ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্ধার করে যে কোন দিন দেয়াল তুলে দেয়ার কথা জানালেন মেয়র আনিসুল হক

মোনায়েম পরিবারের দখলে আরও চার কাঠা জমি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

মোনায়েম পরিবারের দখলে আরও চার কাঠা জমি

মশিউর রহমান খান ॥ পাকিস্তানের সাবেক গবর্নর স্বাধীনতাবিরোধী কুখ্যাত মোনায়েম খানকে পাকিস্তান সরকারের বরাদ্দকৃত জমির অতিরিক্ত আরও ৪ কাঠা সম্পত্তি তার পরিবার সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দখলে রেখেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। এ সম্পত্তি ডিএনসিসি কর্তৃক সদ্য উদ্ধারকৃত ১০ কাঠা জমির বাইরে। একই সঙ্গে আদালতের নির্দেশে উক্ত দখলকৃত সম্পত্তি মোনায়েম খানের পরিবারের কাছ থেকে উদ্ধার করে ওই জমিতে যে কোন দিন দেয়াল তুলে দেবেন বলেও জানান মেয়র। মঙ্গলবার উচ্চ আদালতের নির্দেশে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে জরিপ চালানোর পর এ জমির খোঁজ মিলেছে বলে জানিয়েছেন মেয়র। জনকণ্ঠকে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন মোনায়েম খানের পরিবার কর্তৃক মোট ১৪ কাঠা জমি দখলের দীর্ঘদিনের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো। মোনায়েম খানের পরিবার গত ৫০ বছর ধরে এ সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করে রাখে। ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় উক্ত সম্পত্তির দখল বুঝিয়ে দিতে চিঠি দিলেও পরিবারের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পায়নি। পরে গত ৩ নবেম্বর বিকেলে বনানীর ২৭ নম্বর রোডের ১১০ নম্বর বাড়িতে ডিএনসিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (উপসচিব) মোঃ নুরুজ্জামান শরীফ ও মোঃ সাজিদ আনোয়ারের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ১০ কাঠা সম্পত্তি উদ্ধার করে। উদ্ধারের দুদিন পর উক্ত স্থানে দেয়াল তৈরি করে দেয় ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী মোনায়েম খানের ছেলে কামরুজ্জামান খান, মেয়ের জামাইসহ পরিবারের পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত সার্ভেয়ারদের উপস্থিতিতে এক জরিপ শেষে এ তথ্য জানান ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বুধবার ওই জায়গাটিতে বাউন্ডারি নির্মাণ কারা হতে পরে। মঙ্গলবার জরিপের সময় রাজউকের দুজন প্রতিনিধি, মোনায়েম খানের ছেলে কামরুজ্জামান খান, মেয়ের জামাই, ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং সার্ভেয়াররা উপস্থিত ছিলেন। সূত্র জানায়, মোনায়েম খানের পরিবার প্রথমে তাদের দখলে অবৈধ সম্পত্তি নেই বলে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করলেও মঙ্গলবার আদালতের রায় অনুযায়ী রাজউক ও ডিএনসিসির বরাদ্দকৃত জমির সঠিক বরাদ্দের পরিমাণ পরিমাপ জরিপের পর তাদের দখলে সম্পত্তি রয়েছে তা প্রমাণের পর মোনায়েম খানের পরিবার সম্পত্তি অবৈধ দখলের কথা মেনে নিয়েছে বলে জানা গেছে। গত রবিবার সরেজমিন ওই জমিতে ছোট ছোট গাছ লাগাতে দেখা যায়। আর ডিএনসিসির তৈরি করা দেয়ালের উপরে হাইকোর্টের স্থিতি অবস্থার রায়ের একটি ফটোকপি ঝুলতে দেখা যায়। উল্লেখ্য, গত রবিবার স্বাধীনতাবিরোধী পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গবর্নর মোনায়েম খান ১৯৬৬ সালে কোন্ কোন্ কর্তৃত্ববলে বনানীতে ৫ বিঘা ১৬ ছটাক ভূমি বরাদ্দ পেয়েছিলেন, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। রাজউক চেয়ারম্যান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে চার সপ্তাহের মধ্যে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে মোনায়েম খানের বাড়ির রাস্তার পাশে সবুজায়নের (গ্রীন বেল্ট) জন্য বরাদ্দকৃত ৫০ ফুট বাই ২০০ ফুট জায়গা রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনের যৌথ জরিপের মাধ্যমে চিহ্নিত করার পর দখলমুক্ত করে ১৫ নবেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে আদেশ দেয় হাইকোর্ট। