে। অবশ্য মারজান হলি আর্টিজানের ঘটনায় কিভাবে জড়িত সে সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ইতোমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে।
×