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রবিবার এ আদেশ দেয়। আদালতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী শাহজাদা আল আমিন কবির সোহেল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। আদেশের পর আইনজীবী শাহজাদা আল আমিন কবির সাংবাদিকদের বলেন, আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে মোনায়েম খানের পরিবার ও রাজউককে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষের আইনজীবী আহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘হাইকোর্ট আমাদের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল। ব্যাখ্যায় আমরা দেখিয়েছি, সবুজায়নের জায়গা দখল করে নিয়েছেন মোনায়েম খানের পরিবারের সদস্যরা। হাইকোর্ট ইতোপূর্বে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। কিন্তু রাস্তার ব্যাপারে কোন স্থগিতাদেশ ছিল না। এ বিষয়টি আদালতে জানিয়েছি। এরপর আদালত এ আদেশ প্রদান করেছে। বনানীর ব্লক ‘এ’র ১১০ নম্বরের পাঁচ বিঘা ১৬ ছটাকের প্লটটি ১৯৬৬ সালে তৎকালীন ডিআইটি (বর্তমান রাজউক) থেকে বরাদ্দ পান মোনায়েম খান। পরে ২০০৯ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন তাদের জায়গা উল্লেখ করে চিঠি দেয়। ওই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন মোনায়েম খানের ছেলে কামরুজ্জামান। ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট স্থিতাবস্থা জারি করে। মোনায়েম খানের বাড়িতে ডিএনসিসির দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। এরপর ডিএনসিসির উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে আসেন মোনায়েম খানের ছেলে মোঃ কামারুজ্জামান খান। পরে গত ৭ নবেম্বর হাইকোর্টের স্থিতিতাবস্থা থাকা সত্ত্বেও মোনায়েম খানের বাড়ি (বনানীর ২৭ নম্বর রোডে ১১০ নম্বর বাড়ি) কেন উচ্ছেদ করা হলো, তার ব্যাখ্যা জানতে চায় হাইকোর্ট। সাত দিনের মধ্যে লিখিতভাবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) কাছে এ ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে সাত দিনের জন্য সকল উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিত রাখতে নির্দেশ দেয় আদালত। সে অনুসারে ডিএনসিসির দেয়া ব্যাখ্যার ওপর রবিবার শুনানি শেষে আদেশ দেয় হাইকোর্ট। উল্লেখ্য, ৩ নবেম্বর মোনায়েম খানের বাড়ির অবৈধ অংশ ভেঙ্গে দেয়ার পর জানা গেছে, মোনায়েম খানের দখলে ছিল প্রায় ১০ কাঠা জমি। এর আয়তন ছিল লম্বায় ২০২ ফুট ও প্রস্থে ৩৬ ফুট। উচ্ছেদ অভিযান পরিদর্শন করেন ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাঈদ আনোয়ারুল ইসলাম ও ৩ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুজ্জামান শরীফ প্রমুখ। রাজধানীর বনানী কবরস্থান সড়কে সরকারী প্রায় পাঁচ বিঘা জমি দখল করে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দেশবিরোধী অন্যতম কুচক্রী মোনায়েম খান গড়ে তোলেন ‘বাগ-ই-মোনায়েম’। কিন্তু ডিএনসিসির অভিযানের সময় পরিবারের পক্ষ থেকে কোন বৈধ নথি দেখাতে না পারায় মূল সড়ক থেকে ১৬ ফুট ভেতরে ভবনের সামনের অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়। বাড়ির ভেতরের দুই দিকের গেট লাগোয়া যে দুটি ঘর ছিল সে দুটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এদিকে, ১২ নবেম্বর রাজধানীর বনানীতে স্বাধীনতাবিরোধী কুখ্যাত মোনায়েম খানের বরাদ্দকৃত বাড়িটির স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরির দাবি জানিয়েছেন দেশের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ ৯টি সংগঠন ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক। একই সঙ্গে তারা সকল স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও মৃত সকল রাজাকার-আলবদরদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে মরণোত্তর বিচার দাবি করেন ও তাদের অর্জিত সকল সম্পত্তি বাজেয়াফত করে যুদ্ধাহতসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার কল্যাণে ব্যয় করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি জোর আহ্বান জানান। এ সময় ডিএনসিসি মেয়র রাজধানীর অবৈধভাবে দখলকৃত হাজার হাজার একর জমি পুনরুদ্ধারে একটি আলাদা কমিশন গঠন করতে প্রধান বিচারপতির কাছে দাবি জানান।
×